Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আবারও প্রশ্নের মুখে মোদীর ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগান

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম

আবারও প্রশ্নের মুখে মোদীর ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগান

নারী কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের একাংশ।

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) স্লোগান ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ আরও একবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। চলমান লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-জনতা দল (জেডি, সেক্যুলার) জোট থেকে প্রার্থী করা হয়ে বর্তমান এমপি প্রজ্জ্বল রেভান্নাকে। প্রজ্জ্বল সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গৌড়ার নাতি। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠার পর তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ থেকে পালিয়েও গেছেন। এই নিয়ে চলমান নির্বাচনের মধ্যেই ভারতজুড়ে হইচই পড়ে যায়। এতে ফের প্রশ্ন উঠেছে মোদীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান নিয়েও।  

এদিকে, প্রজ্জ্বলকে রক্ষা করতে এবং পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওযার ঘটনায় বিজেপি কংগ্রেস একে অপরকে দোষারোপ করছে। যদিও কর্ণাটকের ২৮টি আসনের মধ্যে ১৪টি আসনেওর ভোট এখনো বাকি। আগামী ৭ মে এই আসনগুলোতে ভোট হবে। যৌন হয়রানির অভিযোগ সত্ত্বেও জেডির (এস) সঙ্গে থাকা জোট ভাঙেনি বিজেপি। তবে গত মঙ্গলবার প্রজ্জ্বলকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। 

অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশের কাইসারগঞ্জের বর্তমান এমপি ব্রিজ ভূষণ শরন সিংয়ের বিরুদ্ধে রেসলারকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলেও বিজেপি তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ওই আসনে বৃহস্পতিবার ভূষণের ছেলে  করন ভূষণ সিংকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। ব্রিজ ভূষণকে প্রার্থী না করলেও, সম্প্রতি ওই সংসদীয় এলাকায় তাকে নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেখা গেছে।   

এ আগে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হরিয়ানায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগানের সূচনা করেন। এর সাত বছর পর ২০২২ সালের আগস্টে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে লাল কেল্লা থেকে মোদী ‘নারী শক্তি’ ঘোষণা দিয়ে নারীর প্রতি অবজ্ঞা ও অপমানজনক সব ধরনের আচরণের ইতি টানার আহ্বান জানান। 

নিউ ইলেকশন ওয়াচ এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মের (এডিআর) আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান ১৩৪ এমপি ও এমএলএ-এর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বিজেপির সবচেয়ে বেশি ৪৪ এমপি ও এমএলএ রয়েছেন। 

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, মোদী সরকারের আমলে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে এই অপরাধের ঘটনা ছিল ৩৩৭৯২২টি, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪৫২৫৬ টি। 

প্রজ্জ্বল থেকে ব্রিজ ভূষণ, কাঠুয়া ধর্ষণ মামলা, হাতরাস, উন্নাও এবং মণিপুরে যেসব নেতা বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন এবং বিজেপির বেটি বাঁচাও স্লোগানকে চুপসে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।

প্রজ্জ্বল রেভান্না

প্রজ্জ্বল জেডি (এস) দলের নেতা। কর্ণাটকে দলটির সঙ্গে জোটে আছে বিজেপি। চলতি লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে প্রজ্জ্বলের আসন হাসনে ভোট হবে। যদিও তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভিডিওতে তাকে নারীদের যৌন নির্যাতন করতে দেখা যায়। বেশির ভাগ ভিডিও প্রজ্জ্বল নিজেই ধারণ করেছেন এবং জোর করে তিনি তা করেছেন। গত বৃহস্পতিবার দেশটির স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ২৭ এপ্রিল রাত ২টায় ব্যাঙ্গালুরু থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি জার্মানি চলে যান। চলমান লোকসভা নির্বাচনে এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। 

এর আগে ১৪ এপ্রিল মোদীকে প্রজ্জ্বল ও দেব গৌড়ের সঙ্গে মাইসুরের নির্বাচনী প্রচারের এক মঞ্চে দেখা গেছে। বিরোধীদের দিক থেকে ব্যাপক সমালোচনার পর বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, যারা নারী নির্যাতন করে তাদের সঙ্গে বিজেপি থাকবে না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর অনুযায়ী, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব প্রজ্জ্বলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে অবগত আছে। যদিও এখন পর্যন্ত বিজেপি জেডির সঙ্গে জোট ভাঙেনি। 

ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং

শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভারতের রেস্টলিং ফেডারেশনের প্রধান থাকা অবস্থায় নারী রেসলারদের যৌন হয়রানি করেছেন। নারী রেসলাররা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, পেশাগত সুবিধার বিনিময়ে তিনি তাদের কাছ থেকে যৌন সুবিধা চেয়েছিলেন। তিনি তাদের শ্লীলতাহানি, তাদের বুকে হাত দেন এবং অভিযোগ না দিতে ভয় দেখান। রেসলাররা তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ক্ষোভে রেসলাররা তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ অবশ্য কঠোর হস্তে আন্দোলন ধমন করেছে। 

গত ডিসেম্বরে এক সহযোগীকে গাড়িতে করে শরণ সিংয়ের কাছে নেওয়ায় অলেম্পিক মেডেল জয়ী সাক্ষী মালিক খেলা থেকে অবসর নেন। তারপরও শরণ বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে গেছেন। এমনকি লোকসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গাদকারী, অমিত শাহ’র কয়েক সারি পেছনে তাকে বসতে দেখা গেছে এবং ওমেন রিজার্ভেশন বিল নিয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন। বক্তব্যে নারীর ক্ষমতায়নে তার সরকারের প্রতিশ্রুতির কথাও বলেছেন।        

