Logo
Logo
×

অন্যান্য সংবাদ

ছেলের সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদেন বাবা

Icon

সাজ্জাদ হোসেন, বাসস

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৬ এএম

ছেলের সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদেন বাবা

 “বাবার বয়স হয়েছে। সে আর এত কষ্ট নিতে পারছে না। ছেলে হিসেবে সৈতককেই  তো সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু কিছুই আর করা হলো না সৈকতের।” বলছিলেন শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি। কোটাসংস্কার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহিদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বড় বোন সুপ্তি।

“আমার ভাইয়ের জীবনটা শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে,” সুপ্তির কান্নাজড়িত কন্ঠ।

সৈকতের আরেক বড় বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি। ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বললেন, ‘ছোট ভাইটি ছিল আমার কলিজার টুকরা। তার ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। হতে চেয়েছিল অনেক বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ঘাতকের একটা বুলেট তার সকল স্বপ্ন কেড়ে নিল।”

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “আমার ভাইয়ের মাথার একদিক থেকে গুলি ঢুকে অন্যদিক দিয়ে মগজসহ বেরিয়ে গেছিল। সাথে সাথেই সব শেষ। মাথায় গুলি না করে শরীরের অন্য জায়গায় করলে কি হতো? তাহলে হয়তো পঙ্গু হয়েও আমাদের ভাইটি চোখের সামনে বেঁচে থাকত।”

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নূরজাহান রোডে ভাড়া বাসায় সম্প্রতি কথা হয় এই শহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

টগবগে, উচ্ছল সন্তানকে হারিয়ে মা-বাবা যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। ভাইকে হারিয়ে নিস্তব্ধ দুই বোন। স্বজন হারানোর শোকে পাথর হয়ে যাওয়া পরিবারের কারো মুখে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা নেই। তিন মাস চলে গেলেও তারা নিজেদের স্বাভাবিক করতে পারেননি।

সৈকতকে যে পুলিশ অফিসার গুলি করেছিলেন তাকে শনাক্ত করা গেছে বলে জানান সেবন্তি। “মোহাম্মদপুর রায়ের বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম আমার ভাইকে গুলি করেছিল। গুলি করার পর তাকে উপস্থিত জনতা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ছেলেটাকে কেন গুলি করলেন?’ তখন সে বলেছিল, ‘দেখছেন না ডিস্টার্ব করতেছিল?’ তাই তাকে গুলি করে মেরে ফেলল।”

সেবন্তি বলেন, “আমার ভাইয়ের হত্যাকারী এখনো গ্রেফতার হয়নি। মামলারও তেমন অগ্রগতি নেই। আমরা চাই আমার ভাইয়ের হত্যাকারী যেন মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে না পারে। তার যেন বিচার হয়। তবে কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন এটাও চাই।”

আন্দোলনের শুরুতেই সৈকতের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দেয় বলে জানান তার মা। আফরোজা রহমান। তিনি বলেন, “সৈকত বলত, ‘এত শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে! আর আমি অথর্ব। বাসায় বসে আছি। কিছুই করতে পারছি না।’ আমাদের বাধার কারণে আন্দোলনে যেতে পারত না সৈকত। এজন্য ১৮ জুলাই খানাপিনা ছেড়ে দিয়ে অনশনও করে।”

এমনিতে সৈকত মায়ের হাতে খাবার খেতেন না। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় মায়ের হাতে খাবার খেয়ে অনশন ভাঙেন, বলেন শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি।      

মাহামুদুর রহমান সৈকতের বয়স হয়েছিল ১৯ বছর। শহিদ হন গত ১৯ জুলাই।

ঢাকায় ২০০৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। দুই বোনের একটি মাত্র ছোট ভাই। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনার্সে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসএসসিও পাস করেছিলেন একই প্রতিষ্ঠান থেকে।

সুপ্তি বলেন, “সৈকত ছিলো লাজুক। শান্ত। অন্তর্মুখী স্বভাবের। ক্রিকেট পাগল ছিল সৈকত। ঘরে আজও পড়ে আছে তার প্রিয় ব্যাট-বল। সাইকেল চালানোও শখ ছিল সৈকতের। বাবা আজও  তার সাইকেলটি ধুয়েমুছে রাখেন। সাইকেলের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনওবা কাঁদেন একা। ‘ছেলে নেই!’ বাবা বিড়বিড় করে কথা বলেন সাইকেলের সাথে।”

দুই বোনের মধ্যে সেবন্তির সঙ্গে বেশি সখ্য ছিল সৈকতের। “আমরা দুই বোন ছোট ভাইটিকে পাখির মতো আগলে রেখে বড় করেছি। আদর করে ভাইকে আমরা টুনা, টুনাপোকা এসব বলে ডাকতাম। তবে দুই বোনের মধ্যে আমার সাথে ভাব-ভালবাসা বেশি ছিল। আবার ঝগড়াঝাঁটিও হতো বেশি আমার সাথে। কারণ আমরা দুইজন ছিলাম পিঠাপিঠি।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটের দিকে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন মাহামুদুর রহমান সৈকত। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সৈকত রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে স্বজনেরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মাহামুদুরের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছিলেন। ডাক্তারি সনদে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল ‘গান শট’।

হাসপাতাল থেকে সরাসরি মোহাম্মদপুরের মারকাজুল ইসলামে নিয়ে গোসল দিয়ে সেখানেই লাশ রাখা হয়। সেদিন আর বাসায় আনা হয়নি। পরদিন সৈকতকে মোহাম্মদপুর জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।   

নূরজাহান রোডে বাসার কাছেই মাহামুদুর রহমানের বাবা ৬৪ বছর বয়সী মাহাবুবের রহমানের ‘দই ঘর’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ছেলে তাকে ব্যবসায় সহায়তা করতেন। দোকানে বসতেন। ১৯ জুলাই মাহাবুবের রহমান পারিবারিক কাজে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ছিলেন। সেদিনও সৈকত দোকানে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটু পরই আবার ফিরে এসে মাকে বলে ন, “এক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়েছে।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে যান। এটাই তার শেষ যাওয়া।

সেবন্তি জানান, তার ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা দোকানে গেলেও সেখানে বসেই কান্নাকাটি করেন। দোকান থেকে ভাই যে জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে সেই জায়গায় গিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।

“সৈকত একটা বিড়াল পালত। সে মারা যাওয়ার পর বিড়ালটা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক কষ্ট করে তাকে খাওয়াতে হয়েছে। এখনো হঠাৎ এদিক-সেদিক দৌড় দেয় আর মিও মিও করে ডাকে,” বললেন সেবন্তি।

সৈকতের স্কুলজীবনের বন্ধু মো. জারিফুর রহমান বলেন, “সৈকতের মতো সম্ভাবনাময় ছাত্র হত্যাকারীদের বিচার হওয়া উচিত। ওই দিন আমিও আন্দোলনে ভিন্ন স্পটে ছিলাম। তার গুলি লাগার ফোন পাই ৪টা বাজার একটু আগে। ছাত্ররা আন্দোলন করবে। সরকার চাইবে আন্দোলন থামাতে। কিন্তু এই আন্দোলন থামানোর প্রক্রিয়াটা তো মানুষ মেরে হতে পারে না।”  

সৈকতের আরেক বন্ধু বায়েজিদ বলেন, “সৈকত ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল সাদাসিধা মনের। পরোপকারী। নিরহঙ্কারি সুখী মানুষ। কোনো বিষয়ে তার কপটতা ছিল না। বন্ধুদের যেকোনো বিপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অসুস্থদের প্রয়োজনে নিজের রক্ত দিয়ে সাহায্য করত। সেবামূলক যেকোনো কাজে সকলের আগে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। আমি সৈকতসহ যত মানুষ মারা গেছে, প্রত্যেকের হত্যার ন্যায্য বিচার চাই।” 

গত ২৫ আগস্ট শহীদ সৈকতের বাবা বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। আর ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলার অগ্রগতি কম বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবারের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথম দিকে যে কয়জন শহিদ হয়েছেন সৈকত তাদের অন্যতম। তাদের ঝরানো রক্তের নদী পাড়ি দিয়েই দেশ আজ স্বৈরাচারমুক্ত। তাই হত্যার দ্রুত বিচার জরুরি বলে মনে করছেন সকলেই।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন