Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি করে ভারত কেমন ঝুঁকিতে পড়ছে?

Icon

কে এম শেঠি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৮ এএম

ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি করে ভারত কেমন ঝুঁকিতে পড়ছে?

গাজা সংঘাতের মধ্যে ইসরায়েলের কাছে ভারতের অস্ত্র ‘রপ্তানি’ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যুতে ভারতের ঐতিহাসিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান এবং কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার নীতিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গভীর করায় তা ভারতের জন্য প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে আসছে। একই সঙ্গে ‘এই গভীর সম্পর্ক’ আরব দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েনের ঝুঁকিতে রাখছে।

সৌদি আরব ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার। ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি করায় তা ভারতের বিদেশীনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যগুলোর বিপরীত দিকে যেতে পারে, বিশেষ করে সংবেদনশীল গাজা সংঘাতের মধ্যে।

ইরান হল ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ এবং ফিলিস্তিনিদের সমর্থক। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রতি ভারতের এই পদক্ষেপকে ইরান বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখতে পারে। মধ্য এশিয়ায় ভারতের প্রবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইরানের চাবাহার বন্দর, যার উন্নয়নে ভারত বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে ইরানের সাথে ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জটিল হতে পারে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী নৈতিক প্রতিশ্রুতির সাথে আপস না করে তার বৈচিত্র্যময় কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারতকে সাবধানে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে হবে।

অস্ত্র স্থানান্তর সহজাতভাবে সংবেদনশীল, বিতর্কিত ও গোপনীয়তা। ভারতীয় অস্ত্র রপ্তানি বিতর্ক তীব্র হয় যখন অস্ত্র বহনের সন্দেহে জার্মান মালিকানাধীন জাহাজ বোরকুম স্পেনের কার্টেজেনাতে বিক্ষোভের মুখে পড়ে এবং স্লোভেনিয়ার কোপার বন্দরে চলে যায়।

আল-জাজিরা নিশ্চিত করে বলেছে, জাহাজটি ভারতীয় অস্ত্র ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে গেছে। জাহাজের ম্যানেজারের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও, বিভিন্ন তথ্য এখানে প্রমাণ দিচ্ছে যে, গাজা সংঘাতের মধ্যে ইসরায়েলে অস্ত্র চালান করেছে ভারত।

গত ৬ জুন কুদস নিউজ নেটওয়ার্কে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার পরে 'মেড ইন ইন্ডিয়া' লেবেলযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে, যা ভারত-ইসরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র সহযোগিতার নিদর্শন হাজির করছে। ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন। তবে এটি ভারত জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে নিঃসন্দেহে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অনুসন্ধানেও এর প্রমাণ মেলে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসব রিপোর্ট আসার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যবহারিক দিকটির তদন্তে নামে অনেক সংস্থা।

ভারতের অবস্থান জটিলতার মুখে

ভারত হামাসের হামলার নিন্দা করেছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করেছে, এবং উভয় পক্ষকে মানবিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত 'দুই রাষ্ট্র’ নীতি সমর্থন করে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে সংলাপের কথা বলে। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের প্রস্তাব সমর্থন করে। মোদি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতির উপর জোর দেন মোদি এবং গাজায় বেসামরিক হতাহতের নিন্দা করেন। যেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধী। আর ইসরায়েল থেকে ভারত আধুনিক অস্ত্রের সুবিধা পেতে মরিয়া।

মধ্যপ্রাচ্যের এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ভারতের লক্ষ্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা এবং শক্তি সঞ্চয় নিশ্চিত করা।

সুতরাং ভারতের অবস্থান ইসরায়েলের সাথে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব গভীর হওয়ার কারণে জটিল।

১৯৯২ সাল থেকে ইসরায়েলের সাথে ভারতের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময় তা ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে মোদির ইসরায়েল সফরের পর থেকে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর। গত এক দশকে ইসরায়েল থেকে ভারত ২.৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রাডার, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করেছে।

ইসরায়েলের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত গাজায় যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার পক্ষে। কিন্তু ইসরায়েলকে অস্ত্র সহযোগিতা কেন? ইসরায়েল এই সহযোগিতা চায়। তাদের এটা প্রয়োজন। নয় মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখা একটি কঠিনতর কাজ। তার জন্য ইসরায়েলের দরকার বিপুল অস্ত্র-গোলাবারুদ।

নয়াদিল্লি একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, কিছু পর্যবেক্ষক বলছেন, ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বের কারণে ইসরায়েলে ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির সুযোগ হয়েছে। ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো ভারতীয় সরবরাহকারীদের উপর বেশি নির্ভর করছে।

ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী ইসরায়েল। একই সাথে ইসরায়েল ভারত থেকে উন্নতমানের ড্রোন আমদানি করে। ভারতের হায়দ্রাবাদে আদানি-এলবিট ফ্যাসিলিটিতে তৈরি হয় এই ড্রোন।

গাজায় ব্যবহৃত হওয়ার পর ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য ভারতকে আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনের মানুষ। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভারসেন আগাবেকিয়ান রামাল্লায় ভারতীয় প্রতিনিধি রেনু যাদবের কাছে এই আবেদন করেছিলেন।

ভারত-ইসরায়েল প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময় শক্তিশালী হয়। সে সময় ইসরায়েল আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।

ভারত আগে রাশিয়ান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উপর নির্ভর করত। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় নানা কারণে। ইসরায়েল থেকে ফ্যালকন এয়ারবর্ন প্রারম্ভিক সতর্কীকরণ সিস্টেম, ইউএভি সিস্টেম ও স্পাইডার এবং বারাক ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম কিনছে ভারত। ইসরায়েল অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয়। সেই সুযোগ নিতে চান নরেন্দ্র মোদি।

ইসরায়েলি প্রযুক্তির ফলে ভারতের গোয়েন্দা ও নজরদারি কার্যক্রম জোরদার হয়েছে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের একটি সন্ত্রাসী শিবিরে অভিযানে ইসরায়েলি স্পাইস২০০০ বোমা ব্যবহার করেছিল ভারত।

মধ্যপ্রাচ্যের চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত

ইসরায়েলে ভারতের অস্ত্র রপ্তানির ফলে আরব দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে সৌদি আরব ও ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে। কারণ উভয় দেশই ফিলিস্তিনের শক্তিশালী সমর্থক।

আরব লীগের অন্যান্য আরব দেশ, যারা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করেছে, তারাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

পরিস্থিতি কূটনৈতিক সংঘর্ষের দিকে যেতে পারে, যা ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের দেশগুলো ভারতের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এবং ভারতের রেমিট্যান্সের বিরাট উৎস। (দ্য উয়্যার ডট ইন থেকে অনুবাদ)

কে এম শেঠি, ডিরেক্টর, ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড এক্সটেনশন, মহাত্মা গান্ধী ইউনিভার্সিটি, কেরালা। তাছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিন ও সিনিয়র অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন