ছয় বছরে যুক্ত হয়েছে নতুন ২ লাখ রোহিঙ্গা
প্রকৃত সংখ্যা এখন কত?
বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের যাদের দেশ মিয়ানমার হলেও বেশির ভাগই বসবাস করে বাংলাদেশে। তারা প্রধানত দেশটির রাখাইন রাজ্যে বাস করে। সেখানে তারা কয়েক দশক ধরে রাখাইন বৌদ্ধদের সাথে অসহায়ভাবে সহাবস্থান করে আসছে।
কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে প্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করছে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের জনগণের সাথে তাদের কালো চামড়া ও ভাষাগত মিলের কারণে অবমাননাকরভাবে বাঙালি বলে উল্লেখ করছে।
কিন্তু, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটেনের কাছ থেকে মিয়ানমার স্বাধীনতা পাওয়ারও আগে থেকে, কয়েকশ বছর ধরে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ, ভারত ও আরবদের সঙ্গে আরাকানের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল। সেই ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। সেই হিসেবে রোহিঙ্গাদের একটি একটি রয়েছে।
সব সত্য উপেক্ষা করে ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন শুরু করে এবং ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে মিয়ানমার সরকার তাদের রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে।
রোহিঙ্গা জনগণের চলাফেরার স্বাধীনতা, চিকিৎসা সহায়তা, শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক পরিষেবার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
গল্পের পটভূমি
কয়েক দশক ধরে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘন ঘন সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। তারপর ১৯৭৮ সালে প্রায় দুই লাখ এবং তারপর বছর দশেকের মধ্যে আরো আড়াই লাখ রোহিঙ্গা সামরিক অভিযানে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসে। পরে অনেকে ফিরে গেলেও বাংলাদেশে শরণার্থী শিবির স্থাপিত হওয়ায় অনেকে সেখানে থাকাকেই সুবিধাজনক মনে করে।
২০১৬ সালের অক্টোবর মিয়ানমারের ৯ জন পুলিশ অফিসার সশস্ত্র হামলায় নিহত হয়। এরপর শুরু হয় ভয়ানক সামরিক অভিযান। সহিংসতার মধ্যে প্রথম দফায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তারপর মিয়ানমার আরো অভিযান চালায়।
সে সময় জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছিলেন যে, ‘মিয়ানমার সরকার দেশটিকে মুসলমানমুক্ত করতে চাইছে। এমন একটি অভিযোগ যা মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি বারবার করেছে।’
সামরিক অভিযান ২০১৭ সালেও অব্যাহত থাকে, যা গণহত্যায় রূপ নেয়। এবার আর হাজারে হাজারে নয়, লাখে লাখে রোঙ্গিারা পালিয়ে আসে। সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। সে সময় তাদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশিতে দাঁড়ায়। আর রাখাইনে এখনও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তাছাড়া অন্য বিভিন্ন দেশে আছে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। তবে ২০১৭ সালের পর কক্সবাজারের শিবিরগুলিতে জন্ম নেওয়া শিশুরা সেই হিসাবের বাইরে। রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে যে, অধিক হারে জন্ম না দিলে তারা জাতিগতভাবে নির্মূল হয়ে যাবে।
সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ২০১৭ সালে
জাতিসংঘের হিসাবমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হয়, যখন জঙ্গিরা সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। জবাবে রাখাইন মিলিশিয়া দ্বারা সমর্থিত নিরাপত্তা বাহিনী একটি ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে যা কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে এবং সাত লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
মিয়ানমার দাবি করেছে, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে থাকা ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) আক্রমণের জবাবে মিয়ানমার এই অভিযান চালিয়েছে।
যদিও ২০১৭ সালের অনেক আগে থেকেই মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও তাদের বহিষ্কারের পরিকল্পনা করেছে, যার নথি কয়েক বছর আগে থেকে প্রকাশ করেছে অলাভজনক সংস্থা আইজেএ (ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি)।
সে বছর গণহত্যা, ধর্ষণ ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যামূলক প্রচারণার অংশ হিসাবে নির্ধারণ করেছিল এবং মিয়ানমার বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা এখন কোথায়
রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই এখন বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। কয়েক দফা সহিংসতার সময় পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে এসব শিবিরে। গত বৃহস্পতিবার কারিতাস ইন্টারন্যাশনালিস ঢাকা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে। সেখানে তারা জানায়, গত ছয় বছরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দুই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য কয়েকবার চেষ্টা করলেও মিয়ানমার আগ্রহ দেখায়নি।
ওদিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের শিবিরজীবন অস্বস্তিকর করে তুলেছে। কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করেছে যা রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমাবদ্ধ করেছে। তাদের শিক্ষা ও কাজের ওপরও শক্ত সীমাবদ্ধতা স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। বহুবধি কারণে বাংলাদেশকে এটা করতে হয়েছে। না করলে তা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান