রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করতে চায় আ.লীগ: ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৬:১৪ পিএম
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আওয়ামী লীগ আগের মতো অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এটা (জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা) তারা আগে করেনি কেন? এখন কেন করছে? আওয়ামী লীগ আগের মতো অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করতে চায়। তারা নানা কৌশল করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হচ্ছে।’
আজ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিকেলে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে গণবিরোধী আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী কায়দায় গণহত্যা ও দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারা দেশ আজ অগ্নিগর্ভ । আজকেও এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মনজু কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে গত দুই দিন আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও আজও আদালতে উপস্থাপন করে নাই। আমি ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে জনসম্মুখে হাজির করার দাবি জানাই।
তিনি আরও বলেন, গতকালও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার,নির্যাতন চালিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের একত্রিতও হতে দেয় নাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা। দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পাহারার নামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডার জমায়েত করে ভীতিকর ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল সরকার ।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি না করা সত্ত্বেও সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ না করতে দেওয়া এবং হামলা, গ্রেপ্তার করা সরকারের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে আমি ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলা, দমন,নির্যাতন এবং অন্যায় আটকের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে আটককৃত শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি ।
তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ অন্যান্য সমন্বয়কদের হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে তুলে এনে তাদের ওপর বল প্রয়োগ করে ডিবি কার্যালয়েই নজিরবিহীনভাবে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে তাদেরকে দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার করানোর নাটক সাজানো হয়েছে । তা আপনাদের সাথে দেশবাসীও অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন। ডিবি হেফাজতে রেখে সমন্বয়কদের ওপর চাপ দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণার নাটক সাজানো হলেও সাধারণ ছাত্রদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিল না। সরকার কত দেউলিয়া হয়ে পড়েছে ,তা ডিবি হেফাজতে আটক রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর বল প্রয়োগ করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করার ঘটনায় অনুমান করা যায়।একথা কারো বুঝতে বাকি নাই যে, চিকিৎসাধীন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের জোর করে হাসপাতাল থেকে তুলে এনে ডিবি কার্যালয়ে তাদের হেফাজতে রেখে বল প্রয়োগ করে ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করতে চায় সরকার ।
মির্জা ফখরুল বলেন, 'ছাত্র সমন্বয়করা আটক নয়', একথা ডিবি প্রধান বললেও তাদের কেন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না ? কেনো তাদের অভিভাবকদের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না? ডিবি কার্যালয় নিশ্চয়ই সরকারি বিশ্রামখানা ,অতিথিশালা বা খাবার হোটেল নয়। প্রায় প্রায়ই ডিবি কার্যালয়ে রাজনৈতিক নেতাসহ অন্যান্যদের ডেকে নিয়ে বা তুলে নিয়ে খাবার টেবিলে ছবি তুলে তা গণমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও সর্বোচ্চ আদালত থেকে ডিবি প্রধানের এই অযাচিত কর্মকাণ্ডকে 'জাতির সাথে মশকরা' অবিহিত করা হয়েছে। জাতির সাথে তামাশা, মশকরা করার জন্য অবৈধ সরকার সরকারি এই সংস্থাকে দিয়ে তার রাজনৈতিক হীন স্বার্থ উদ্ধারে অপব্যবহার করছে ।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য আন্দোলন বা সরকারের অগণতান্ত্রিক ,গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদকারী রাজনৈতিক দলকে দমন করতে সরকার অন্যায়ভাবে এসব সংস্থাকে অপব্যবহার করছে এবং এর কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মত বক্তব্য দিচ্ছেন, আচরণ করছেন। যা কোনো বিবেচনায় সংবিধান ও আইন সম্মত নয়। আমি ডিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দপ্তার ,সংস্থার কর্মকর্তা ,কর্মচারীদের প্রতি গণবিরোধী সরকারের নির্দেশে আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি এবং ডিবি হেফাজতে থাকা ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
