নেক্সাস : হারারীসুলভ বাড়াবাড়ি সমৃদ্ধ সুখপাঠ্য বই
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৬ পিএম
ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্পটা আমাদের সবারই পড়া। মানুষের তৈরি করা দৈত্য কিভাবে তার সৃষ্টিকর্তাকেই ধংস করে দেয়। তরুণী মেরী শেলী সায়েন্স ফিকশন নামে আস্ত একটা জনরার সূচনা করেন। নারী লেখিকাদের আজকের দিন অবধি পুরুষতন্ত্র তেমন দাম না দিলেও আরো অনেক কিছুর মতোই নারীদের হাত ধরেই যে সায়েন্স ফিকশনের মতো রীতিমতো ‘রমরমা’ একটা ডিসিপ্লিনের জন্ম হলো তা উপেক্ষা করার উপায় নাই। অবশ্য, মেরী শেলী বা নারীর অধিকার এখানে আলোচ্য না। বেস্ট সেলার লেখক ইয়ুভাল নোয়াহ হারারীর নতুন বই নেক্সাসের আলোচনায় শুরুতেই অবধারিতভাবে ফ্রাংকেনস্টাইনের আলাপ আসলো, কারণ এতে সেই ভয়টারই আধুনিক রূপের ব্যাখা দেয়া হয়েছে।
মেরী শেলী ছিলেন একজন লুডাইটের কন্যা। লুডাইট হচ্ছে তারা যারা জীবিকা হারানোর ভয়ে মেশিন ভেঙ্গে দিতেন। লুডাইটদের দারুণ গল্প আমরা পাই বাংলাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীত গায়ক ফকির আলমগীরের জন হেনরি গানে। হেনরির হাতুড়ি বনাম মেশিনের যুদ্ধ। মেরী মূলত দেখিয়েছিলেন এই মেশিন আমাদের জন্য দানব হয়ে আসবে। হেনরিদের হাতুড়িকে স্তব্ধ করে দেবে। হারারীর অবস্থান মেরির ঠিক বিপরীতে। তিনি পাড় পুঁজিবাদী। তিনি ভাবেন পুঁজিবাদ আর টেকনলজি সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। অথচ এহেন হারারীই মেরী শেলীর মতো এক বিন্দুতে পৌঁছে যান সেই হাজার বছরের পুরনো প্রযুক্তি বনাম মানুষের লড়াইয়ে মানুষের পরাজয়ের আশংকায়। হাজার বছর বললাম, কারণ সেই চাকা আবিষ্কারের পর থেকেই জীবিকা হারানোর ব্যাপারে মানুষ উদ্বিগ্ন। রোমান সম্রাট ভেসপেসিয়ান কম খরচে পরিবহনের সুযোগ নিষিদ্ধ করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, এতে গরিব মানুষ ভাতে মরবে। ইতিহাসজুড়ে প্রযুক্তির উন্নয়নে বেকারত্ব নিয়ে যে তর্ক চলেছে তার একটি দারুণ বিবরণ পাওয়া যায় জর্জ ওরওয়েলের ১৯৯৬ সালে লেখা বই দি টেকনলজিক্যাল আনএমপ্লয়মেন্ট এন্ড স্ট্রাকচারাল আনএমপ্লয়মেন্ট ডিবেটস বইটিতে। আধুনিক প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতিতে চাকা, যন্ত্র ছাপিয়ে হারারীর উদ্বেগ এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) নিয়ে।
যারা হারারীর বই পড়ে অভ্যস্ত, তারা আশা করি শুরুতেই এতো বড় ভূমিকা মেনে নেবেন। দারুণ গল্পকথক হারারী এইভাবেই ভূমিকা দেন। ইতিহাসের নানা ঘটনার উদাহরণ দিয়ে, একটার সাথে আরেকটার যোগাযোগ দেখিয়ে, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় নিজের তত্ত্ব হাজির করেন। এই বইটাও ঠিক তাই হয়েছে। স্যাপিয়েন্সে আমরা যে হারারীকে চিনেছিলাম, অনেক দিন পর সেই গতিশীল, দর্শককে ধরে রাখা হারারীকে পাই। এই গুণটাই হারারীকে পাঠকপ্রিয় করে।
তবে, তা করতে গিয়ে তিনি মাঝেই মাঝেই যুক্তিতর্কের ধার ধারেন না। হারারীর সাবলীলতার কারণে পাঠকও এ নিয়ে মাথা ঘামায় না, সেই আদিম কালে গুহার সামনে আগুন জ্বেলে গল্প বলা শামানদের মতো হারারী পাঠকদের ধরে রাখেন। কিন্তু হারারীর নিজের বেলাতেই বাড়াবাড়ি রকম আত্মবিশ্বাস চোখে পড়ে।
নেক্সাস নামটা থেকেই বোঝা যায় যে, যোগাযোগের যে বিরাট যজ্ঞ লাখো লাখো বছর ধরে মানুষ মাকড়সার মতো বুনেছে, তার ইতিহাস। স্যাপিয়েন্সে হারারী দেখিয়েছিলেন যে, মানুষের কল্পনাতেই তার দুনিয়া তৈরি হয়। এই সাবজেক্টিভ রিয়ালিটি তাকে একতাবদ্ধ করে। গ্রাম, নগর, শহর, দেশ গড়ে তোলে। ধর্ম, সমাজ, গোত্র গড়ে তোলার পিছনে মূল শক্তি এই সাবজেক্টিভ রিয়েলিটতে বিশ্বাস। অন্য প্রাণীরা কল্পনা করতে পারে না, ফলে তাদের সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি নাই, তাই তাদের জীবন গৎবাধা। একটা বাঘ হাজার হাজার বছর ধরে একই কায়দায় শিকার করে, একই কায়দায় খায়। তাজা মাংস আর রক্ত বাদ দিয়ে সে রান্নার প্রযুক্তি আবিষ্কা করতে পারেনি, যে প্রযুক্তি মানুষকে বাকি প্রাণী-জগৎ থেকে আলাদা করেছে। যার পরিণতিতে আজকে একজন অকিঞ্চিৎকর প্রাণী, যে নিজের খাবার উৎপাদনের সঙ্গে বিন্দুমাত্র জড়িত না থেকে, কম্পিউটার নামক এক উদ্ভট যন্ত্রের সামনে অনর্থক টাইপ করে চলছে। এই সাবজেক্টিভ রিয়েলিটিই বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের।
হারারী নেক্সাসে এই সাবজেক্টিভ রিয়েলিটিকে ধারণ করার যে সবচেয়ে শক্ত পাটাতন, সেই নেক্সাসের ইতিহাস বলেন। হারারীসুল্ভ উচ্ছ্বাসে, প্রচুর তথ্য দিয়ে। তথ্য কী—এই দিয়েই শুরু হয় হারারীর এই মহাযাত্রা। মহাকবি গ্যাটের গল্প থেকে আধুনিক কম্পিউটিং চলে আসে তথ্য কী তা বোঝাতে। এরপর গল্প। হারারীর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। গল্পই তো মানুষকে ভিন্ন করেছে প্রাণীজগতে। এরপর প্রথম পার্ট শেষ হয় ডকুমেন্টস, ভুল এবং সিদ্ধান্ত এই তিনটি অধ্যায় নিয়ে। যথারীতি হারারী পাটাতন তৈরি করেন এদের প্রকরণ ও গুরুত্বের নানা ঐতিহাসিক কাহিনি বর্ণণা করে। ডিসিশন নামের অধ্যায়ে গণতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্রের ভালোমন্দ দিক নিয়ে আলোকপাত করেন।
এরপর দ্বিতীয় পার্ট—ইনঅর্গানিক নেটওয়ার্ক—তিনটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। কিভাবে কম্পিউটার হিউম্যান নেক্সাসে জড়িত হয় তা নিয়ে, কম্পিউটারকে মানুষের মতো থামতে হয় না, বরং সে সর্বদা গতিশীল থাকে। নেটওয়ার্কের কোন কোন জায়গায় ভুল আছে সেই ছিদ্র খোঁজার চেষ্টা। এই অধ্যায়গুলোতে হারারী মেরী শেলীর মতো কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে থাকেন। বারবার যন্ত্রের প্রতি ‘নেইভ ফেইথ’ থাকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। আর এই পার্টেই হারারী আকর্ষণীয় অথচ ভয়াবহ কিছু সমস্যার কথা তুলে আনেন। কিভাবে টেকনলজি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ফেসবুকের এলগরিদম কিভাবে রোহিঙ্গা জেনোসাইডকে উস্কে দিলো, কিভাবে জনতুষ্টিবাদের জ্বালানি হয়ে উঠছে এলগরিদম, যা তৈরি করা হয়েছে আরো বেশি বেশি লাইক এবং এর ফলাফলে অনেক বেশি ব্যাবসার জন্য। কিভাবে ইন্ডাস্ট্রির লোভ দুনিয়াটাকে ছারখার করে দিচ্ছে তার বিবরণ। মানুষে মানুষে অশান্তি, অবিশ্বাস আর ভাগের দুনিয়া হয়ে যাচ্ছে এলগদিরদমের অসম্ভব শক্তিতে। যদিও হারারী মার্ক্স, ফুকো, আলথুসারদের কটাক্ষ করেন, তবু এদের যে ভীতি তা তিনি এড়াতে পারেন নাই। হারারীর টেকনলজি নিয়ে জ্ঞান ও উদ্বেগ তা উন্মোচন করে। সুখের বিষয়, স্যাপিয়েন্সে আমরা যে হারারীকে পাই, পরবর্তী অনেক বছর যে হারারী ছিলেন ইসরাইলের নীতির প্রতি অন্ধভক্ত, তিনি নেক্সাসে এসে সেই ইসরায়েলি নীতিকে প্রশ্ন করেন। ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে কিছু হলেও আলাপ তোলেন। হারারীর নিজের নানা শুধু কাগজের অভাবে কিভাবে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হয়ে গিয়েছিলেন, কতো লক্ষ ইউরোপীয় মানুষ কাগজের জন্য অসীম ভোগান্তি পোহান, তার বেশ মর্মস্পর্শী মানবিক গল্প বলেন। সম্ভবত এই বইয়ের সেরা অংশ এই অধ্যায়গুলোই। দুর্ভাগ্য, হারারী কখনোই বিষয়ের তেমন গভীরে যান না, বরং অনেক বিষয় নিয়ে বলতে চান। যদিও, এইটাই এই ‘ফোকাস হারানো’ যুগের পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হবার জন্য জরুরি।
শেষ পার্টে হারারি এআই নিয়ে মারাত্নক উদ্বিগ্ন। একদম মেরী শেলীর মতোই। এআই কিভাবে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এই নিয়ে তিনি আশংকা করেন। তবে, পুরো বইয়ে মানুষের ইতিহাস নিয়ে উচ্ছ্বাস ও ভয় দুইই তিনি এতে প্রয়োগ করেন। কিভাবে মানুষ এআইকে দানব নয়, বরং স্রেফ সহযোগী বানিয়ে রাখবে তার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজেন। কেন এআই যুগ অন্য সব যন্ত্র-বিপ্লবের যুগের চেয়ে আলাদা এবং এর যে ক্ষমতা আছে, দুনিয়াকেই মানুষের হাত থেকে কেড়ে নেয়া বা এমনকি দুনিয়াকে ধংস করে ফেলা, তা মনে করিয়ে দিয়ে মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হুঁশিয়ারি দেন। হারারী এই স্থলে মনে করেন, আমাদের এই নিয়ে দেরি করা চলবে না, সময় গেলে আর সাধন হবে না।
যাদের স্যাপিয়েন্স পড়ে ভালো লেগেছে তাদের নেক্সাস পড়েও ভালো লাগবে। যদিও জায়গায় জায়গায় মনে হবে, বইটা আরো ছোট হলে ভালো হতো, তবে হারারীর মূল আকর্ষণই তার গল্প বলায়। শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে এই গল্পে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য বইটা বেশ সুখপাঠ্য।
লেখক : ইয়ুভাল নোয়াহ হারারীর স্যাপিয়েন্স বইয়ের অনুবাদক।