পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে পানিকে ভারতের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়

ছবি: সংগৃহীত
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার বেশকিছু দিক দক্ষিণ এশিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু নয়াদিল্লির সর্বশেষ নেওয়া পদক্ষেপ আঞ্চলিক সংঘাতের এক বিপজ্জনক নতুন পর্যায়ের সূচনা করতে পারে।
কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহতের একদিন পর বুধবারই (২৩ এপ্রিল) ভারত একতরফাভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ভিত্তি সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিত ঘোষণা করে।
পানি চুক্তি স্থগিতের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ একটি সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য আঞ্চলিক ভিসা সুবিধা বাতিল করা হয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও অবনতি করা। কাশ্মীরের পাহেলগাম হিল স্টেশনে যে ট্র্যাজেডি শুরু হয়েছিল, তা দ্রুত এক ভূরাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে — যেখানে অস্ত্র নয়, পানিই মূল ইস্যু হয়ে উঠেছে।
এই হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামের নতুন এক অখ্যাত গোষ্ঠী। যদিও এই অঞ্চলে ইতোমধ্যে এমন অনেক অস্পষ্ট নামে বিভিন্ন গোষ্ঠী তৎপর।
যদিও এই হামলায় বাইরের কেউ জড়িত এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ভারত পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি লক্ষ্য করে এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো দেশটির পানির উৎসকে লক্ষ্য একের পর এক পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইসলামাবাদে ইতোমধ্যেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক মহল এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভারত হয়তো আবারও ২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোট ঘটনার মতো শাস্তিমূলক সামরিক অভিযানও বিবেচনা করতে পারে। ওই আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এর জবাবে ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল।
পাকিস্তানও পাল্টা বিমান হামলা চালায় এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
পাহেলগাম হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
টেলিভিশনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার ভারতের নেওয়া সিদ্ধান্তকে ‘অপরিপক্ক ও উসকানিমূলক’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত এই হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ দেওয়া হয়নি।
যদিও সিন্ধু পানি চুক্তি নিজেই প্রকৃত ভয়ঙ্কর বিষয়
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বিরল ও স্থিতিশীল এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল। এটি চুক্তির আওতায় সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদীর পানি বণ্টন হয় এবং এটিই পাকিস্তানের প্রায় ৮০ শতাংশ মিষ্টি পানির উৎস।
এই চুক্তি কোনো সাধারণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নয়। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনের এক দলিল। পাকিস্তান এ যুক্তি তুলে ধরতে পারে যে বৈশ্বিক স্বার্থেই এমন কষ্টসাধ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় করা চুক্তি গুলোকে রক্ষা করা জরুরি।
এটি কেবল কূটনৈতিক কোনো দিক নয়— এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশই এই নদী ব্যবস্থার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। সীমিত বিকল্প উৎস— বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে আসা কয়েকটি নদী থাকলেও, কৃষিনির্ভর পাকিস্তানের ঝুঁকি প্রতিদিনের এবং চূড়ান্ত।
এই উত্তেজনা কেবল পাকিস্তান নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই গভীর উদ্বেগের। পানির প্রশ্নটি দক্ষিণ এশিয়ার উজানে ও ভাটিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
ভারতের ‘চুক্তি স্থগিত রাখা’র পদক্ষেপ— যা আইনি দৃষ্টিতে একটি অস্পষ্ট পরিস্থিতি এবং উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত তৈরি করে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও আঞ্চলিক রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে যৌথ এক সম্পদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়।
এই চুক্তি নিয়ে নিজেদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ নয়াদিল্লি গোপন রাখেনি। গত বছরও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে চুক্তির শর্ত পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে তা পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এই সপ্তাহে একতরফা এই ‘স্থগিতাদেশ’ সেই অসন্তোষেরই প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। হয়তো পাকিস্তানকে চাপ দিতে এটি নতুন কৌশল। তবে এর পেছনে আরেকটি গোপন লক্ষ্য থাকতে পারে, আর তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলা। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রকে, কারণ দেশটির কৃষি প্রধানত সিন্ধু নদীর পানির নির্ভরশীল।
বাস্তবে পানির সরবরাহ থামাতে বিশাল অবকাঠামো দরকার, যা বর্তমানে নেই। এমনকি আগামীকালও যদি এমন কোনো প্রকল্প শুরু করা হয় তবে তা বাস্তবায়নে কয়েক দশক লাগবে এবং খরচও হবে কয়েক বিলিয়ন ডলার।
তবে প্রতীকের শক্তিও অপরিসীম হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে, যেখানে স্মৃতি দীর্ঘ এবং অল্পতে রেগে জ্বলে ওঠে, সেখানে এমন প্রতীকী পদক্ষেপও বাস্তব পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশ ও নেপালের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোর জন্য এটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন সামনে আনে: ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত একটি পানি চুক্তি রাতারাতি স্থগিত করতে পারে, তবে বাকি দেশগুলোর জন্য কী নিশ্চয়তা রয়েছে?
এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদকে বিস্তৃত দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে এই অঞ্চলের তুলনামূলক শান্ত—ঢাকা, কলম্বো, কাঠমান্ডুকে সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে।
ভগ্ন রাজনীতির বলি হিসেবে—নদীগুলোর প্রতিশোধ বা কূটনীতির অস্ত্র হয়ে ওঠা এই উপমহাদেশ আর সহ্য করতে পারবে না।
মুক্তাদির রশিদ, নির্বাহী সম্পাদক, বাংলা আউটলুক
(ইংরেজি মূল লেখাটি এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করা হলো)