ইন্ডিয়া টুডের বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের জন্য নির্বাসন থেকে তারেক রহমানের ‘প্রত্যাবর্তনের’ মানে কী হতে পারে
অর্কময় দত্ত মজুমদার
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ এএম
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে লন্ডনে দীর্ঘ ১৬ বছরের রাজনৈতিক নির্বাসনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগস্টে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ বর্তমানে অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
গত ১ ডিসেম্বরের বাংলাদেশের হাইকোর্টে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর তার ফেরা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। ৫৯ বছর বয়সী তারেক রহমান দুটি মামলায় নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হত্যা এবং আরেকটি বিস্ফোরক ব্যবহার সম্পর্কিত মামলা ছিল। হত্যা মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায়।
বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। সেই সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই মামলায় তারেক রহমানকে নিম্ন আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেয়।
জল্পনা অনুযায়ী তারেক রহমানের এই ফেরা বিএনপির জন্য খুবই সময়োপযোগী একটি ব্যাপার হতে পারে। কারণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দলটি নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে। শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান এবং সেই থেকে ভারতেই অবস্থান করছেন।
তারেক রহমানের বাবা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৮১ সালের ৩০ মে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তারেক রহমানের মা খালেদা জিয়া দুইবারের প্রধানমন্ত্রী। হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
২০০৮ সাল থেকে তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৩০ নভেম্বর লন্ডন গেছেন। সূত্র বলছে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতেই মির্জা ফখরুল লন্ডন গেছেন।
অসমর্থিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ১০ জানুয়ারি তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারেন। ১৯৭২ সালের এমনই এক ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানে ২০৯ দিন বন্দিদশা কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
হাইকোর্ট থেকে খালাস পাওয়া পর, তারেক রহমান সামাজিক মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) তার অনুভূতি প্রকাশ করে লেখেন, ‘আসুন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান ঘটাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং ইতিহাসের এমন একটি নতুন অধ্যায় সূচিনা করি, যেখানে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কারও জীবন বা পরিবার ধ্বংস হবে না।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে যখন তীব্র বিতর্ক চলছে ঠিক সেই সময়ে তার এই বিবৃতি আশ্বস্ত হওয়ার মতো মন্তব্য বলে ধরা হচ্ছে। হিন্দুরা বাংলাদেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ হিন্দু।
‘সত্যের সৌন্দর্যে’ নিজের বিশ্বাসের কথা বলে জোর দিয়ে বলেছেন ‘অপপ্রচারের ঊর্ধ্বে সত্যের জয় হয়’ এবং ‘ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা’ নিশ্চিত করে। তারেক রহমান প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করার অঙ্গীকার করি, যা বিশ্বাস ও আদর্শের বৈচিত্র্যকে ধারণ করে নির্বাচনী অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করে জনগণকে ক্ষমতায়িত করে।’
তিনি বলেন, ‘সেই যাত্রায় সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতার সুরক্ষা এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও নিয়মভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা খাবে। তারা বলেছেন, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগী উপদেষ্টা যারা প্রধানত এনজিও এবং ছাত্র সংগঠন থেকে আসা তাদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে প্রভাব দেখাচ্ছে তা হয়তো তারেক রহমানের ফেরার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে।
কলকাতাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চান না। তিনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য চান। তিনি বুদ্ধিমত্তার কথা বলছেন বলেই চরমপন্থিরা তার বিরুদ্ধে। তারা বিএনপি শাসনামলের দুর্নীতির কথা বলে তাদের (বিএনপি) আক্রমণ করছে। তাই তারেক রহমান যদি ফেরেন তবে অনেক কিছু তৈরি হতে পারে।
তারেক রহমান ও তার দল বারবার আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। আগেও এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের 'পুনর্নির্মাণ' শুধুমাত্র একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনও কোনো নির্বাচনী পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি। বরং তারা নিজেদের ‘সংস্কারে’ কাজে ব্যস্ত রাখছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় আছে। দেশের অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় গতিশীলতা আসেনি। ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের কথা বললেও, হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে ভারতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখনো নাজুক।
এদিকে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তারেক রহমানসহ অন্যদের খালাস দেওয়ার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিত। তবে তা করা হবে কি না তা হাইকোর্টোর রায়ের কারণ এবং এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতের নির্দেশনা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।