Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আসামের বাঙালি মুসলমান শ্রমিকরা কেন বিতাড়িত হচ্ছে

Icon

রকিবুজ জামান

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম

আসামের বাঙালি মুসলমান শ্রমিকরা কেন বিতাড়িত হচ্ছে

গত ২৫ আগস্ট জাকারিয়া আলম আসামের নামতিয়ালি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠেন বাড়ি ফেরার জন্য।

৩৬ বছর বয়সী জাকারিয়া ১১ জন নির্মাণ শ্রমিকের সাথে ছিলেন, যাদের সকলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শিবসাগর জেলায় থাকা আর নিরাপদ নয়। এর কয়েক ঘণ্টা আগে, আদিবাসী অসমিয়াদের প্রতিনিধি দাবি করে এমন কয়েকটি সংস্থা আল্টিমেটাম দিয়েছিল, জেলার বাঙালি মুসলিম কর্মীদের সাত দিনের মধ্যে চলে যেতে হবে।

ছয় বছর ধরে আলম মিয়া রাজমিস্ত্রি হিসেবে নামতিয়ালিতে নির্মাণকাজ করছেন। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে দৈনিক ৭০০ টাকা আয় করছেন। মরিগাঁও জেলার লাহারিঘাটে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসেন তিনি। আলম বলেন, ‘আমি আগে এমন হুমকির সম্মুখীন হইনি। আমাদের নিয়োগকর্তা বলেছিলেন, ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল এবং উত্তেজনা কমলে আমরা পরে ফিরে যেতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘কিছু হলে কেউ দায় নেবে না।’

আলম বলেন, ‘হোজাই এবং জাগি রোডের মতো নিম্ন আসামের শহরগুলি থেকে আরও শত শত বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম শ্রমিক শিবসাগর থেকে ফিরে এসেছেন। আমরা একসাথে ফিরে এসেছি। সবাই ভয়ে ফিরে এসেছে।’

এই অঞ্চলে কাজ করা পাঁচজন ঠিকাদার ভারতীয় গণমাধ্যকে জানিয়েছেন, একই কারণে ১০০ জনের বেশি শ্রমিক শিবসাগর ছেড়েছেন।

একজন ৪০ বছর বয়সী বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম কর্মী, যিনি এখনও শিবসাগরে আছেন, এবং অসমিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বাস করেন, তিনি বলেছেন, তিনি ৩০-৪০ জন শ্রমিককে চেনেন যারা জেলা ছেড়েছে। 

তিনি বলেছেন, তিনি সাত বছর ধরে শিবসাগরে বসবাস করছেন, একজন অসমিয়া মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করেছেন এবং জমি কিনেছেন। তার অধীনে ১২ জন কর্মী আছে। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না আমি তাদের ফেরত পাঠাব কি না।’

ঠিকাদার তাইজুল ইসলাম, যিনি আলমকে শিবসাগরে কাজ পেতে সাহায্য করেছিলেন, তিনি বলেছেন, ‘ভারতীয় জনতা পার্টির একজন নেতার নির্দেশে চরাইদেও জেলায় অভিবাসী শ্রমিকদের একটি দলের উপর হামলার খবরের কারণে তাদের দেশত্যাগের সূত্রপাত হয়েছিল।’

যখন বিরোধী নেতারা রাজ্য বিধানসভায় নিম্ন আসামের কর্মীদের হুমকির কথা তুলে ধরেন তখন মুখ্যমন্ত্রী সরমা কোনো আশ্বাস দেননি। পরিবর্তে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেন লোকেরা অবশ্যই নিম্ন আসাম থেকে উচ্চ আসামে যাবে? তার মানে আপনারা সবাই পুরো আসাম নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনারা মুসলিমরা পুরো আসাম নেওয়ার জন্য জোর দেবেন।’

তিনি বলেছেন, ‘উচ্চ আসামে বসবাসকারীরা চাইলে, মুসলিমরা সেখানে যেতে পারে। যদি আপনি সেখানে বসবাসকারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যান, তবে সেখানে কোনো নিরাপত্তা থাকবে না।’

গণধর্ষণ ও হুমকি 

অভিবাসী শ্রমিকদের তাড়ানোর আহ্বানটি নগাঁও জেলার ধিংয়ে এক অসমিয়া কিশোরীকে গণধর্ষণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যেখানে তিনজন বাঙালি মুসলিম যুবককে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

ঘটনার বিষয়ে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছিলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় আসামের আদিবাসীদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।’

অল তাই আহোম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্যরা শিবসাগর এবং তিনসুকিয়া পরিদর্শন করেছে। তারা নির্ধারণ করতে চেয়েছে যে সেখানে মুসলমানরা বসবাস করে কিনা।

এ রকম একটি ঘটনার ভিডিও দেখা গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ওই সদস্যদের স্থানীয় বাড়িওয়ালা ও ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। তারা মুসলিমদের নিয়োগ না করতে বলেন। ফেসবুকে শেয়ার করা অন্যান্য ভিডিওতেও এমন দেখা গেছে। এমনকি ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের মুসলিম কর্মীদের জেলা ছাড়ার হুমকি দিতে দেখা গেছে। তাদের চিৎকার করতে শোনা যায়, ‘মিয়া জাতি, গো ব্যাক।’

মিয়া শব্দটি সেখানে মুসলমানদের অবমাননা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

আসামে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করার সর্বশেষ প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে একে। তাদের প্রায়ই ‘অনুপ্রবেশকারী’ আদিবাসীদের সম্পদ-চাকরি-জমি দখলকারী হিসাবে চিত্রিত করা হয় এবং অসমিয়া সংস্কৃতি ও পরিচয়ের জন্য হুমকি হিসাবে বর্ণনা করা হয়।

তবে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের আধিকারিক বলেছেন, ‘আমরা ব্যাপকভাবে দেশত্যাগের কোনো তথ্য জানি না বা আমাদের কাছে নেই।’ তিনি স্বীকার করেছেন, ‘রাজ্যের কাছে আন্তঃজেলা অভিবাসনের কোনো তথ্য নেই। তারা আমাদের জানিয়ে মাইগ্রেট করে না।’

তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের হয়রানি করার মতো, কয়েকজনকে মারধর করার মতো ঘটনা হতে পারে। তবে বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

কেন তারা উচ্চ আসামে যায় 

আলম বলেন, ‘আমারা উচ্চ আসামে যাই, কারণ আমরা সেখানে নিয়মিত কাজ খুঁজে পায়। আমরা যদি আমাদের নিজ জেলায় কাজ করি তবে আমরা মাসে ২০ দিন কাজ করতে পারি। কিন্তু উচ্চ আসামে আমরা ৩০ দিন কাজ করতে পারি। কারণ সেখানে নির্মাণকাজের অভাব নেই।’

তিনি বলেন, তিনি ১৭ বছর বয়স থেকে দিনমজুরি করছেন, তিনি পড়াশোনা করেননি। তার চাষ করার জন্য জমি নেই এবং তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে কাজের উপর। তিনি কাজের জন্য রাজ্য ছেড়ে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কারণ তিনি তার স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘এখানে থাকলে আমি যখন খুশি বাড়ি ফিরতে পারি।’

কাজে বিঘ্ন ঘটায় তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আমি অলস বসে আছি। কোনো কাজ বা আয় নেই। ফলে আমি কখন বাড়ি ফিরতে পারব তা নিশ্চিত নই। আমার দুই সন্তান। একজন প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। আমি তাদের ফি কিভাবে দেব তা নিশ্চিত নই।’

সাংবাদিক থেকে উদ্যোক্তা হওয়া মনোরম গগৈ বলেছেন, ‘উচ্চ আসামের বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম। গত দুই-তিন দশক ধরে রাস্তা থেকে বিল্ডিং পর্যন্ত সমস্ত ধরনের নির্মাণকাজ মূলত অভিবাসীরা করেছে।; গগৈ গুয়াহাটিতে বসবাস করেন।

তিনি বলেন, ‘যদি এই শ্রমিকদের উচ্চ আসাম থেকে ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্পে খারাপ প্রভাব পড়বে। এটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু প্রাচীন সম্প্রীতিও ভেঙে দিতে পারে। রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভাজন তৈরি করেছেন।’

শিবসাগর-ভিত্তিক রাস্তার ঠিকাদার সারঙ্গা গগৈ স্বীকার করেছেন, ‘অনেক শ্রমিক ফিরে গেছে। অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যার ডেটা কেউ রাখে না। শুধু সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাছে শ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ থাকতে পারে।’

বিরোধী নেতারা মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে এই সাম্প্রদায়িক দাবানল জ্বালানোর জন্য অভিযুক্ত করে সমালোচনা করেছেন। 

রাজ্যের এক সাংসদ প্রদ্যুত বোর্দোলোই। তিনি বলেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন আসামের সরকার আসামে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির খুব চেষ্টা করছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এর প্রধান প্রেরণা। তাই আসামের সমস্ত বিরোধী দল দাবি করেছে, তাকে অবিলম্বে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা উচিত।’ (স্ক্রল ডট ইন থেকে অনুবাদ)

* রকিবুজ জামান, ভারতীয় সাংবাদিক।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন