Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

রাশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ, কী ভাবছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ০৬:৩৬ এএম

রাশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ, কী ভাবছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে রাশিয়া যখন কৃষ্ণ সাগরে অবরোধ সৃষ্টি করল, এই নিয়ে বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মনে ছিল একটি ভিন্ন বাণিজ্য পথ। কাস্পিয়ান সাগর তীরের দেশগুলির নেতাদের সম্বোধন করে রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি বললেন, এ অঞ্চলের পরিবহন ও লজিস্টিক স্থাপত্যে এক বিপ্লব আসছে। সেটা সত্যিই এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। সেটা ২০২২ সালের জুনের শেষের দিকে কথা।

এবং, গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো রাশিয়া সেই স্বপ্নের পথ চালু করেছে। ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর (আইএনএসটিসি) নামের এই স্থলপথ রাশিয়া থেকে ইরান হয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পথে গত সপ্তাহে ভারতে কয়লা বোঝাই দুটি ট্রেন পাঠিয়েছে রাশিয়া।

এই পথের চিন্তা শুরু হয় দুই দশকেরও বেশি আগে। এর দৈর্ঘ্য ৭২০০ কিলোমিটার। একে স্বপ্নের চেয়ে বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার এটি এক বিরল সংমিশ্রণ, যা রাশিয়ার জন্য অত্যাবশ্যক অর্থনৈতিক মুক্তির পথে পরিণত হয়েছে। 

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশাধিকার হারায় রাশিয়া। তখন অন্য বাজার খুঁজতে মরিয়া হন প্রেসিডেন্ট পুতিন।

২০২২ সালে জুন মাসেই ইরান হরমুজ প্রণালীর বন্দর আব্বাসের মাধ্যমে আইএনএসটিসি ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে ভারতে প্রথমবারের মতো পণ্য পরিবহনের ঘোষণা দেয়। ওই বছরেরই পরের মাস জুলাইতে রাশিয়া থেকে ভারতের আরব সাগরের বন্দর নাভা শেভাতে কমপক্ষে ৩৯টি কন্টেইনারের চালান পাঠানো হয়।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সচিবালয়ের প্রাক্তন পরামর্শক বৈশালী বসু শর্মা সে সময় বলেছিলেন, ‘এটি কেবল শুরু।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘২০৩০ সাল নাগাদ আইএনএসটিসি প্রতি বছর প্রায় আড়াই কোটি টন মাল পরিবহনের ক্ষমতা থাকবে, যা ইউরেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও আরব উপসাগরের মধ্যে মোট কনটেইনার পরিবহনের ৭৫ শতাংশ।‘

প্যান-এশীয় ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘ডেজান শিরা’ যার প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ডেভনশায়ার এলিস। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘এগুলি মস্কোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইইউ নিষেধাজ্ঞাগুলি বহাল থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে যখন। তবে ইউক্রেনের সাথে বিরোধ শেষ হওয়ার পরও আইএনএসটিসি রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত-রাশিয়া পণ্য পরিবহন করা হত জাহাজে, যাকে আরব সাগর, লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করতে হত। এবং তাকে পশ্চিম ইউরোপের চারপাশ অতিক্রম করতে হত। তাতে ৪০ থেকে ৬০ পর্যন্ত সময় লেগে যেত। যেখানে আইএনএসটিসিতে লাগবে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ দিন। খচ কমবে ৩০ শতাংশ।

আইএনএসটিসি রুটটি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে বাইপাস করে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতে পৌঁছেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তেহরান সফরের সময় ইরানের চাবাহার বন্দরে বার্থ বিকাশের জন্য সাড়ে ৮ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন এবং শহজ শর্তে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ দেন। ভারত চায় আইএনএসটিসি রুটটি চাবাহারকে অন্তর্ভুক্ত করুক। শেষ পর্যন্ত ভারতের উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে।

আইএনএসটিসি ২০২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়া বা ভারতের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্প ছিল না, বিশেষজ্ঞরা বলছেন। ইউরোপ ছিল রাশিয়ার অর্থনৈতিক ফোকাস। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২০ সালে রাশিয়ার বাণিজ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অবদান রেখেছিল।

নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক গুলশান সাচদেভার বরাতে আল জাজিরায় বলা হয়েছে, ‘রাশিয়ার বেশির ভাগ সাপ্লাই চেইন ইউরোপের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ভারতও গত দুই দশক ধরে পশ্চিম, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপর মনোযোগ দিয়েছে।

ইরানের উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আইএনএসটিসিতে বিনিয়োগ করা বেশি জটিল ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে। এর পেছনে কারণও অনেক। রাশিয়া এর পেছনে জোর দিয়েছে, ডলারের পরিবর্তে রুবলকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যম ঘোষণা করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা চীন-ভারত ইরান ও রাশিয়া থেকে সস্তায় বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে, ইত্যাদি।

২০২২ সালের এপ্রিল ও মে মাসে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি প্রায় ২৭২ শতাংশ বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তাছাড়া ভারত এই দুই মাসে রাশিয়ান সার আমদানি প্রায় ৮০০ শতাংশ বাড়ায়।  সাচদেবার ভাষায়. বাণিজ্যের এই তীব্র বৃদ্ধি আইএনএসটিসির ধারণার প্রমাণ হিসাবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই আইএনএসটিসির পক্ষে সারিবদ্ধভাবে কাজ করেছে।

মার্কিন চাপ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আইএনএসটিসি সফল হয় তাহলে তা পশ্চিমের নতুন চাপের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু পশ্চিমা দাবি মেনে চলার ব্যাপারে ভারতের ক্লান্তি বাড়ছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক শর্মার বরাতে আল-জাজিরায় বলা হয়েছে, ভারত অতীতে ভেনিজুয়েলা ও ইরান থেকে তেল কেনা বন্ধ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে। অথচ ওয়াশিংটন নিজেই ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল ইউরোপে পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বর্ধিত বাণিজ্য এবং আইএনএসটিসির ওপর ফোকাস এটাই প্রমাণ করে যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি অবশেষে উন্নত দেশগুলির তৈরি কাঠামোর আধিপত্য ভেঙে ফেলছে।

অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির পরিচালক ভেলিনা চাকারোভা বলেছেন, ওয়াশিংটন ভারতকে কতটা চাপ দিতে পারে তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে।

২০২২ সালে শর্মা বলেছিলেন, চ্যালেঞ্জ অনেক। রাশিয়া ও ইরানের উপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে আইএনএসটিসিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ডেভনশায়ার এলিস বলেছিলেন, আইএনএসটিসি শুধু রাশিয়া, ভারত ও ইরানের জন্য নয়, অন্যান্য দেশের জন্যও এটি অগ্রাধিকার। একটি 'মধ্য করিডোর' যা জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান ও তুরস্ক এ আইএনএসটিসির সুবিধা পেতে মুখিয়ে আছে।

ইরান একটি ৭০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করছে, যা ইরানের জাহেদান বন্দরকে ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করবে। ফলে আইএনএসটিসির আকর্ষণ বেড়ে যাবে। চুক্তিতে আসতে দুই দেশের ছয় বছর সময় লেগেছে। চুক্তির আগেই, গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ভারতকে সতর্ক করেছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কেউ ইরানের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তির কথা ভাবলে তাদের নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।’  বলাই বাহুল্য, এই হুমকি কাজে লাগেনি। নিষেধাজ্ঞা দিলে শুধু অপরের নয়, নিজেরও কিছু সমস্যা তৈরি হয়।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন