ইসরায়েলের ব্যর্থ কৌশলে বাড়ছে শক্তি
জিতে যাচ্ছে হামাস
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় ইসরায়েলের ৯ মাসের আকাশ ও স্থল অভিযান হামাসকে না পরাজিত করতে পেরেছে, না সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিতে পেরেছে। উল্টো অনেক দিক বিবেচনায়, ৭ অক্টোবরের তুলনা আজকের হামাস আরও বেশি শক্তিশালী। খবর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের।
গত অক্টোবরে হামাসের আক্রমণের পর প্রায় ৪০ হাজার ইসরায়েলি সেনা উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় অভিযান শুরু করে। এই অভিযান গাজার ৮০ শতাংশ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, ৩৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী ৭০ হাজার টনের বেশি বোমা ফেলেছে গাজায়। যা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় লন্ডন, ড্রেসডেন এবং হামবুর্গে ফেলা বোমার চেয়ে বেশি। ইসরায়েল বাহিনী বোমা মেরে গাজার অর্ধেকের বেশি ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া তারা পানি, খাবার ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করেছে যা গাজার পুরো বাসিন্দাদের দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
যদিও অনেক পর্যবেক্ষক ইসরায়েলি এই আচরণের অনৈতিকতা তুলে ধরছেন। তবে ইসরায়েলি নেতারা বারবার বলছেন তাদের উদ্দেশ্য হলো হামাসকে পরাজিত করা এবং গোষ্ঠীটিকে দুর্বল করে ফেলা। যেন তারা বেসামরিক ইসরায়েলিদের ওপর নতুন করে আর আক্রমণ চালাতে না পারে। তবে তাদের কাছে ফিলিস্তিনিদের জীবনও অগ্রাধিকার পায় দাবি। এটা অবশ্য ঠিক, হামাসের শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য গাজার বাসিন্দারা যে শাস্তি ভোগ করছে তা মেনে নিতে হবে। ইসরায়েলি আক্রমণকে ধন্যবাদ। কারণ তাদের আক্রমণ প্রকৃতপক্ষে হামাসের শক্তি বাড়িয়েছে। হামাস এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছে। ভিয়েতনামে ১৯৬৬-৬৭ সালে যেমন কৌশলে ভুল করেছিল আমেরিকা, ইসরায়েলও ফিলিস্তিনে কৌশলে ভুল করছে। তারা ভাবছে সামরিক শক্তি দিয়েই হামাসকে পরাজিত করবে। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ব্যবহারের ভুল কৌশলই তাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। কারণ হামাসের শক্তির উৎস কি তা বুঝতে না পারায় ইসরায়েলের সামরিক কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে। ইসরায়েল এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ যে গাজায় তাদের বিধ্বংসী আরচরণ কেবল তাদের শত্রুদের শক্তিশালী করবে।
মাথা গোনার ভুল ধারণা
কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের সরকার এবং বিশ্লেষকরা কেবল অভিযানে কতজন হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছন তা গুণছেন। তাদের ধারণা ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) অভিযানে কতজন হামাস যোদ্ধা নিহত হলো তাতেই যেন গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে চালানো অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ সফলতা। এটা সত্য যে, হামাসের অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল বলছে, যুদ্ধের আগে হামাসের ৩০-৪০ সদস্য ছিল। যুদ্ধে অন্তত ১৪ হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন। আর হামাস জোর দিয়ে বলছে তাদের ৬-৮ হাজার সদস্য নিহত হয়েছে। আবার মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রকৃত নিহতের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার হবে। তবে এই সংখ্যায় জোর দেওয়া দিয়ে সত্যিকারে হামাসের শক্তি মূল্যায়ন কঠিন। সদস্য হারানোর পরও এককভাব গাজার বৃহৎ অংশ হামাসের নিয়ন্ত্রণে আছে।
সম্প্রতি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই যুদ্ধের মূল্যয়ন করেছে দেশটি। সেই অনুযায়ী, গাজার উত্তরাঞ্চলে হামাসের এখন আরও বেশি যোদ্ধা রয়েছে। যে অঞ্চলটি আইডিএফ কয়েকশ সেনা হারিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল।
হামাস এখন গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছে, যার মধ্যে অতর্কিত হামলা এবং ইম্প্রোভাইজড বোমা (বেশিরভাগই আইডিএফ অবিস্ফোরিত অস্ত্র বা বন্দি হওয়া সেনার কাছ থেকে নেওয়া অস্ত্রে তৈরি) হামলা, সুরক্ষিত হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, হামাসের এসব হামলা অন্তত ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। হামাস এখনো ইসরায়েলে আঘাত করতে পারে; হামাসের সম্ভবত প্রায় ১৫ হাজার সংগঠিত যোদ্ধা রয়েছে। যা ৭ অক্টোবরের হামলা চালানো যোদ্ধার সংখ্যার প্রায় দশগুণ। এছাড়া হামাসের ভূগর্ভস্থ টানেল নেটওয়ার্কের ৮০ শতাংশেরও বেশি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানকার সংরক্ষিত অস্ত্রও ইসরায়েলি নজরদারি এড়াতে সক্ষম। আর গাজায় হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের বেশিরভাগই অক্ষত আছে। শক্তির উৎস
হামাসের মতো একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষমতা সাধারণ কোনো উপাদান থেকে আসে না, যা বিশ্লেষকরা রাষ্ট্রের শক্তি বিচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় শক্তির বিচারের ক্ষেত্রে তাদের অর্থনীতির আকার, তাদের সামরিক বাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা, তারা কতটা বাইরের সমর্থন পাবে এবং তাদের শিক্ষাও হিসাবে রাখতে হয়। কিন্তু হামাস বা অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো তাদের নিয়োগের ক্ষমতা। বিশেষ করে গোষ্ঠীর নেতাদের নতুন প্রজন্মের যোদ্ধা এবং কর্মীদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতাই প্রধান। কারণ এই রাস্তায় প্রাণ হারানো খুব শঙ্কা থাকে।
হৃদয় এবং মন
এই নানান উপাদানই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হামাসের টিকে থাকার শক্তিকে সহায়তা করে। গোষ্ঠীটির প্রকৃত শক্তি মূল্যায়ন করতে, বিশ্লেষকদের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এর সমর্থনের বিভিন্ন মাত্রাকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় এর জনপ্রিয়তা, ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামাসের সহিংসতাকে ফিলিস্তিনিরা কতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে এবং গাজায় চলমান ইসরায়েলি আক্রমণে কতজন ফিলিস্তিনি পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। বস্তুগত বিষয়গুলির চেয়েও এই কারণগুলিই দীর্ঘ লড়াই পরিচালনার জন্য হামাসের শক্তির সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয়।
ফিলিস্তিনিরা হামাসকে কতটা সমর্থন করে তার জন্য সমীক্ষার দিকে চোখ ফেলা যেতে পারে। ৭ অক্টোবরের পর যদিও গাজায় সমীক্ষা চালানো কঠিন, তারপরও প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ (পিএসআর) সংস্থাটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে মিলে ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচটি সমীক্ষা চালিয়েছে। সর্বশেষ সমীক্ষাটি এই জুনে সম্পন্ন হয়েছে। সমীক্ষা ইসরায়েলিদের জন্য কঠিন সত্য সামনে নিয়ে আসে। সমীক্ষায় দেখা যায় ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় আজকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের সমর্থন বেশি রয়েছে।
কঠিন বাস্তবতা
দীর্ঘ ৯ মাস গেরিলা যুদ্ধের পর এখন সময় এসেছে কঠিন বাস্তবতা মেনে নেওয়ার। হামসাকে পরাজিত করার একক কোনো সামরিক সমাধান ইসরায়েলের কাছে নেই। বর্তমানে সংখ্যায় হামাসের সদস্য সংখ্যা যত গোষ্ঠীটি এর চেয়ে বেশি কিছু। হামাস খুব আনন্দদায়ক কোনো ধারণার চেয়ে বেশি কিছু। আসলে হামাস হলো গভীরে সহিংসতা ধারণ করা একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং এটি খুব সহজেই হারিয়ে যাবে না।
ইসরায়েলের নৃশংস সামরিক অভিযানের কৌশল হয়তো কিছু হামাস সদস্যকে হত্যা করতে পারে। তবে এই কৌশল কেবল হামাসের সঙ্গে স্থানীয়দের বন্ধন আরও দৃঢ় করছে। গত ৯ মাসের অবিরাম সামরিক অভিযানে ইসরায়েল তার উদ্দেশ্যের দিকে খুব একটা এগোতে পারেনি। কিন্তু হামাস পরাজিত হয়নি, শুধু তাই নয় তাদেরকে পরাজয়ের কাছাকাছিও পাঠানো যায়নি। বরং ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় এখন আরও বেশি জনপ্রিয় এবং আরও বেশি আবেদন তৈরি করেছে হামাস। ইসরায়েলি নেতাদের ৭ অক্টোবরের আগে গাজা নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল, এখন সেটা নেই। এতে গাজাবাসীর আরও দুঃখ বাড়বে সত্য। যুদ্ধ চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে—আরও ফিলিস্তিনিও নিহত হবে। আর তা-ই ইসরায়েলের প্রতি হুমকি আরও বাড়াতে থাকবে।