মার্কিন উচ্চশিক্ষায় মহাধস শুরু হয়ে গেছে

ডোনাল্ড আরল কলিন্স
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ পিএম

গত ১১ মার্চ নিউইয়র্ক সিটির কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লো লাইব্রেরির সিঁড়িতে শিক্ষার্থীরা মার্কিন অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ সংস্থার ক্যাম্পাসে উপস্থিতির প্রতিবাদে ওয়াকআউট কর্মসূচি পালন করে। ছবি: ডানা এডওয়ার্ডস, ফাইল ছবি, রয়টার্স
আর কোনো ঘুরিয়ে বলার সুযোগ নেই—আমেরিকা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ১৯৬০-এর দশক থেকে চিনে এসেছে, সেই পরিচিত ছবি আজ শেষের দিকে। গত ১৫ বছর ধরে যেসব কলেজ বন্ধ হচ্ছে বা একত্রিত হচ্ছে, সেই ধারাটা আগামী কয়েক বছরে আরও বাড়বে বলেই ধরে নেওয়া যাচ্ছে।
২০১০ সালে আমেরিকায় কলেজে ভর্তি সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু তারপর থেকে কলেজে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছেই—খরচের বাড়তি চাপ, কোভিড-১৯ মহামারি, আর নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা এর পেছনে বড় কারণ। এর উপর সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ ঠেকাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ, ডিইআই (DEI) কর্মসূচির বিরুদ্ধে রাজনীতিক চাপ আর বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি দমন–সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ।
এখন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় টিকতে পারছে না, তাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হয়তো এ দশকের শেষ নাগাদ একেবারে সুনামির মতো দেখা দেবে।
সোনোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি তার ২৪ মিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতি সামলাতে গিয়ে ২২টি মেজর, ৬টি ডিপার্টমেন্ট এবং শতাধিক শিক্ষক ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করেছে। আর্ট হিস্টরি, ইকোনমিক্স, ফিলোসফি, জেন্ডার স্টাডিজ—এইরকম মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানভিত্তিক বিভাগগুলোই বেশি ঝুঁকিতে।
এই দশকে সবচেয়ে বড় কাটছাঁট হয়েছে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে, ২০২৩ সালে। ছয় বছর ধরে ভর্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেও ৪৫ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে পড়ে তারা ৩২টি মেজর (যার মধ্যে সব ভাষা কোর্সও ছিল) আর ১৬৯ জন শিক্ষকের চাকরি কাটার ঘোষণা দেয়। পরে ছাত্রদের বিক্ষোভে কিছুটা পিছু হটে ২৮টি মেজর আর ১৪৩টি শিক্ষক পদ ছাঁটাই করা হয়। মানবিক ও ক্ষুদ্র গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলোই মূলত নিশানায় ছিল।
এই গল্প শুধু একেকটা কলেজের নয়—এটা একটা বড় এবং ভয়ংকর প্রবণতার ইঙ্গিত। গত ৫০ বছরে নারীদের কলেজে ভর্তির হার বাড়লেও পুরুষদের, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের সংখ্যা কমেছে। ১৯৭০ সালে যেখানে পুরুষরা ছিল ৫৮%, এখন তারা মাত্র ৪০%। ২০১০ সালের পর থেকে ভর্তির যে ধস, তার ৭১% এই পুরুষ শিক্ষার্থীদের হ্রাসের কারণেই।
আরও অনেক কলেজ ভয়াবহ সংকটে: যেমন পেনসিলভানিয়ার ক্ল্যারিয়ন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট রোজ কলেজ, বা উটাহর ইন্ডিপেন্ডেন্স ইউনিভার্সিটি। এখন পর্যন্ত ৭৬টি কলেজ হয় বন্ধ হয়ে গেছে, না হয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০১০ সালে যেখানে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১ কোটি ৮১ লাখ, ২০২১-এ তা নেমে এসেছে ১ কোটি ৫৪ লাখে। কোভিডের প্রথম বছরেই কমেছে ৩.৫ লাখ। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বাড়লেও এই ধারা আটকানোর মতো নয়।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ফিলাডেলফিয়া পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে আরও ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর পেছনে আছে জনসংখ্যার ‘ডেমোগ্রাফিক ক্লিফ’—শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫% কমে যাওয়ার ভয়।
এর মধ্যে আবার ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ধারা—বিদেশি ছাত্রদের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতিমালা, ভিসা বাতিল, গ্রেফতার, এমনকি নির্বাসন। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি চীন থেকেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৩-২৪ সালে ১১ লাখেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী মার্কিন কলেজে ভর্তি ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়েনে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতি প্রশাসনের আচরণে, ভবিষ্যতে এই সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে—এটা এখন শুধু ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, বরং বাস্তবতা। উদাহরণস্বরূপ, দশকের পর দশক ধরে স্থায়ী শিক্ষকের বদলে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসকদের কর্পোরেট স্টাইলের পরিচালনা, উদারশিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ, এবং উদারপন্থী চর্চাকে "অনৈতিক", "প্রপাগান্ডা", "লিবটার্ড" ইত্যাদি নামে দমন করা—সব মিলিয়ে আজকের বিপর্যয় অনিবার্য ছিল।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লিবারেল আর্টস বিভাগ। দিন দিন এগুলো একীভূত হচ্ছে, অথবা একেবারে তুলে দেওয়া হচ্ছে বাজেট বাঁচানোর অজুহাতে। প্রবীণ শিক্ষকরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, নতুনেরা চাকরির সুযোগই পাচ্ছেন না। শীর্ষস্থানীয় ১৩৬টি এলিট বিশ্ববিদ্যালয় বা ৫০টি বড় পাবলিক কলেজ বাদ দিলে বাকিরা টিকে থাকারই লড়াইয়ে ব্যস্ত।
সত্যি বলতে, আমেরিকার উচ্চশিক্ষা এখন আর খাতার হিসাব নয়—এটা এক গভীর খাদে পড়া বাস্তবতা।
ডোনাল্ড আরল কলিন্স: মার্কিন লেখক, ইতিহাসবিদ এবং সামাজিক বিশ্লেষক।