ইসরায়েল সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ
শিশুখাদ্যের খোঁজে ফিলিস্তিনি মায়ের লড়াই
নূর আলিয়াকুবি
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ১১:১৭ এএম
গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ শুরুর সময় আমার মেয়ে লিয়ার বয়স ছিল সাত মাস। আমাদের জীবনে তার আগমন ছিল কঠিনতম এক চ্যালেঞ্জ। গর্ভধারণ করার মতো কোনো পরিবেশই আমাদের ছিল না। সুতরাং, তাকে পেয়ে আমরা কতটা খুশি হয়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য।
২০২৩ সালের ১৯ মার্চ তার জন্ম। আমাদের বিয়ের ঠিক দুই বছর পর।
সময়টা যতই কঠিন হোক না কেন, আমি যত্নসহকারে লিয়ার প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু বিবেচনা করেছি। তার পোশাক থেকে খেলনা, পুষ্টিকর খাবারের রেসিপি নিয়ে পরীক্ষা, ইত্যাদি।
শক্ত খাবার শুরুর আগে আমি ছয় মাস ধরে তাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে অনড় ছিলাম। আমি চেয়েছি, লিয়া আমার বুকের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠুক, যাতে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল করে তৈরি হয়।
একজন কর্মজীবী মা হিসেবে আমি দিনে প্রায় আট ঘণ্টা দূরে কাটাতাম। কাজের পরে আমি আমার মেয়ের সাথে সময় কাটাতে বাড়িতে ছুটে যেতাম।
এরপর ৭ অক্টোবর শুরু হয় যুদ্ধ। আমি একের পর এক যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলাম। তবু এবার আমি একজন মা, যার সতর্কতা ও পরিকল্পনা বেদনাদায়ক পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিল।
৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় খাদ্য, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিল। সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে গেল। দাম বেড়ে গেল।
আমার স্বামী মোহাম্মদ আর আমি আমাদের মেয়ে লিয়াকে নিয়ে চিন্তিত। আমরা কিভাবে শিশুসামগ্রী পেতে পারি তা জানি না? আমি দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছিলাম। লিয়া বাড়ছে। তার ক্ষিদে প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে।
আমাদের শিগগিরই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আমি লিয়ার খাবার দিনে তিনবার থেকে নামিয়ে দুইবার করলাম। সিরিল ও ফর্মুলা তিনবারের বদলে প্রায় একবার করে ফেললাম। এরচেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না যে, আমি আমার লিয়াকে অর্ধেক খাবারও দিতে পারছি না।
এটা নিরাপদ যে, আমি বুকের দুধ খাওয়ানো অব্যাহত রেখেছিলাম। কিন্তু আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ জলের অভাব রয়েছে। রেশন হিসেবে আমি যতটুকু পানি পাচ্ছিলাম তা হচ্ছে ‘প্রায় আধা লিটার’।
'সুইট বেবি, আমার কোনো উপায় নেই!' আমি আমার সন্তানের দিকে তাকিয়ে এমন কথা মনে মনে বলতে পারি, কিন্তু তাদের কি বেদনা কমে। না, কমে না, আরো বাড়ে।
যদিও আমি ভুলি নাই যে, যুদ্ধের আগেও বিশুদ্ধ পানি পেত গাজার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ। অন্যদের ময়লা পানিই খেতে হতো। কিন্তু আমি জানতাম, যেভাবেই হোক, আমি আমার সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে বড় করে তুলব, যাতে সে শক্ত দেহের অধিকারী হতে পারে।
নভেম্বরের মধ্যে গাজায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নেন আমার শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের ৩১ সদস্য ও অন্যান্য বাস্তুচ্যুত লোকজন। সবার ভাগে পড়ত প্রতিদিন আধা লিটারের কম জল।
আমরা সব সময় তৃষ্ণার্ত থাকতাম। আমাদের কিছু করার ছিল না। কিন্তু বাচ্চাদের সেটা বোঝাতে আমাদের সংগ্রাম করতে হতো।
আমি বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে চলেছে। তাই আমি লিয়ার জন্য কিছু জলের বোতল আলাদা করে রেখেছিলাম।
ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের আল-দারাজ এলাকার আশেপাশে সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তারা আমাদের পশ্চিম গাজায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করে যেখানে আমার বাবা-মায়ের বাড়ি ছিল। বাড়িটি আল-শিফা হাসপাতালের কাছাকাছি ছিল। নভেম্বরে চিকিৎসাকেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। গভীর হতাশার মধ্যে এটি আমাদের একমাত্র আশ্রয়।
কিন্তু এলাকাটা ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য ছিল। জনশূন্য আল-শিফার চারপাশের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। পানি, বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট—সব।
তিন দিন ধরে আমরা কোনো পানীয় জল খুঁজে পাইনি।
আমি, আমার স্বামী, আমাদের আত্মীয়রা প্রতিবেশীর কূপ থেকে তোলা অনিরাপদ লবণাক্ত পানি খেতে বাধ্য হই।
ময়দা ছিল দুষ্প্রাপ্য। তাজা পণ্যের অস্তিত্ব ছিল না। আমাদের জন্য প্রতিদিন একটি করে খাবার ছিল। মটরশুঁটি বা ভাত। কিন্তু এর পরিমাণ কোনো দিনই ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমরা সব সময় প্রচণ্ড ক্ষুধার মধ্যে জীবন যাপন করতাম।
আমাদের কাছে আশ্রয়প্রার্থী বাস্তুচ্যুত লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগল। তাদের সাথে আমাদের খাবার ও পানি ভাগ করতে হচ্ছিল।
শিশুখাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠল। আমি যে কয়েকটি ফার্মেসি থেকে যা কিছু কিনতে পারতাম তা দিয়ে আমি লিয়াকে দিনে একবারের বেশি খাওয়াতে পারিনি। আমাকে সারা দিন দেখতে হত, লিয়া ক্ষুধার্ত। সে খাবারের জন্য কাঁদছে। কিন্তু আমি তার জন্য খাবার তৈরি করছি না। আমি জানি আমার কোনো উপায় নেই। এমনকি পানীয় জলও বিরল।
আমার শরীর লিয়ার জন্য পর্যাপ্ত দুধ তৈরি করার ক্ষমতা হারাতে শুরু করেছে। আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি জানি আমি তাকে বোঝাতে পারি না। কারণ এখন তার বয়স কেবল নয় মাস চলছে।
শিগগিরই আমি লিয়াকে বড়োদের খাবার খাওয়াতে বাধ্য হলাম। ভাত বা কূপের পানি দিয়ে রান্না করা স্যুপ। আমি যখনই তাকে খাওয়াতাম তখনই আমার হৃদয়ে ব্যথা করত এবং অপরাধবোধ অনুভব করতাম। এ নিয়ে আমি সারাক্ষণ আতঙ্কিত থাকতাম। আমি তাকে ফিসফিস করে বললাম, ‘সোনাপাখি, আমার কোনো উপায় নেই। মিষ্টি মেয়ে, ভালো থেকো।’
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু সঠিক খাবার পাচ্ছে না। উত্তর গাজার দুই বছরের কম বয়সী ৩১ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন, গাজাজুড়ে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে।
টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আমি গাজার শিশুদের হাড় ছোট হয়ে যাওয়ার ছবি দেখতে পাচ্ছি। তাদের ছোট্ট শরীর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমি লিয়ার মুখে দিকে তাকাই এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, আমার লিয়ার জীবনেও কি এমন ঘটনাই ঘটবে? (আল জাজিরা থেকে অনুবাদ)
নুর আলিয়াকুবি, অনুবাদক ও সৃজনশীল লেখক, গাজা।