যদিও তিনি কায়সারগঞ্জের আসন থেকে প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণায় বিলম্বের জন্য সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করেছেন। বিজেপি অবশ্য তাকে প্রার্থী না করে তার ছেলে করণ ভূষণ সিংকে প্রার্থী করেছে। 

মণিপুরে বিজেপি সরকারের দায়মুক্তি

এক বছর আগে মণিপুরের চুড়াচাঁদপুরে দুই কুকি নারীকে নগ্ন করে ঘুরানো হয় এবং যৌন নিগ্রহ করা হয়। সিবিআইয়ের চার্জশিটে বলা হয়েছে, ওই নারীরা নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা নিরাপত্তা না দিয়ে বরং নারীদের উত্তেজিত জনতার হাতে ছেড়ে দিযেছিল। গত বছরের ৩ মে ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার ৭৮ দিন পর যখন ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয় তখন মোদী তার নিরবতা ভেঙে এই নিয়ে কথা বলেন। তবে সেসময় তিনি কংগ্রেস শাসিত দুটি রাজ্যের কথা বলতেও ভুলেননি। যদিও সেখানকার ঘটনা মণিপুরের মতো ভয়াবহ ছিল না। ভিডিও ভাইরালের পর মণিপুরের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং বলেন, মণিপুরের চারপাশে এরকম শত শত ঘটনা আছে, যেখানে নারীরা নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তিনি স্পষ্ট করে বলেননি, তার সরকার ওই ঘটনার বিচার নিশ্চিতে কি পদক্ষেপে নিয়েছে। 

বিজেপি নেতাদের নারী কেলেঙ্কারির আরও যত ঘটনা

বিলকিস বানু ধর্ষণ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে গুজরাটের দাহোদের বিজেপি এমপি যশবন্তসিংহ ভাবোর এবং লিমখেদা থেকে নির্বাচিত এমএলএ যশবন্তসিংহ ভাবোর ভাই শৈলেশ ভাটকে একই মঞ্চে দেখা গেছে। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় ধর্ষণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত ১১ আসামির একজন ছিলেন ওই ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে শাস্তি মওকুফ করলে গুজরাটের বিজেপি সরকার ১১ আসামিকে মুক্তি দিতে সুপ্রিম কোর্টকে বলেছিল। যদিও সুপ্রিম কোর্টে তা আটকে যায়। 

এ ছাড়া উন্নাওতে ১৭ বছর বয়সী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হন উত্তরপ্রদেশের এমএলএ কুলদীপ সিং সেনগার। বিজেপি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। পরে ২০১৯ সালে বিজেপি দাবি করে, ওই এমএলএ-কে অনেক আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাঙ্গারমাউ থেকে চারবার নির্বাচিত এই এমএলএ বর্তমানে যাবজ্জীবন দণ্ড নিয়ে কারগারে থাকলেও ওই অঞ্চলে এখনো বেশ প্রভাবশালী। 

২০১৮ সালে আট বছর বয়সী পথশিশুকে ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্ত স্পেশাল পুলিশ অফিসার (এসপিও) দীপক খাজুরিয়ার মুক্তির দাবিতে বিজেপি নেতারা জম্মুর কাঠুয়া জেলায় প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক ওই প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি অভিযুক্তকে মুক্তির এবং মামলাটি সিভিআইয়ের হাতে হস্তান্তরের দাবি করেছিলেন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশের হাতরাসে ১৯ বছর বয়সী নিম্নবর্ণের এক দলিত তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যা করে উঁচু বর্ণের চার ব্যক্তি। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ঘটনার রাতেই স্বজনদের শ্মশানে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে তড়িঘড়ি করে ওই তরুণীর সৎকার করে ফেলে। যার ফলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। ২০২৩ সালের মার্চে তফসিলি আদালত ধর্ষণের অভিযোগ থেকে ওই চার ব্যক্তিকে খালাস দেয়। যদিও ওই তরুণী মৃত্যুর আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। 

২০২৩ সালে একটি নারী অধিকার সংস্থা ১৯ বছর বয়সী অঙ্কিতা বান্দারী হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিজেপি নেতা ভিনোদ আরিয়ার ছেলে পুলকিত আরিয়া অঙ্কিতা এই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। পরে বিরোধীদের সমালোচনা এবং আন্দোলনের মুখে বিজেপি ভিনোদকে দল থেকে বহিষ্কার করে এবং প্রশাসন ঘটনাটি যে রিসোর্টে ঘটেছিল সেই রিসোর্টের অংশ বিশেষ ভেঙে দেয়।

২০১৪ সালের ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী ধর্ষণের মামলায় উত্তরপ্রদেশের সনবাদ্রা জেলা আদালত বিজেপির এমএলএ রামদোলার গোন্ডকে অভিযুক্ত করে। এরও ১০ দিন পর উত্তরপ্রদেশ অ্যাসেম্বলি গোন্ডকে অযোগ্য ঘোষণা করে। ২০২২ সালের নির্বাচনে দুদ্দি আসন থেকে জেতা এই এমএলএ-কে ২৫ বছর কারাদন্ড দেয় আদালত। তারপরও বিরোধীরা প্রশ্ন তোলার আগ পর্যন্ত তিনি বিজেপি থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন এবং দলটি তাকে অযোগ্য ঘোষণায় সময় নিয়েছে।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন