ইসরায়েলি কারাগারে বিয়ে ও সন্তান জন্মে ফিলিস্তিনি নারীর কঠিন লড়াই
ডায়ানা ব্লক
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৪, ১০:২৬ এএম
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সানা সালামেহ দাক্কাহ ও তার চার বছরের মেয়ে মিলাদকে সম্মাননা জানানো ৩৬০০ লোকের মধ্যে আমিও একজন। এই সম্মাননা সম্মেলনে (পিপলস কনফারেন্স) থাকতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।
গত ২৪ ও ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েট শহরের একটি অডিটোরিয়ামে এই মা ও মেয়েকে সম্মাননা দেওয়া হয়। সম্মাননা দেওয়ার কারণ, ইসরায়েলি কারাগারে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সানাকে একটি দীর্ঘ সংগ্রামী পথ অতিক্রম করতে হয়েছে যাকে বলা উচিত বীরত্বপূর্ণ কাজ। ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনি জন্ম ঠেকাতে কয়েক দশক ধরে কঠোরভাবে চেষ্টা করে আসছে।
সানা সেই ইসরায়েলি কারাগারে শুক্রাণু পাচারের মাধ্যমে গর্ভধারণ করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সানার এই মেয়ের জন্ম হয়।
সানা ও ওয়ালিদ ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলি কারাগারে প্রথম দেখা করেন। সানা সেখানে বন্দীদের অবস্থা বিষয়ে রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে তারা আশকেলন কারাগারে তাদের কমরেড ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে বিয়ে করার কঠিন লড়াইয়ে জিতেছিলেন। তবে তাদের দাম্পত্য জীবন কারাগারে শুরু হতে পারেনি।
সম্মেলনে সানা বলেন, ওয়ালিদকে ১৯৮৬ সালে ২৫ বছর বয়সে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ ও হত্যার নির্দেশ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল তাকে। তাকে ৩৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যাতে মুক্তির পর তিনি আর সন্তান জন্ম দিতে না পারেন। সুতরাং ওয়ালিদের ‘শুক্রাণু’ নিয়ে গর্ভধারণের উদ্যোগ নেন সানা।
ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চিত করার জন্য কারাগার থেকে শুক্রাণু পাচারের বিদ্রোহী প্রকল্পটি ২০১২ সালে প্রথম সফল হয়েছিল। তারপর থেকে দীর্ঘ সাজার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্যের কারণে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মধ্যে এর অনুশীলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ফিলিস্তিনি বন্দী যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন। সানা বলেন, ‘বন্দীরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে জীবন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ শুক্রাণু পাচারের মাধ্যমে ১১৫টির বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে বলে সানা জানান।
চে গুয়েভারার বিখ্যাত একটি বিবৃতি: পাহাড়ের চেয়ে গর্ভে গেরিলাকে হত্যা করা সহজ। তার এই মন্তব্যের কারণ হলো, ১৯৬০-৭০-এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী শাসক শত্রুদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে কাজ করেছিল।
জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণও ইসরায়েলি এবং মার্কিন কারাগার উভয় ব্যবস্থারই একটি অবিচ্ছেদ্য কাজ।
মিলাদের জন্মের পর তার বাবা ওয়ালিদকে বছরের পর বছর নির্জন কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। ওয়ালিদ ও সানাকে প্রথমে মিলাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য ও পরে কারাগারে তাকে তার বাবার সাথে পারিবারিকভাবে দেখা করার অধিকারের জন্য প্রচণ্ড লড়াই করতে হয়েছিল।
ওয়ালিদকে ৩৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে ইসরায়েলি সরকার কারাগারে মোবাইল ফোন আনার অভিযোগে তার সাজা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া তারা তাকে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করাতে দেয়নি। ক্যান্সার নিরীক্ষণের জন্য যা তার কয়েক বছর আগে করা হয়েছিল।
ওয়ালিদের পরিবার ও সমর্থকরা তার চিকিৎসায় অবহেলা করার অভিযোগ করেন।
ওয়ালিদের চিকিৎসাসেবা ও কারামুক্তির জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান সত্ত্বেও তাকে রামলেহ কারাগারের ক্লিনিকে রাখা হয়েছিল। ৭ এপ্রিল ২০২৪ চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তিনি মারা যান।
কিন্তু তার লাশ ফেরত দেয়নিই সরায়েলি সরকার। ইসরায়েলি নিরাপত্তামন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ফিলিস্তিনে বন্দী ইসরায়েলিদের ছাড়া না হলে তার লাশ আটকে রাখবে।
ওয়ালিদের মৃত্যুর ছয় সপ্তাহ পর তার স্ত্রী সানা ও মেয়ে মিলাদ ডেট্রয়েট ভ্রমণ করেন। সম্মেলনে তাদের উপস্থিতি নাটকীয়ভাবে ফিলিস্তিনি বন্দীদের আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্মেলনের একটি বিশেষ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সানা বন্দি আন্দোলনের ইতিহাস এবং সময়ের সাথে সাথে বন্দীরা কিভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠেন, শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালান, বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অবদান রাখে এবং শুক্রাণু পাচার ও ব্যবহারের কৌশলগুলি তৈরি করে তার বিশদ বিবরণ দেন।
সানা ও মিলাদ এই আন্দোলনের নায়ক। পিপলস কনফারেন্সে তাদের উপস্থিতি একটি অদম্য অনুপ্রেরণা এনেছে যা একটি মুক্ত ফিলিস্তিনের জন্য অব্যাহত সংগ্রামের পথে মুক্তিকামী মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। (কাউন্টার পাঞ্চ থেকে অনুবাদ)
* ডায়ানা ব্লক কিউবা সেভিং লাইভস কমিটির সঙ্গে কাজ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া কোয়ালিশন ফর উইমেন প্রিজনারসের প্রতিষ্ঠাতা।