সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার খোলা চিঠি
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ এএম
এভাবেই পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাইদ। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় প্রাক্তন সহকর্মীবৃন্দ, আসসালামু আলাইকুম।
আমি আপনাদের একজন প্রাক্তন সহকর্মী। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর পুলিশে দায়িত্ব পালনের আইনি-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে আপনার ও আপনার সন্তান-সন্ততিদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ও করণীয় নিয়ে এই খোলা চিঠি লিখছি।
ভারতীয় উগ্র-হিন্দুত্ববাদী সরকারের সরাসরি মদদপুষ্ট এই বিনা-ভোট, নৈশ-ভোট ও ডামি-ভোটের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে কতিপয় পুলিশ, যার বেশিরভাগই বিবিধ-কোটা, প্রশ্ন-ফাঁস ইত্যাদির মাধ্যমে গত ১৫-১৬ বছরে চাকরিতে ঢুকে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে! আর তাদের সেই সকল কু-কর্মে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বাধ্য হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আপনারা যারা তাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে চলেছেন, তাদের উদ্দেশ্যেই মূলত, আমার এই উপদেশ বার্তা। অতিসম্প্রতি রংপুরে সংঘটিত একটি ঘটনার উল্লেখ করেই আমি শুরু করছি।
গত ১৬ জুলাই, মঙ্গলবার রংপুরে আবু সাইদ নামে এক ইউনিভার্সিটি ছাত্রকে একাকি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। যার লাইভ ভিডিও আপনারা সকলেই ইতোমধ্যে দেখেছেন। কর্তব্যরত পুলিশ কখন কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে গুলি করতে পারে সেই বিষয়ক আইনি-জ্ঞান থেকে আপনারা সন্দেহাতীতভাবেই বুঝতে পারছেন যে, এই গুলি বর্ষণকারী পুলিশ সদস্য ঠান্ডা মাথায় (Cool headed murder) মানুষকে হত্যার অভিযোগে একদিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সংশয় নেই। এরজন্য প্রয়োজন হবে না কোন মৌখিক বা ডকুমেন্টরি এভিডেন্সের। সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মিডিয়া সমূহে প্রকাশিত এই ভিডিওটি আদালতে উপস্থাপনই হত্যাকারীকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানোর জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।
খোঁজ নিয়ে দেখুন, অতি উৎসাহী ঐ গুলি বর্ষণকারী পুলিশ-সদস্য হয় পুলিশ-লীগ, নতুবা বিশেষ কোনো জেলার বিশেষ কোনো দলের প্রাক্তন কর্মী। এমন মানুষ খুন-জখম করার পূর্ব অভিজ্ঞতাও হয়তো তার রয়েছে! তা না হলে একটি নিরপরাধ পুত্র-ভাইতুল্য একটি ছেলে, যার সাথে তার কোনো পূর্বশত্রুতা ছিল না, যাকে সে হয়তো কোনদিন দেখেওনি! কিন্তু পরিস্থিতি থেকে এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে, সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই হবে। অথচ তারই প্রতি সে নির্দ্বিধায় গুলি চালিয়ে দিল! একটি বারও তার অন্তরে মায়া-মমতার উদ্রেক হলো না!
এখন কথা হল, এই এক ব্যক্তির অপরাধের কারণে ঐ পুলিশ দলের অধিনায়ক এবং ঐ থানার ওসি থেকে শুরু করে কার্যবিধি ৫৫১ ধারা অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পালনে অবহেলার’ জন্য একত্রে দণ্ড ভোগের ঝুঁকি নিয়ে রাখবেন কিনা?
যদি সেই ঝুঁকি নিয়ে নিজের এবং সন্তান-সন্ততিদেরকে বিপদগ্রস্ত করতে না চান, তাহলে এই হত্যা বিষয়ে থানায় (অথবা থানা মামলা না নিলে) কোর্টে যে মামলা দায়ের হবে, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আইনানুগভাবেই চার্জশিট প্রদান করা সম্ভব। তা করে নিজেরাও বাঁচতে পারেন, সন্তান-সন্ততিদেরকেও বাঁচাতে পারেন।
একটি বিষয় আপনাদের সকলের মনে রাখা প্রয়োজন। মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সহ্য করতে করতে একসময় যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তখন তারা নিজেরাই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। ২০১৩ সালের পর থেকে গত প্রায় ১২ বছর যাবৎ পুলিশের কতিপয় সদস্যদের এমন অপরাধমূলক কর্মের ভিকটিম হিসেবে মানুষ ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে!
অন্যদিকে আপনারা কিন্তু সবসময় ইউনিফর্ম এবং অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ান না। সাধারণ মানুষের মতো বাজার-ঘাটে যান। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন। তাই ভাই-হারা, পুত্র-হারা কোনো ভাই বা পিতা যদি আপনার ভাই বা পুত্র-কন্যাকেই প্রতিশোধস্বরূপ বেছে নেয় তখন কি করবেন? একবারও তা ভেবে দেখেছেন কি?
সুতরাং, আপনারা যারা মনে করছেন, এই সরকার ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বা তা কিয়ামত পর্যন্তও বর্ধিত হতে পারে। যাই-ই হোক না কেন, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা কিন্তু আর সরকার পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবে না। যা করার নিজেরাই করে ফেলবে। আর তেমন হলে পরিস্থিতি হবে আসলেই খুব ভয়ংকর!
তাই এতদিন যা হবার হয়েছে, এখনও সময় আছে সংশোধন হন। অন্তত নিজের সন্তান-সন্ততির জন্য হলেও। বেনজীরদের অবস্থা দেখেন না? এই সরকারের জন্য এত কিছু করার পরেও সেই সরকারের আমলেই কি বীভৎস অবস্থায় পড়েছে সে এবং তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি! সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোটাবিরোধী আন্দোলন যারা করছেন, তারা তো আপনার সন্তান বা ভাইয়ের মেধার মূল্যায়নের জন্যই তা করছেন। যেটা আপনি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হয়তো চাকরি বিধি-বিধানের কারণে নিজে পারছেন না। আপনার অপারগতার কাজটিই তো ওরা করে দিচ্ছে। তাহলে ওদেরকে আপনারা মারছেন কোন বিবেচনায়? নিজের ভবিষ্যৎ নিজে বুঝতে পারছেন না?
আপনারা এটা কি খেয়াল করেন যে, আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগের কেউ কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদে পড়লে মানুষ যেমন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে, কোনো পুলিশের সদস্যের ক্ষেত্রেও মানুষ তাই-ই করে? অথচ বাস্তবতা হলো, অবৈধ সুযোগ-সুবিধা, অর্থবিত্ত-বৈভব ইত্যাদি সকল কিছুই সর্বোচ্চ শতকরা ৫ভাগ পুলিশ কর্মচারীর ভাগ্যে জুটলেও বাকি ৯৫ভাগ পুলিশ সদস্য সাধারণ মানের জীবন যাপন করেন। অথচ ওই পাঁচ ভাগের কারণে পঁচানব্বুই ভাগ পুলিশ সদস্য এবং তাদের পরিবার পরিজনরা সাধারণ মানুষের কাছে ঘৃণা ও অভিশাপের পাত্র হয়ে গেছে!
এখন সময় এসেছে সেই ৯৫ভাগ পুলিশ সদস্যদের এ থেকে পরিত্রাণের। কাজেই আপনারা সেই ভাবে চলুন। এ দেশের জনগণ আপনাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে ইনশাআল্লাহ।