কিভাবে মোদির বজ্রমুষ্ঠি ঢিলা হয়ে গেল
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৪, ১০:৩৯ এএম
৪ জুন, যেদিন ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, উত্তর ভারতের ফৈজাবাদের সংসদীয় আসনের ফলাফলের চেয়ে বেশি প্রতীকী আর কিছুই হতে পারে না।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, মোদি একই জমিতে নতুন রাম মন্দিরের উচ্চ-প্রচারিত অভিষেক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন যেখানে ১৯৯২ সালে ১৬ শতকের বাবরি মসজিদটি ধ্বংসের আগে দাঁড়িয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আশা করেছিল, মন্দিরটি দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গর্বের একটি নতুন যুগের সূচনা করবে এবং ভারতের নেতৃত্বে দলের জন্য তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করবে।
ভগবান রাম বিজেপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মাসকট। এটি উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যা শহরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং একই জায়গায় একটি রাম মন্দিরের ‘পুনর্নির্মাণের’ দাবিতে একটি আন্দোলন করেছিল যা ১৯৯০-এর দশকে বিজেপির দেশব্যাপী উত্থানের সূত্রপাত করেছিল।
কিন্তু ৪ জুন প্রকাশ করেছে যে, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহুল আলোচিত মন্দির উদ্বোধনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসহ ভোটারদের প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিজেপি অযোধ্যাকে ঘিরে ফৈজাবাদ সংসদীয় আসন হারিয়েছে। ফৈজাবাদের জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশই হিন্দু।
এই প্রবণতা এটাই বোঝায় যে, অপ্রত্যাশিতভাবে মোদির দল ভারতের লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ৫৪৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির সংখ্যা ২৪০-এ দাঁড়িয়েছে, যা ২৭২-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হিসাবের কম।
যেহেতু বিজেপির মিত্ররা আরও ৪৪টি আসন জিতেছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) এখনও একটি সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
২০১৪ সালে বিজেপি নিজেই ২৮২টি আসন জিতেছিল, এবং এনডিএর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৩৬-এ। তারা ২০১৯ সালে এই সংখ্যায় আরও ভাল করেছিল যখন বিজেপি একা ৩০৩টি আসন জিতেছিল এবং তার মিত্ররা আরও ৫০টি যোগ করেছিল।
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে এই ফলাফলকে মোদির বিরুদ্ধে একটি ‘ম্যান্ডেট’ বলে বর্ণনা করেছেন। ‘এটি তার রাজনৈতিক এবং নৈতিক পরাজয়,’ খড়গে বলেছিলেন, ‘বিজেপি একজন ব্যক্তির নামে, একটি মুখের নামে ভোট চেয়েছিল।’
কংগ্রেস ৯৯টি আসন জিতেছে, যা তার ২০১৪ সালের ৪৪টি আসন এবং ২০১৯ সালের ৫২টি আসন থেকে একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি। এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট যাকে জনপ্রিয়ভাবে ইন্ডিয়া ব্লক বলা হয়, ২৩০টি আসন পেয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন বিজেপির এই অবনতি? মোদির বজ্রমুষ্ঠি কি ঢিলা হয়ে গেছে? কেন?
‘৪ জুনের রায় ভারতের জনগণের বিজয়ের ইঙ্গিত দেয়। তারা মোদিকে একটি পাঠ শিখিয়েছে,’ বলেছেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উপর একাধিক বইয়ের লেখক। তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘নরেন্দ্র মোদী : দ্য ম্যান, টাইমস’।
তিনি এই নির্বাচনের ফলাফলকে একটি ‘সংশোধনমূলক রায়’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এই ফলাফলকে একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যান হিসাবে দেখছেন যেখানে সরকার এক ব্যক্তির সমর্থক।
তিনি বলেন, ‘রায় দেখায় যে, জনগণ মেগালোম্যানিয়াক দ্বারা শাসিত হতে চায় না, বরং একটি যৌথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হতে চায়। এটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রত্যাখ্যান এবং ১৯৭৭ সালের রায়ের সাথে তুলনীয়।’
১৯৭৭ সালে মানুষ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, যার কারণ ছিল তার ২১ মাসের স্বৈরাচারী শাসন, যে সময় জরুরি অবস্থার বিধানের অধীনে তিনি সমস্ত ভিন্নমতকে চূর্ণ করে দিয়েছিলেন।
নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) সহ-পরিচালক অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার মনে করেন, ‘ভারত একটি বিভক্ত রায় দিয়েছে।’ হয়ত এই বিভক্তি যুক্তিসংগত, যা মোদিকে দুর্বল করতে চেয়েছে।
অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘কোনো প্যান-ইন্ডিয়া আখ্যান নেই। বিজেপি এমন রাজ্যগুলিতে ভুগেছে যেখানে তারা গত ১০ বছর ধরে আধিপত্য বজায় রেখেছিল। সেই রাজ্যগুলিতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যেখানে তারা কখনও ক্ষমতায় ছিল না।’ কুমার বলতে চেয়েছেন, মোদির দল যেখানে শাসন করেছে, সেখানে যেমন শাসন মানুষ দেখেছে তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিজেপির শাসনের বিরুদ্ধে গেছে তাদের অন্ধ জাতীয়তাবাদ।
মোদির ব্যক্তিত্বের ধর্ম গত এক দশক ধরে বিজেপির মূল কৌশল এবং সম্পদ। ২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে মোদি এমনকি দাবি করেছিলেন যে, তার জন্ম জৈবিক নয়, ঈশ্বর তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাঠিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলি এই ব্যক্তিত্বের ধর্মকে কঠোরভাবে আঘাত করেছে।
উত্তর ভারতের বারাণসী কেন্দ্র থেকে মোদির জয়ের ব্যবধান ২০১৯ সালের ৪ লাখ ৮০ হাজার ভোট থেকে এবার দেড় লাখে নেমে এসেছে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি সাহিত্যের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার অপূর্বানন্দ বলেছেন, ভারতীয় গণতন্ত্র বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের দেখেছে, যেমন জওহরলাল নেহেরু এবং রাজীব গান্ধী, যাদের সংসদীয় শক্তি ৪০০টির বেশি আসন ছিল এবং ইন্দিরা গান্ধীর ৩৫০টির বেশি আসন ছিল।
অপূর্বানন্দ বলছেন, ‘তবে ভারতীয় গণতন্ত্রে এর আগে কখনও একজন নেতা নিজেকে ঈশ্বরের প্রেরিত ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেননি। শক্তিশালী নেতাদের স্মৃতি আছে এমন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যে প্রশিক্ষিত লোকদের কাছে মোদির দম্ভ অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।’
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অজয় গুদাবর্তি। তার মতে, ‘বিজেপির ক্ষতিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, কারণ বিজেপি অর্থ এবং মিডিয়া ব্যবহার করে কারসাজির ক্ষমতা রাখে।’
‘পলিটিক্স, এথিক্স অ্যান্ড ইমোশনস ইন নিউ ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক গুদাবত্যি বলেন, ‘মানুষ প্রমাণ করেছে, ভারত একটি শক্তিশালী সাধারণ জ্ঞান দ্বারা চালিত হচ্ছে। এমন কিছু যা ফৈজাবাদের পরাজয় প্রতিফলিত করে।’
(দি ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ)
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, ভারতের অতি-বাম এবং হিন্দু রাইট বিষয়ক দুটি নন-ফিকশন বইয়ের লেখক। ভারতের রাজনীতি, পরিবেশ, মানবাধিকার এবং সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন।