বিশ্বজুড়ে আকস্মিক বন্যা, ভূমিধস
উড়ন্ত নদীকে দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা
নাভিন সিং খাড়কা
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৪ এএম
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিমাত্রার বন্যা দেখা যাচ্ছে। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশ, চীন ও কানাডার ভয়াবহ বন্যা।
এত ঘন ঘন বন্যা হওয়া আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকা বায়ুমণ্ডল এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আর্দ্রতা ধারণ করছে। বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে, ইরাক, ইরান, কুয়েত এবং জর্ডান—প্রতিটি দেশে ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছে। তার সাথে ছিল তীব্র বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি ও অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়াবিদরা পরে দেখতে পান, ওইসব অঞ্চলের আকাশ বা বায়ুমণ্ডল রেকর্ড পরিমাণ আর্দ্রতা বহন করছে, যা ২০০৫ সালের পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে গেছে।
দুই মাস পরে, চিলিতে মাত্র তিন দিনে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়—আকাশ থেকে এত বেশি পানি ঝরে যে তা আন্দিজ পর্বতের কিছু অংশের তুষারও গলিয়ে ফেলে।
এতে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। ফলে সেখানকার রাস্তাঘাট, সেতু ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সব ধ্বংস হয়ে যায়।
এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে বন্যা আঘাত হানে। তাকে সেদেশের রাজনীতিবিদরা ‘রেইন-বোমা’ আখ্যা দেন।
ওই বন্যায় ২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার মানুষকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে সরিয়ে নিতে হয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব ঘটনা বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলোর কারণে হয়েছে, যা ক্রমেই আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো প্রতিনিয়ত দীর্ঘ, প্রশস্ত এবং প্রায়শই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে, যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে বন্যার ঝুঁকিতে ফেলছে বলে জানিয়েছে নাসা।
এই ‘আকাশের নদী’ বা ‘উড়ন্ত নদী’ হল ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত লম্বা ও প্রশস্ত জলীয় বাষ্পের স্তম্ভ যার উদ্ভব হয় সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে, পরে তারা ঠাণ্ডা মেরু অঞ্চলের দিকে সরতে থাকে।
উড়ন্ত নদীগুলো পৃথিবীর মধ্য-অক্ষাংশজুড়ে চলাচল করা মোট জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০ শতাংশ বহন করে।
একটি বায়ুমণ্ডলীয় নদী গড়ে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ, ৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় তিন কিলোমিটার গভীর হয়ে থাকে, যদিও এই নদীগুলো ক্রমেই দীর্ঘ ও প্রশস্ত হচ্ছে।
অনেক সময় তা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দীর্ঘ ও প্রশস্ত হয়ে থাকে। তবু মানুষ এই নদী চোখে দেখতে পায় না। তারা যা দেখে তা শুধুই কিছু পুঞ্জীভূত মেঘ।
নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির বায়ুমণ্ডলীয় গবেষক ব্রায়ান কান বলেছেন, ’এই নদীর অস্তিত্ব ইনফ্রারেড এবং মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে দেখা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে জলীয় বাষ্প এবং বায়ুমণ্ডলীয় নদী পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট বেশ কার্যকর হতে পারে।’
উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম নদী মিসিসিপি যতটা না আর্দ্রতা ছড়ায় তার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি আর্দ্রতা ছড়াতে পারে বায়ুমণ্ডলের বিশাল ও শক্তিশালী নদীগুলো।
এই উড়ন্ত নদীগুলো গড়ে যে পরিমাণ পানি নিঃসরণ করে তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী আমাজনের নিয়মিত পানি প্রবাহের প্রায় দ্বিগুণ।
বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো সব সময়ই ছিল, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বেশি জলীয় বাষ্প তৈরি করছে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠে প্রচুর পরিমাণে পানি ঝরে। সে কারণে বিপর্যয়কর বন্যা ও ভূমিধস দেখা দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলীয় জলীয় বাষ্প ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমেই বাড়ছে।
জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব জিওসায়েন্সের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় নদী অনেক দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছে।
এর অর্থ হল প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হবে, যা ভূপৃষ্ঠের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের খলিফা ইউনিভার্সিটির আরেকটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ঠিক এমনটাই হয়েছিল।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের হাই-রেজোলিউশন সিমুলেশনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো দেখা গিয়েছে। এই নদীগুলো যখন উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা থেকে পশ্চিম ইরানের দিকে উচ্চ গতিতে প্রবাহিত হয় তখন তা ভারী বৃষ্টিপাত তৈরি করে।’ সূত্র: বিবিসি