লোকসভা নির্বাচন-২০২৪
ইসলামবিদ্বেষী বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে বিজেপি
ছবি বুম ডট ইন্ডিয়া
ভারতের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন চলছে। চলমান এ নির্বাচনের মাঝখানেই দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বিজ্ঞাপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। সবগুলো রাজনৈতিক দলই কমবেশি বিজ্ঞাপনে ব্যয় করছে। তবে এসব বিজ্ঞাপন দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে দেশটির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
দলটি বিজ্ঞাপন দিয়ে ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্য হলো মুসলিমরা। অর্থাৎ ইসলামবিদ্বেষী বিজ্ঞাপনেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছে বিজেপি। যেসব ভাড়া করা ফেসবুক পেজ বিজেপি বিরোধীদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন কনটেন্ট পোস্ট করছে সেগুলোতে ইসলামবিদ্বেষী ভাষা ও মিম পাওয়া গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ফ্যাক্ট চেক সংস্থা বুমলাইভ ডট ইন্ডিয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান মেটার অ্যাড লাইব্রেরির চলতি বছরের এপ্রিলের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিজেপি বিভিন্ন পেজ থেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেছে ১০ কোটি রুপির উপরে। আর কংগ্রেস ব্যয় করেছে ৬ দশমিক ৫ কোটি রুপি। কোটির ঘর পেরোনো অন্য দুটি দল হলো তামিল নাড়ুর দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (ডিএমকে) ও ওড়িশার বিজু জনতা দল (বিজেডি)। দল দুটি বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেছে যথাক্রমে ২ দশমিক ৮ কোটি ও ১ দশমিক ২ কোটি রুপি।
এদিকে পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) এবং অন্ধ্র প্রদেশের যুবজন শ্রমিক রাইথু কংগ্রেস পার্টিও (ওয়াইএসআরসিপি) গত মাসে বিজ্ঞাপনে প্রায় এক কোটি রুপির কাছাকাছি খরচ করেছে। দল দুটি যথাক্রমে ৮৭ লাখ এবং ৮২ লাখ রুপি ব্যয় করেছে। অবশ্যই গুগল বিজ্ঞাপনে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যয় আরও বেশি ছিল।
গুগলে অ্যাড ট্রান্সপারেন্সি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতি বিজ্ঞাপনে ২৬ দশমিক ৬ কোটি রুপি ব্যয় করে শীর্ষে আছে ভারতীয় কংগ্রেস। অন্যদিকে গুগলে বিজেপি ব্যয় করেছে ২১ দশমিক ৩ কোটি রুপি। আর ডিএমকে’র ব্যয় হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ কোটি রুপি। অন্য যেসব দল কোটির ঘর পেরিয়েছে সেগুলো আঞ্চলিক দল। যেমন ওয়াইএসআরসিপি ব্যয় করেছে ৫ দশমিক ০৩ কোটি, টিডিপি ব্যয় করেছ ২ দশমিক ২৯ কোটি , বিজেডি ব্যয় করেছে ২ দশমিক ১৪ কোটি এবং রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা আইপিএসি ব্যয় করেছে ১ দশমিক ৭৯ কোটি রুপি।
ফেসবুকে ভাড়া করা পেজে ইসলামবিদ্বেষ
গত মাসে বুমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কীভাবে বিজেপি বিরোধীদের লক্ষ্য করে ফেসবুকে থাকা গোপন পেজগুলো ভাড়ায় খেটেছে। মার্চে ওইসব পেজে বিজ্ঞাপন ব্যয় হয়েছে ৩ দশমিক ৭ কোটি রুপি। আর এপ্রিলে এসে এই ব্যয় দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৪ কোটি রুপির উপরে। ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেজগুলোতে ইসলামবিদ্বেষী কনটেন্টও বেড়েছে।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর মেটার একটি সূত্র বুমকে জানিয়েছে, মার্চে মিমএক্সপ্রেস নামের যে পেজটি ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ১ দশমিক ১ কোটি রুপি ব্যয় করেছিল সেটি ব্যান করে দেওয়া হয়েছে। এর পর পরই মিম হাব নামে তাৎক্ষণিকভাবে খোলা নতুন একটি পেজের সন্ধান পায় বুম। এই পেজটি নতুন খুলেই এপ্রিলে ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ৭২ লাখ রুপি ব্যয় করেছে। যদিও পেজটিতে মাত্র ১১০০ ফলোয়ার এবং ৭৮১ লাইক আছে।
এদিকে, বিজেপির কর্ণাটকের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকে ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়ানোর একটি ঘটনা ভারতজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ওই এক্স হ্যান্ডেল থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করে বলা হয়, কংগ্রেসের সহায়তায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ওবিসি/এসসি/এসটি’র বরাদ্দ মুসলিমদের দেওয়া হচ্ছে। এই পোস্টের পর ৫ মে কর্ণাটক পুলিশ মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্মটিকে নোটিশ পাঠায়। নোটিশে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন লঙ্ঘনের কথা বলে পোস্টটি মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নোটিশে বলা হয় নির্বাচন কমিশনের ৫ তারিখে পাঠানো ই-মেইলের ওপর আপনার আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে ... নির্বাচন কমিশন ইন্টারনেট থেকে বিতর্কিত ওই কনটেন্ট সরানোর নির্দেশ দিয়েছে। কারণ এটি লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ চলাকালে কার্যকর করা মডেল কোড অব কনডাক্ট (এমসিসি) লঙ্ঘন করেছে।
এ ছাড়াও বিজেপির অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রামেও একটি অ্যানিমেটেড ভিডিও পোস্ট করা হয়েছিল, যা মুসলমানদের আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ওই ভিডিওতে বিজেপি তার পুরোনো বয়ান—কংগ্রেস হিন্দুদের সম্পদ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করতে চায় তুলে ধরেছিল। যদিও পরে পোস্টটি মুছে ফেলা হয়।
মিম হাব ও অন্যান্য ভাড়ায় খাটা পেজে প্রচার করা বিজ্ঞাপন থেকে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় যেখানে কংগ্রেসকে হিন্দু বিরোধী এবং মুসলিমপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা বিজেপির অফিসিয়াল পেজ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের বয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। তেমননি একটি বিজ্ঞাপনে ভেন ডায়াগ্রাম এঁকে দেখানো হয়েছে, কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার প্রাথমিকভাবে মুসলিমদের লাভবান করে।
এসব পেজের অনেকগুলোতেই হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ এবং ইসলামবিদ্বেষী বিষয়গুলো বার বার এসেছে এবং বিজেপি বিরোধীদের হিন্দুদের জন্য খারাপ এবং মুসলিমদের জন্য ভালো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পেজগুলোর মাধ্যমে ছড়ানো ঘৃণা উসকানো কনটেন্টে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব এবং বিষয়বস্তু নিয়মিতভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে।
বেশকয়েকটি বিজ্ঞাপনে অন্যান্য সংখ্যালঘু এসসি/এসটি/ওবিসি’র তুলনায় মুসলিমদের প্রতি কংগ্রেসের বাড়তি পক্ষপাত আছে তাও বলা হয়েছে। ফেসবুকে থাকা পলিটিক্যাল এক্স-রে, সিধা চশমা ও আমার সোনার বাংলা পেজগুলোতে এসব বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।
সিধা চশমার মতো প্রায় একই ধরনের পেজ হলো উল্টা চশমা পেজটি। যেটিকে আগেই ভাড়ায় খাটা পেজ হিসেবে বুম শনাক্ত করেছিল। পেজটিতে মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানো কনটেন্ট প্রচার করা হতো। পলিটিক্যাল এক্স-রে, তামিলকাম, কন্নড় সঙ্গম ও সদ্য ডিলিট করা সোনার বাংলা পেজও একই যোগসূত্রে গাঁথা এবং ইসলামবিদ্বেষী কনটেন্ট প্রচার করে। আর এই পেজগুলোতে গত বছরের নভেম্বর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ২ কোটি রুপির বেশি অর্থ ব্যয় করে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে।
আমার সোনার বাংলা পেজ থেকে একটি বিজ্ঞাপনে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মহুয়া মৈত্রীকেও লক্ষ্য করে ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। বিজ্ঞাপনটিতে দাবি করা হয়, যখন সাংবাদিকরা মহুয়ার কাছে জানতে চায় তার সুস্বাস্থ্য ও শক্তির উৎস কি তখন তিনি উত্তর দেন, সেক্স। বুম ফ্যাক্ট চেক করে দেখে, তিনি আসলে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ডিম।
একই পেজ থেকে একটি ইসলামবিদ্বেষী বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, বাঙালি মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। সিধা চশমায় করা এক পোস্টে মুসলিম এবং ‘আব্দুল্লাহ’উল্লেখ করে বলা হয়, কংগ্রেস সংখ্যালঘু ওবিসি/এসটি/এসসি গোষ্ঠীর বরাদ্দ মুসলিমদের দিয়ে দেবে।
মুদ্দে কি বাত নামের অপর একটি পেজ থেকে ছড়ানো এক ভিডিওতে দেখানো হয়, হিন্দুদের মালিকানাধীন সম্পত্তি কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে নিজেদের দাবি করতে বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অভিবাসীরা ভারতে আসছে। একই ভিডিও বিজ্ঞাপন হিসেবে সিধা চশমায়ও প্রচার করা হয়।
অন্যদিকে, হোকাগে মোদী সামা নামে ইনস্টাগ্রাম পেজ থেকে পোস্ট করা এক বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, কংগ্রেস হিন্দুদের অর্ধেক সম্পত্তি মুসলিমদের দিয়ে দিয়েছে। ডিকোডের করা এক তদন্তে দেখা গেছে, ভাড়ায় খাটা বা প্রক্সি এই পেজটি ভারাহে অ্যানালাইটিকস নামের একটি রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা চালায়। বিজেপির হয়ে এই সংস্থাটি ভাড়ায় খাটে।
ভাড়ায় খাটা এসব পেজের ব্যাপারে বুম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান মেটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তবে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।