দীর্ঘ শঙ্কার মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ শুরু, যেমন হতে পারে ইরানে ইসরায়েলের পাল্টা আঘাত
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: সংগৃৃহীত।
হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ চলতি সপ্তাহে ইরান যখন ইসরায়েলে ১৮০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল, তখন কেউ কেউ তেহরানের এই তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হয়েছেন।
আবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধা মতো সময় এর জবাব দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিরাপত্তা মন্ত্রীদের নিয়ে মধ্যরাতে বৈঠকও করেছেন। তখন তিনি বলেন,যারাই আমাদেরকে আক্রমণ করুক না কেন, আমরাও তাদেরকে আক্রমণ করবো।
এদিকে, বাইডেন প্রশাসন ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কড়া নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। হোয়াইট হাউস বলেছে,ইরান ‘কঠিন পরিণতি’ ভোগ করবে। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানের পরমাণু অবকাঠামোতে হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাহলে ইরানের এই হামলার ইসরায়েরের প্রতিশোধের ধরন কেমন হবে, ইরান-ইসরায়েল পুর্নমাত্রায় যুদ্ধ বাধবে এবং সম্ভবত আমেরিকার সঙ্গেও, প্রকৃত কেমন হবে?
ইতোমধ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে গেছে
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ আর আসন্ন নয়, ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। প্রায় এক বছর আগে ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হওয়া যুদ্ধ এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েল সীমান্ত থেকে অনেক দূরে দেশগুলো ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই করছে। এরে বৈশ্বিক প্রভাবও রয়েছে।
চলতি সপ্তাহে ইরানের আক্রমণ প্রমাণ করে এই সংঘাতে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা একপক্ষে, আর অন্য পক্ষে আছে চীন, রাশিয়া ও অন্যদের সমর্থিত ইরান ও তাদের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো।
ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে সামরিক এবং কূটনৈতিক সহায়তায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে মস্কো ইরানকে যুদ্ধ বিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া নিজেদের ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ইরানি অস্ত্র কিনছে। এর মাধ্যমে তেহরানকে খুব দরকারি অর্থ সরবরাহ করছে মস্কো।
এদিকে, বর্তমানে ইসরায়েল বেশকয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত দেশটি গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ইতোমধ্যে ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গেরিলা সংগঠন হিসেবে হামাসের তৎপরতা হ্রাস পেয়েছে। তবে এখনো বাস্তুচ্যুত অনেক ফিলিস্তিনির ওপর সংগঠনটির প্রভাব রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, পশ্চিম তীরে স্থানীয় যোদ্ধারা ইরানের অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তায় সন্ত্রাসীদের হামলা চালাচ্ছে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।
এদিকে, ইরানের অন্য প্রক্সি গোষ্ঠী যেমন ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়া মিলিশিয়া এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী এখনো ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। ইয়েমেনে হুতিদের ওপর ইসরায়েল এবং আমেরিকা উভয়ে পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
যদিও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হয়েছে লেবাননে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর,দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলা চালায়। এতে ১২০০ ইসরায়েলি নিহত ও দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে নেওয়া হয়। পরদিন ৮ অক্টোবর কোনোরকম উসকানি ছাড়াই হামাসের প্রতি সংহতি জানাতে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট ও অন্যান্য অস্ত্র ছুড়ে। এতে সীমান্ত এলাকার ৬০ হাজারের বেশি ইসরায়েলিকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে।
দুই সপ্তাহ আগে ইসরায়েল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত ওয়াকি-টকি এবং পেজারে লুকায়িত হাজার হাজার হাজার বিস্ফোরক বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দেন নেতানিয়াহু। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এই নির্দেশ দেন নেতানিয়াহু।
এসব বিস্ফোরণের পর আইডিএফ হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য দেড় লাখ ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন লক্ষ্য করে ব্যাপক আকারে বিমান হামলা চালায়। এরপর তারা হিজবুল্লাহর এলিট ফোর্স রাদওয়ানকে লক্ষ্য করে স্থল অভিযান শুরু করে। এসবের উদ্দেশ্য হলো হিজবুল্লাহ যেন ৭ অক্টোবরের হামাসের মতো উত্তর ইসরায়েলে নৃশংসতা বা আক্রমণ না চালাতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলের এই অভিযানের ফলে ১০ লাখের বেশি লেবানিজ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
পাল্টা আঘাতের জন্য ইসরায়েলের বিকল্প
এখন চলতি সপ্তাহে ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সরাসরি এই সংঘাতে জড়িয়ে গেল। যদিও আমেরিকা, জর্ডান ও অন্য দেশের সহায়তায় ইসরায়েলের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র-রোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে ইরানের ছোড়া বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র রুখে দিয়েছে। অল্প কয়েকটি ইসরায়েলের ভেতরে আঘাত হানে। এতে পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলে এটি ইরানের সরাসরি আক্রমণ। প্রথম আক্রমণের পাল্টা আঘাত হিসেবে ইসরায়েল সীমিত আকারে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আক্রমণ চালায়। ইরানের এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই দেশটির ইসপাহানের পরমাণু স্থাপনার সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এই প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত ইরানের দ্বিতীয় হামলার ইসরায়েলের পাল্টা হামলার প্রভাব কতটুকু হয় তা অজানা।
একটি দৃশ্য তেহরানকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করছে। কারণ আমেরিকার সহায়তায় ইসরায়েল হয়তো ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে লক্ষ্য করতে পারে। এসব স্থাপনার মধ্যে যোগাযোগ ও পরিবহন নেটওয়ার্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তেল শিল্প (বিশেষত তেল বিক্রির অর্থ দিয়েই শক্তিশালী ইসলামিক রেভুল্যুশনারি গার্ডের খরচ মেটানো হয়) রয়েছে। এটা হয়তো ইরানের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং যা শাসকদের টিকে থাকার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
যদিও তেহরানের শাসন পরিবর্তন খুবই কঠিন একটি কাজ। ইরানি নেতারা কোনো ধরনের সুযোগ নেবে না। ইতোমধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনিকে যেকোনো ধরনের হত্যাচেষ্টা থেকে বাঁচাতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচি ইরানি শাসকদের মুকুটে রত্ন হিসেবে রয়ে গেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা বিশ্বাস করে যে, দেশটির এই পারমাণবিক কর্মসূচি পরমাণু বোমা তৈরির আড়াল হিসেবে কাজ করে।
ইরানের নেতারা এখন ভয় পেতে পারেন, ইসরায়েল এবং আমেরিকা তাদের পারমাণবিক অবকাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। যেমনটি উভয় দেশের কিছু রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়েছেন। বাইডেন অবশ্য পারমাণবিক অবকাঠামোতে হামলার চেয়ে ইরানের যেরকম আক্রমণ করেছে সেরকম আঘাতেরই আহ্বান জানাচ্ছেন।
ইসরায়েলে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের আক্রমণে ইরানকে ‘অন্ধকারে’ রাখার ইঙ্গিত হিসেবে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেওয়ার বিবেচনা করতে পারে ইসরায়েল। অন্যান্য সম্ভাবনাগুলিও সামনে আছে।
ইসরায়েলের সামনে সুযোগ খুব কমই
উত্তেজনা কমানোর প্রয়াসে, ইরানি কর্মকর্তারা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর শত্রুতা শেষ বলে তাদের ইচ্ছার কথা দ্রুত ঘোষণা করে।
যদিও সংঘাত পুরো মাত্রায় আছে। হামাস মনে করেছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরাইল ভেঙে পড়বে। বরং তার পরিবর্তে, ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দিয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানায়। এতে হামাসের শক্তিকে শেষ করে দেয়। তবে এই যুদ্ধে ব্যাপক হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞও হয়েছে।
একইভাবে, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের ইসরায়েলে হামলার সিদ্ধান্তগুলি গুরুতর ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ ইসরায়েল যে নজিরবিহীন প্রভাবের বিস্তার করে প্রতিশোধ নেবে সেই সংকল্পকে অবমূল্যায়ন করেছে।
বল এখন ইসরায়েলের কোর্টে। যদিও যেকোনো প্রতিশোধের ক্ষেত্রে আইডিএফকে এখন ভাবতে হবে। কারণ ইতোমধ্যেই আইডিএফ ছোট ছোট একাধিক ফ্রন্টে লড়ছে। তাছাড়া ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ সক্ষমতাও খুব বেশি কমেছে বলে মনে হয়নি।
এসবের তুলনায় বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সামনে খুব সরু পথই খোলা এবং খুব সম্ভবত নেতানিয়াহু এই মুহূর্তটুকু পার হতে দেবেন না।
সূত্র : দ্য কনভারসেশন