ফখরুল বলেন, নজিরবিহীন এসব ঘটনা প্রমাণ করে আন্দোলনের শোচনীয় পরিণতির ভয়ে ভীত সরকার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপ ব্যবহার করে পার পেতে চাচ্ছে। শত শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই আন্দোলন বৃথা যেতে পারে না। সরকারের এই উদ্যোগ বুমেরাং হবে এবং নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী নিরীহ ছাত্র জনতাসহ বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ও অন্যান্য বিরোধী দল, সাংবাদিকসহ পেশাজীবিদের ওপর সরকারের নিষ্ঠুর, নির্মম দমন নিপীড়ন চলছেই। বিএনপি ও এর অঙ্গ -সহযোগী সংগঠনের এবং অন্যান্য বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগে আটক করতে চিরুনি অভিযানের নামে এবং আটকের পর রিমান্ডে এমনকি কারাগারে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সরকার দিনে বলছে, অন্যায়ভাবে কাউকেই আটক করা হবে না, আবার রাতেই ব্লক রেইড দিয়ে অন্যায়ভাবে নিরীহ, নিরপরাধ নেতা-কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থী, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও আটক করছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদেরও আটক করা হচ্ছে অমানবিকভাবে। আটক করতে গিয়ে তাদের বাসা বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সাথেও অসৌজন্য আচরণ ও আসবাবপত্র ভাঙচুর , এমনকি লুটপাট করার সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে ।
তিনি বলেন, এসব অত্যাচার,নির্যাতন বর্বরোচিত, নৃশংস ও কাপুরুষোচিত । কারাগারে আইন সম্মত সুযোগ সুবিধা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের। সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। রিমান্ডের পর রিমান্ডে নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অমান্য করছে অমানবিক এই সরকার। রিমান্ডে অকথ্য ও লোমহর্ষক নির্যাতনের কিছু বিবরণ সম্প্রতি আটক ডাকসুর সাবেক ভিপির কাছ থেকে আমরা গণমাধ্যমে শুনেছি। এসব শুনে জাতি স্তম্ভিত। অসুস্থ রাজনৈতিক বন্দীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে না। তাদের আত্মীয় পরিজনের সাথেও দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবিলম্বে এসব নির্মম নির্দয় দমন নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। রাজবন্দীদের সাথে নির্মম অসদাচরণ বন্ধ করতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে হবে এবং পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগের ক্যাডার দিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে সরকার জনগণের এবং একই সাথে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার মুখে পড়েছে। তারা মানবতাকেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে বাংলাদেশে| তার কি অপরাধ, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নাকি আন্দোলনকারীরা বহির্বিশ্বে বিনষ্ট করেছে ',এসব কথা বলে সরকার প্রধান মায়া কান্না করছেন।
তিনি বলেন, অবৈধ সরকার প্রধানের অহেতুক রাগ, ক্ষোভ, অহংকার, অহমিকা, দম্ভ, কটূক্তি, অবহেলা, অবজ্ঞা এবং আলোচনার পরিবর্তে কূটকৌশল ও শক্তি প্রয়োগ করে দমনের হিংসাত্মক মনোভাব শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতা ছড়িয়েছে। তাদের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডাররা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত লাশ ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে নৈরাজ্য সৃস্টি করেছে। সমগ্র ঘটনার জন্য সরকারই দায়ী। মায়া কান্না করে দায় দায়িত্ব এড়ানো বা অন্যের ওপর চাপানো যাবে না। বিদেশে সরকারের এই হত্যাযজ্ঞকে বর্বরতা আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে বর্বর,স্বৈরাচার বলা হচ্ছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত নিন্দা জানিয়ে কৈফিয়ত চেয়েছে ।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকারের বর্বরতা বিশদভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট নয়, সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট এবং সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর জন্য দায়ী একমাত্র সরকার,যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে গিয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করে নিরপরাধ ,মানুষ,,ছাত্র, যুবক, নিষ্পাপ শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। গত ১৭ বছরে সরকারের অগণতান্ত্রিক ,গণবিরোধী কার্যকলাপ, ভোটাধিকারসহ জনগণের সকল অধিকার হরণ , নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস, দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে বিদেশে এই সরকার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে। এটা নতুন নয়। বরং দেশের জনগণ আন্দোলন সংগ্রাম করে দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, বিনা ভোটের জবরদখল করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিত্যদিন পাগলের প্রলাপ বকছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যা ,বানোয়াট ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েই চলেছে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের মন্ত্রী, দলকানা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা । তারা মনে করছে বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বের মানুষ বোকার স্বর্গে বাস করছে তারা যা বলবে তাই বিশ্বাস করছে। আন্দোলন দমন করতে ইন্টারনেট সরকারের নির্দেশে বন্ধ করলেও ডাটা সেন্টারে অগুন দেয়ার মিথ্যা কথা প্রচার করা হয়েছে। জনগণকে বোকা বানানোর এ ধরনের বিরামহীন সরকারি প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে বাধ্য।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমি অবিলম্বে কার্ফু প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে রাজনীতিকে উন্মুক্ত করা, নিষ্ঠুর দমন নিপীড়ন বন্ধ , গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মী ও শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি ,মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি করছি । রাজনৈতিক সংকট সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।