যুদ্ধে রাশিয়া কেন দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ০৮:৫৫ পিএম
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তিতে ঠাসা। ব্যবহার করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ড্রোন শুরু করে হাইপারসনিক মিসাইল। তবে এর মধ্যেও একটা প্রযুক্তি শত বছরের পুরনো হলেও এখনো সমান গুরুত্ব ধরে রেখেছে । সেটির নাম হলো মোর্স কোড।
বিভিন্ন স্বরধ্বনির কাটা কাটা লাইন, যা দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগে একজন রেলপথের শ্রমিক দেখা মাত্র বুঝে ফেলতো, সেটি এখনো রাশিয়ান সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে। আজও অবশ্য কিছু মানুষ মোর্স কোডের স্বতন্ত্র শব্দ শুনে সেটা শনাক্ত করতে সক্ষম, বিশেষ করে এর সবচেয়ে পরিচিত যে ধরন, তিনটা ছোট, তিনটা বড়, আবার তিনটা ছোট (...---...), যা মূলত এসওএস বা জরুরি বার্তা বোঝায়।
বর্তমানে মোর্স কোডের মাধ্যমে রাশিয়ান বোমারুরা তাদের বার্তা পাঠাচ্ছে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে অথবা রাশিয়ান নৌবাহিনী বাল্টিক ফ্লিটের জাহাজ থেকে বার্তা যাচ্ছে স্থলে তাদের হেডকোয়ার্টারে। বিভিন্ন শৌখিন রেডিও স্টেশন শর্টওয়েভ ব্যান্ড ব্যবহার করে অনেকটা একইরকম বিপ শব্দ করে, যা আগ্রহীদের কাছে “ডিটস” (.) ও “ডাহস” (-) নামে পরিচিত, সাধারণ মানুষ অনেকে এটাকে ডটস ও ড্যাশ বলে থাকে। এমনকি গোয়েন্দারা আজও রেডিওতে শর্টওয়েভ ব্যান্ড ধরে বিভিন্ন গোপন স্টেশনে আড়িপাতে যারা মোর্স কোডের মাধ্যমে সম্প্রচার করে।
কিন্তু আমাদের এই পরিবর্তিত বিশ্বে একটা প্রযুক্তি যা ১৯ শতকের একেবারে প্রথমভাবে আবিষ্কার হয়, সেটা কেন আজও ব্যবহার করা হচ্ছে? এর প্রথম কারণ মোর্স কোড কোন প্রকৌশলী বা প্রযুক্তিবিদের হাতে আসেনি বরং এক সাধারণ মানুষ যিনি ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনিই এটার আবিষ্কারক। স্যামুয়েল মোর্স শুরুতে টেলিপ্রিন্টারের ডিজাইন করেন, যে ডিভাইসে কাগজে লেখা প্রিন্ট আসতো।
মোর্স এরপর এটি নিয়ে আরও বিশদভাবে কাজ করার জন্য আলফ্রেড ভাইলকে যুক্ত করেন, যার অবশ্য সমস্ত আগ্রহ ছিল বিভিন্ন সব যন্ত্র ঘিরে। এরপর তিনিই এই সাংকেতিক ডটস ও ড্যাশ আবিষ্কার করেন এবং শব্দের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদানের ধারণাটা তার মাথা থেকেই আসে। শুরুতে অবশ্য শব্দ শুধুমাত্র সংযোগ পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত। অনেক আগেই মোর্স ও ভাইল বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রিন্টিং করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়। তাই এরপর তারা যখন শব্দ যোগ করলেন এতে, তারা আসলে তখন কল্পনাও করতে পারেন নি যে যোগাযোগের কতোটা অসাধারণ ও কার্যকরী একটা উপায় বের করেছেন তারা।
মোর্স কোডের আসল জিনিসটাই হল এর শব্দ, যা অনেকটা ছন্দ তৈরি করে। সেকারণেই এর সাথে সংগীতের অনেক মিল পাওয়া যায়। আর এটা দেখা গেছে যে সংগীতে প্রতিভাসম্পন্ন লোকেরা মোর্স কোড দ্রুত শিখে ফেলতে পারে। মানুষের ভিতরে থাকা ছন্দ বোঝার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়ে মোর্স কোড আমাদের বিভিন্ন আলাদা ধরন চেনার ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। এই কৌশলটা আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে সুপ্ত থাকে এবং অসম্পূর্ণ বার্তা উদ্ধারে দারুণভাবে কাজে আসে।
তবে মোর্স কোড ব্যবহারকারীরা মাঝে মধ্যে অসম্পূর্ণ তথ্য পান নানান অপ্রয়োজনীয় শব্দ,যান্ত্রিক ত্রুটি, খারাপ সংযোগ ও বাইরের কিছু ঢুকে পড়ার কারণে। স্নায়ুবিক দিক থেকে মোর্স কোডে একটা অদ্ভুত বিষয় থাকে, যাকে তুলনা করা যায় “কান দিয়ে পড়ার” সাথে, আর কিছু পাঠানো ও গ্রহণ করা আসলে লিখিত বার্তার চেয়ে অনেকটা কথা বলার মতো কাজ করে। মোর্স কোডের আরেকটা অন্যতম দিক হল এটি অত্যন্ত সাধারণ প্রযুক্তির। যে কারো একেবারে মৌলিক কিছু প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলেই সে সহজলভ্য সব যন্ত্র একসাথে করে নিজের ট্রান্সমিটার তৈরি করে ফেলতে পারে।
আর মোর্স ট্রান্সমিটার যে সিগন্যাল প্রেরণ করে সেটাও খুব সামান্য এবং মাত্র ১০০-১৫০ হার্টজের ব্যান্ডউইথ লাগে এজন্য (যেখানে সাধারণত কথা বলতে ২৫০০-৩০০০ হার্টজের দরকার হয়)। যার মানে বার্তা গ্রহণকারী সামান্য ফিল্টার ব্যবহার করে এই বার্তা আসার বিভিন্ন ধরনের পর্যায়ে বাইরের নানা ক্ষেত্র থেকে যে বাড়তি শব্দ আসে, সেটাকে মুছে দিতে সক্ষম। আর এটি যে কারণে সবচেয়ে কার্যকরী তা হল সামান্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এটি বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে পারে।
১৯৫৬ সালে রেডিও অ্যামেচারস দেখিয়েছিল যে ম্যাসাচুসেটস থেকে ডেনমার্কে কিছু পাঠানোর জন্য ৭৮ কিলোওয়াট পাওয়ারই যথেষ্ট। যা একটা এলইডি বাতি যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তার দশভাগের এক ভাগ মাত্র। আর অনেকেরই যে সকালটা শুরু হয় কফি মেকারের কফি থেকে সেটিতে এর চেয়ে প্রায় হাজারগুণ বেশি বিদ্যুৎশক্তি লাগে।
এই প্রযুক্তিগত সরলতা ও ভীষণ কার্যকরী ক্ষমতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দারুণভাবে কাজে আসে, যার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সেনা সদস্য ও মিত্রশক্তির কমান্ডোরা তাদের বহনযোগ্য মোর্স ট্রান্সসিভার দিয়ে জার্মানির দখলকৃত অঞ্চলের ভেতর থেকে লন্ডনে যোগাযোগ রক্ষা করতো।
যদিও সেটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ জার্মানিরা সবসময় সবরকম তরঙ্গে আড়ি পেতে থাকতো। মোর্স কোডের ব্যাপারে যারা অবশ্য অজ্ঞ তারা বিষয়টি ধরতে পারতো না, আর মোর্স কোডে বাড়তি কোন নিরাপত্তাও যোগ করা থাকতো না।
কিন্তু এখন কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে কেউ একটা সফটওয়্যারের মাধ্যমে মোর্স কোড দ্বারা প্রেরিত বার্তা উদ্ধারে সক্ষম। তবে যে কোন বার্তাকেই নিরাপদ করা যেতে পারে সেটি পাঠানোর আগে তা এনক্রিপ্ট করে নিলে, যেটার প্রস্তাব ভাইল ১৮৪৫ সালেই দিয়েছিলেন।
আর এনক্রিপশন বা বার্তাকে সাংকেতিক ও গোপন কোডে নিয়ে আসার সবচেয়ে নিরাপদ যে উপায় “একবার ব্যবহৃত প্যাড”, সেটার জন্য একটা কলম আর কাগজ হলেই চলে।
“একবার ব্যবহৃত প্যাড” হল বিভিন্ন সব চরিত্রের একটা বুনন, যা ততক্ষণ পর্যন্ত করা হয় যতক্ষণ বার্তাটা এনক্রিপ্ট করার দরকার হয়।
প্রেরক নিজে একটা প্যাড ব্যবহার করে এনক্রিপ্ট করতে, অন্যদিকে গ্রাহক সেই প্যাডেরই একটা কপি ব্যবহার করে বার্তাটা ডিকোড করতে বা এর অর্থ উদ্ধারে (এর শুধুমাত্র এই দুইটা কপি থাকবে এবং ব্যবহারের পরপরই সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে)।
যতক্ষণ পর্যন্ত একটা নোটবুক আবারো ব্যবহার না হচ্ছে, তাত্ত্বিকভাবে সেটা তখনো গোপন থাকছে, এমনকি সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলেও। যদিও এলোমেলো বর্ণ বা প্রতীকের ব্যবহার করে সিকুয়েন্স তৈরি করা সত্যিই খুব কঠিন।
যদিও আজকাল দুর্দান্ত ও আধুনিক সব ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যম যুক্ত হচ্ছে, তারপরও এই যে সহজ আর কার্যকর সমন্বয়ে যে মোর্স কোড সেটাকে এখনো কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেনি, আর এটাই বার্তা আদান প্রদানের এই পদ্ধতিকে দেড়শো বছরের বেশি সময় টিকিয়ে রেখেছে। সূত্র: বিবিসি।