ছবি: সংগৃহীত
৪ জুন ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে নরেন্দ্র মোদির দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তবে এবারের ফলাফলে উত্তর ভারতের ফৈজাবাদের সংসদীয় আসনের ফলের চেয়ে বেশি প্রতীকী বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই আসনের জমিতেই নতুন রাম মন্দিরের (রাম মন্দির) আলো-জ্বলমলে উদ্বোধনের নেতৃত্ব দেন মোদি। ১৬ শতকের বাবরি মসজিদটি ১৯৯২ সালে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আশা করেছিল নবনির্মিত মন্দির দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গর্বের নতুন যুগের সূচনা করবে এবং ভারতের শাসনে বিজেপির তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করবে।
রাম হলো বিজেপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মাসকট। উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যা শহরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং একই জায়গায় একটি রাম মন্দির ‘পুনর্নির্মাণের’ দাবির আন্দোলন ১৯৯০ এর দশকে বিজেপির দেশব্যাপী উত্থানের সূত্রপাত করেছিল। কিন্তু ৪ জুন প্রকাশিত ভোটের ফলে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহুল আলোচিত মন্দির উদ্বোধন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসহ ভোটারদের টানতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই সামনে নিয় এসেছে।
অযোধ্যা নিয়ে গঠিত ফৈজাবাদ সংসদীয় আসনে বিজেপি ফেল করেছে। আরও মজার ব্যাপার হলো, ফৈজাবাদের জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশই হিন্দু। আর এটিই ফলাফলে আসল প্রবণতা তুলে ধরে, যেখানে প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে মোদির দল লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ৫৪৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন। সরকার গঠন যেখানে দরকার ২৭২টি আসন।
তবে বিজেপির এনডিএ’র শরিকরা আরও ৪৪টি আসন জেতায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) এখন সরকার গঠন করছে। অথচ ২০১৪ সালে বিজেপি এককভাবেই ২৮২টি আসন জিতেছিল। সেবার তাদের জোটের মোট আসন ছিল ৩৩৬টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে আরও ভালো করেছিল বিজেপি। সেবার দলটি এককভাবে পেয়েছিল ৩০৩টি আসন। তার মিত্ররা পেয়েছিল আরও ৫০টি আসন। যদিও এবার মোদি বলেছিলেন, বিজেপি পাবে ৩৭০টি আসন এবং জোটের মোট আসন হবে ৪০০।
এই নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেস ৯৯টি আসনে জিতেছে। দলটি ২০১৪ সালে ৪৪টি এবং ২০১৯ সালে মাত্র ৫২টি আসন জিতেছিল। সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের জোট ইন্ডিয়া পেয়েছে ২৩২টি আসন।
এক গুরুত্বপূর্ণ জনরায়
হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং মোদির উপর লেখা একাধিক বইয়ের (একটি বই- নরেন্দ্র মোদি: দ্য ম্যান, টাইমস) লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘৪ জুনের জনরায় ভারতের জনগণের এক বড় বিজয়। তারা মোদিকে একটি শিক্ষা দিয়েছেন।’
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় এই জনরায়কে ‘সংশোধনমূলক’ হিসেবে বর্ণনা দিয়েছেন এবং একে ব্যাপক বয়ান এবং অতিরঞ্জিত দাবি দিয়ে প্রভাবিত নয় বলেও উল্লেখ করেছেন। তিনি এই জনরায়কে প্রচন্ড কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখছেন, যেখানে সরকার আর এক ব্যক্তি সমার্থক ছিল।
তিনি বলেন, এই ফল এটাই প্রমাণ করে যে, ভারতের জনগণ একক কোনো ব্যক্তির দ্বারা শাসন চান না, তার যৌথ শাসন চান। এই ফল কর্তৃত্ববাদী শাসনকে প্রত্যাখ্যান এবং ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে তুলনীয়। ১৯৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার ২১ মাসের স্বৈরাচারী শাসনের পরে জরুরি অবস্থার বিধানের অধীনে হওয়া নির্বাচনে ভোট দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল ভোটাররা।
নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) গবেষণা প্রোগ্রাম লোকনীতির সহ-পরিচালক এবং অধ্যাপক সঞ্জয় কুমারের মতে, নির্বাচনে ভারত বিভক্ত রায় দিয়েছে।
তিনি বলেন, এই ফলে ভারতজুড়ে বিজয়ের কোনো আখ্যান নেই। বিজেপি এমন রাজ্যগুলিতে বিপর্যস্ত হয়েছে যেখানে গত ১০ বছর ধরে আধিপত্য ধরে রেখেছিল। আবার এমন রাজ্যগুলিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে যেখানে তারা কখনও ক্ষমতায় ছিল না। বিজেপি সাধারণত যেখানে আসন পায় তার বাইরে নিজেদের প্রসারিত করার ক্ষমতা দলটিকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
মোদির ব্যক্তিত্বের কাল্টই এক দশক ধরে বিজেপির মূল কৌশল হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে মোদি এও দাবি করেছিলেন, তার জন্ম জৈবিক নয়—ঈশ্বর তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাঠিয়েছিলেন। অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলি এই ব্যক্তিত্বের কাল্টকেই কঠোরভাবে আঘাত করেছে।
উল্লেখ্য, উত্তর ভারতের বারাণসী আসনে মোদির জয়ের ব্যবধান ২০১৯ সালের ৪ লাখ ৮০ হাজার ভোট থেকে এবার ১ লাখ ৫০ হাজারে নেমে এসেছে।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অজয় গুদাবর্তির মতে, অর্থ ও মিডিয়া ব্যবহার করে বিজেপির কারসাজির ক্ষমতা সত্ত্বেও দলটির এই পরিণতিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।
একটি উল্লেখযোগ্য নির্বাচন
ভারতের সবচেয়ে বেশি হিন্দি ভাষাভাষি অঞ্চল বা হিন্দি ভাষার দুর্গে বিজেপির হার আগেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ অনুমান করেছিলেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য মহারাষ্ট্রে মোদির দলের জন্য ধাক্কাও অনুমিতই ছিল।
হিন্দি ভাষাভাষি দুর্গগুলোই ২০১৪ সালে মোদিকে ক্ষমতায় আনে। এসব অঞ্চল থেকেই ২২৮টি সংসদীয় আসন পেয়েছিল বিজেপি জোট। এসব অঞ্চলেই ধর্মীয় বিষয়গুলি ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আবেদন তৈরি করেছিল।
এবার উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা এবং দিল্লির হিন্দি ভাষাভাষি দুর্গ থেকে বিজেপির আসন সংখ্যা ১৩৫ এ নেমে এসেছে। আর দলটির মিত্ররা পেয়েছে আরও ২০টি আসন। তিন দশকের পুরনো রাম মন্দির আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল উত্তরপ্রদেশ থেকেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে।
উত্তরপ্রদেশ হলো ভারতের বৃহত্তম রাজ্য যেখানে ৮০টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এখানকার বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী গেড়ুয়া পোষাক পরেন এবং সন্ন্যাসী থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তারপরও বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩৩টি আসন। এর সহযোগীরা জিতেছে আরও তিনটি। কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৪৩টি আসন। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপি এই রাজ্যে পেয়েছিল যথাক্রমে ৭২ এবং ৬৩টি আসন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার অপূর্বানন্দ বলেন, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে তার ছাত্ররা গত বছর থেকে তাকে বলছিল, এই রাজ্যের যুবকরা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হিন্দু যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহারে বিরক্ত।
তিনি বলেন, উত্তর প্রদেশের যুবকরা বুঝতে পেরেছে বিজেপি হিন্দু জাতির ইউটোপিয়া ব্যবহার করে দরকারি ইস্যু যেমন কর্মসংস্থান এবং সম্পদ তৈরির সুযোগ তৈরিতে নিজেদের অযোগ্যতা আড়াল করছে।
৪৮ সংসদীয় আসনের রাজ্য মহারাষ্ট্র হলো ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এখানেও বড় ধাক্কা খায়। এই রাজ্যে এনডিএ জোট ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪১টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু জোটের অংশীদার পরিবর্তন, পরবর্তীতে দুটি আঞ্চলিক বিরোধী দলে বিভক্তি, বিরোধী নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের পতনের কারণে ২০১৯ সালের শেষ থেকে রাজনৈতিক সমীকরণগুলি ব্যাপক বদলে যায়।
মহারাষ্ট্রে অর্থ এবং সরকারি সংস্থাগুলি ব্যবহার করে বিভক্তি তৈরির জন্য বিজেপিকে দোষারোপ করেছে বিরোধী দলগুলি। শেষ পর্যন্ত রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা আগেরবারের চেয়ে কমে ৯ এসে দাঁড়ায়। তার সহযোগীরা আরও আটটিতে জিতেছে। কংগ্রেস এবং তার সহযোগীরা মহারাষ্ট্রে ৩০টি আসন পেয়েছে।
এই ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, মহারাষ্ট্রের জনরায় থেকে বুঝা যায়, ভোটাররা একটি সীমা পর্যন্ত নৈতিকতার ব্যাঘাতকে সহ্য করে। এরপর আর তা সহ্য করে না।
এপ্রিলের প্রথম দিকে নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করেছিলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচন ২০১৪ এবং ২০১৯ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন হবে। কারণ উপরিতলে অন্তত ‘মোদি ঢেউ’ উপস্থিত ছিল না। তবে সমগ্র ভারতে ক্ষমতাসীন বিরোধী কোনো আলোড়ন দৃশ্যমান ছিল না। আর এই জন্যই কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষককে ভাবিয়েছিল যে, ম্যান্ডেট হয়তো শেষ পর্যন্ত বিজেপির দিকেই যাবে।
সম্প্রসারণ এবং জোট
বিজেপি ভারতের চারটি বৃহত্তম রাজ্যে আঞ্চলিক শক্তির কাছে হেরেছে। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ২৯টি আসন, মহারাষ্ট্রে ১৪টি আসন, পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি এবং বিহারে পাঁচটি আসন হারিয়েছে। মাঝারি আকারের রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্থানে ১১টি এবং কর্ণাটকে ৮টি আসন হারিয়েছে।
এদিকে, পূর্বাঞ্চলীয় ওড়িশা রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা ১২টি বেড়েছে। তেলঙ্গানায় চারটি, অন্ধ্রপ্রদেশে তিনটি এবং দক্ষিণে কেরালায় একটি আসনে জিতেছে দলটি। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিজেপির প্রচারের কৌশল উত্তরের থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা ছিল।
অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, বিজেপি সরকারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি, ভারতের বৈশ্বিক অর্জন এবং কীভাবে ভারত একটি বড় বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তা নিয়ে বেশি প্রচারণা চালাচ্ছিল। তারা জানত মন্দিরের অনুভূতি দক্ষিণে কাজ করে না।
এই নির্বাচনে বিজেপি বিরোধীরা এক অনন্য কৌশল নিয়েছে। তারা ইন্ডিয়া নামে জাতীয় স্তরে জোটবদ্ধ হয়েছিল। তবে রাজ্য ভিত্তিক ভোটের হিসাব করে তারা একে অপরের সঙ্গেও লড়াই করেছে তারা।
কংগ্রেস দক্ষিণে কেরালায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আবার জোটের আরেক সদস্য পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) বিরুদ্ধে লড়তে সেখানে কমিউনিস্টদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল।
দিল্লি ও পাঞ্জাবে শাসন করা আম আদমি পার্টির (এএপি) সঙ্গে কংগ্রেস দিল্লি, হরিয়ানা এবং গুজরাটে জোট করেছিল। কিন্তু পাঞ্জাবে দল দুটি একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে।
বিরোধী দলগুলির ধারণা ছিল, বিজেপি ক্ষমতায় নেই এমন রাজ্যগুলিতে একে অপরের সঙ্গে লড়াই বিজেপিকে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি আসন হারিয়েছে এবং কেরালা ও পাঞ্জাবেও তেমন ভালো ফল করতে পারেনি।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল রাজস্থানের বাঁশওয়ারা থেকে মোদি মুসলিম বিরোধী বক্তৃতা দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন। যা ৩০ মে নির্বাচনী প্রচারের শেষ অবধি অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু ফল গণনায় দেখা যায়, বাঁশওয়ারায় তার দলীয় প্রার্থী লজ্জাজনকভাবে হারে। বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে বিজেপির প্রাথী ১৫ শতাংশ কম ভোট পেয়েছে।
(দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে ভাষান্তরিত)