Logo
Logo
×

রাজনীতি

তিস্তা চুক্তি ছাড়া ভারত সফর বাংলাদেশের জন্য অর্থহীন

ফয়সাল মাহমুদ

ফয়সাল মাহমুদ

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ০৮:৩৩ পিএম

তিস্তা চুক্তি ছাড়া ভারত সফর বাংলাদেশের জন্য অর্থহীন

ছবি: বাংলা আউটলুক

রাষ্ট্রীয় সফরে সাধারণত দুই পক্ষের দেওয়া-নেওয়া জড়িয়ে থাকে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজকের ভারত সফর নিয়ে ঢাকায় উল্লেখ করার মতো উদাসীনতা রয়েছে। বিপরীতে, সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টিতে নয়াদিল্লিকে বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে।

এই সফরে কোন পক্ষ কম দেবে এবং বেশি পাবে তা বুঝার জন্য একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের বেশি সময় লাগবে না। তবে শেষ পর্যন্ত কারা তা পাবে সেটি নির্ধারণ করা ভিন্ন বিষয়। 

শেখ হাসিনার এই সফরের আলোচ্য সূচিতে অনেকগুলো চুক্তি, বিনিয়োগ, সমঝোতা স্মারক এবং যৌথ বিবৃতির বিষয় রয়েছে। তবে দিল্লির কাছ থেকে ঢাকা যা পেতে চায় তা স্পষ্টভাবেই এই সূচিতে নেই। এই সফরে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না। 

ভারতের প্রবঞ্চনাময় কূটনীতি

যদিও নয়াদিল্লি প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে পরোপকারী হিসেবে তুলে ধরে। বাস্তবতা হলো সার্বভৌম দেশগুলির মধ্যে যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বার্থ দিয়েই চালিত হয়।

গত এক দশকে ঢাকা দিল্লির অনেক চাওয়া পূরণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চাওয়া পূরণ করেছে তা হলো—উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে ভারতের নিরাপত্তা হুমকি কমাতে ঢাকা সাহায্য করেছে।

ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের বিশিষ্ট নেতাদের ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। যা দেশটিকে স্বাধীনতাপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির কাছে অবাঞ্ছিত করে তুলেছে, বিশেষ করে আসামের বিদ্রোহীদের কাছে। এছাড়া বাংলাদেশে তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে।

এদিকে, নয়াদিল্লি সফলভাবে ঢাকার সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে পেরেছে যা প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে।

এছাড়াও, ভারত স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রিসহ বাংলাদেশে তার রপ্তানি বাড়িয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের হয়তো এই বিদ্যুতের খুব একটা প্রয়োজন নেই। 


অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ হলো, এতোকিছু দেওয়ার প্রতিদানে ঢাকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার—তিস্তা নদির পানি বণ্টন চুক্তিকে দিল্লি ঢাকার মতো গুরুত্ব দেয় না। আবার সীমান্ত হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতেও ভারত নজর দেয় না।

ভারতের প্রচারিত যে কোনো ঐতিহাসিক বয়ান সত্ত্বেও, প্রকৃত সত্য এই যে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে বাংলাদেশিদের উদ্বেগজনক হারে হত্যা করছে। বাংলাদেশিদের হত্যার এই হার ভারত-পাকিস্তান সীমান্তসহ সংঘাতময় অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের চেয়ে বেশি। 

এদিকে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী প্রচারণা ক্রমশ বাড়ছে। এই কর্মসূচি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ভারতের ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানিকে প্রভাবিত করেছে৷

প্রভাবশালী বাংলাদেশি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের নেতৃত্বে এই প্রচারণা শুরু হয়। পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে নয়াদিল্লি যথেষ্ট সহায়তা করেছিল এই অভিযোগে তারা ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু করেছিল। 

এটা সত্য যে, নির্বাচনের আগে আগে পশ্চিমা দেশগুলোতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচনা চরমে পৌঁছালেও নয়াদিল্লি তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছিল। 

নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফলভাবে বৈঠকের আয়োজন করেছিল ভারত। আর এর মধ্য দিয়ে ভারত শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। 

এ ছাড়াও মোদি সরকার আমেরিকার কাছে শক্ত যুক্তি দিয়েছিল যে, হাসিনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দেওয়া শুধু ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে নয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার বৃহত্তর কৌশলগত অগ্রাধিকারের জন্যও।

পর পর তিনটি নির্বাচনে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক—যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি এবং গণতান্ত্রিক নিয়ম নীতিকে গুঁড়িয়ে দিতে দেখেছেন তারা একে ভারতের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ মনে করেন। 

মোদির মতো একজন ডানপন্থী নেতা নয়াদিল্লির নেতৃত্বে আছেন, যিনি ভারতের প্রায় ২০০ মিলিয়ন মুসলমানকে কার্যত প্রান্তিক বা তুচ্ছ করে রেখেছেন। আর এই বিষয়টিও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে এবং ভারতবিরোধী মনোভাবকে তীব্র করেছে।

মজার ব্যাপার হল, গত কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী মোদিসহ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা প্রায়শই বিপুল সংখ্যক ‘অবৈধ বাংলাদেশীর’ ভারতে প্রবেশের চিত্র তুলে ধরছেন। আসলে তারা এটিকে ভারতের পূর্ব সীমান্তের রাজ্যগুলোতে ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনসংখ্যার বিষটির ইঙ্গিত হিসেবে ব্যবহার করেন। 

তাদের এই বয়ান ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় হিন্দু ভোটারদের বিজেপির পক্ষে টানতে বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু এই বছর আর এই বয়ান কাজে লাগেনি।  

চীন-ভারত বৈরিতার প্রেক্ষাপটে

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঢাকা ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে ন্যূনতম অভিযোগ নিয়েই ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান পুরো পরিস্থিতি মেনে নেয়। যদিও এই পরিস্থিতির জন্য ঢাকার বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দিল্লির মধ্যকার ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে দায়ী করে থাকে।

যদিও এটা সত্য যে, আওয়ামী লীগ দিল্লির প্রতি সব সময় দ্বিধা দ্বন্দ্বহীন অবস্থান বজায় রাখে। এটি এমন একটি দেশের পরিচালনায় ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে যেটি ভৌগলিকভাবে ভারত দিয়ে ঘেরা, ভারতের নির্মিত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং প্রয়োজনীয় পণ্যসহ ভারতের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়।

এই ধরনের পরিস্থিতি যেকোনো সার্বভৌম জাতির জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত। আর তা-ই তার কাছে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বৈচিত্র্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি চীন পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে তার প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে দেখে।


শেখ হাসিনার দেড় দশকের দীর্ঘ শাসনামলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ তার সম্পর্ক জোরদার করেছে। দেশটি অবকাঠামো এবং পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আর্থিক বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। ভারত থেকে যা পাওয়া যায় না। 

শুধু যদি প্রেক্ষপট বলতে হয় তবে বলা যায়, দিল্লিতে দ্বিপাক্ষিক সফরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, অর্থাৎ জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই শেখ হাসিনার বেইজিংয়ে আরেকটি দ্বিপাক্ষিক সফরের সূচি রয়েছে। 

চীন-ভারতের এই বৈরিতায় যদিও প্রাথমিকভাবে দিল্লির দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগ আছে। তবে এই বিষয়ে বেইজিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত কোকো চ্যানেলের একটি উদ্ধৃতির সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে মিলে যায়। যেমন: তুমি আমার সম্পর্কে কী ভাবছো তাতে মোটেও আমার কিছু আসে যায় না। তোমাকে নিয়ে আমি মোটেও ভাবি না।

কিন্তু বেইজিং স্পষ্টতই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির প্রস্তাব বাংলাদেশকে দিতে পারবে না, যেটা দিল্লি দিতে পারবে। তিস্তার পানি নিয়ে দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত চুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হাসিনা সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হবে।

তাই দিল্লি যদি সত্যিই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বা ছাড়িয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই তিস্তা চুক্তির প্রস্তাব দিতে হবে।

বল এখন তাদের কোর্টে।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন