ভবেশ চন্দ্র রায় বনাম মানবেন্দ্র ঘোষ এবং ভারতীয় চাণক্য আলাপ
পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় হাসিনার যে মুখাবয়ব ব্যবহার করা হয়েছে তা মানিকগঞ্জের চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ তৈরি করেছেন—এ কথা ছড়িয়ে পড়ার পর তার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম বাসুদেবপুর। ওখানে থাকতেন ভবেশ চন্দ্র রায়। গত ১৭ এপ্রিল তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই-দুইবার বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতির ধরণ হলো, ‘এই হত্যাকাণ্ড অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো একটি পর্যায়ক্রমিক নিষ্পেষণের ধারা’। কী ভয়াবহ অভিযোগ এবং যে অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা।
কেন মিথ্যা তা আলাপ করতে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো’র ভবেশ চন্দ্র রায় বিষয়ক খবর নিয়ে একটু আলাপ করি। প্রশ্ন করতে পারেন, প্রথম আলো’র খবর কেন। এর উত্তর হলো, প্রথম আলো’কে অনেকেই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বাংলাদেশি হিস্যা হিসাবে অভিহিত করেন, সে কারণেই প্রথম আলো’র খবর। কী লিখেছে প্রথম আলো একটু দেখে নিই। প্রথম আলো তার স্থানীয় সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘বিরলের নাড়াবাড়ি ও ফুলবাড়ী বাজার এলাকায় অনেকেই দাদন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। একই সঙ্গে ওই এলাকা ভারতীয় মাদক চোরাচালানের পথ। ভবেশের মৃত্যুর সঙ্গে এগুলোর যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা’।
বিষয়টি দাঁড়ালো কী। দাড়াঁলো, এই মৃত্যুর সাথে ‘সংখ্যালঘু’ বিষয়টির কোনো যোগসাজশ নেই। এটা স্রেফ দাদন ব্যবসা কিংবা ভারতীয় মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত। এটাই হলো মূল আলাপ। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূল আলাপে নেই, তারা আছে যে দুজন ভবেশ চন্দ্র রায়কে ডেকে নিয়ে গেল তাদের নিয়ে। কারণ তারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম। যে দেশে প্রায় সিংহভাগ মানুষ মুসলিম, সেখানে চোরাচালান করতে গেলেও তো তাদের সাথে মিলেই করতে হবে। দাদন ব্যবসাও তাই। এই সত্যটাকেই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতের কাজই এই। ভবেশ চন্দ্র রায় যে দুটো ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন দুটোই অবৈধ। এক দাদন ব্যবসা, দুই চোরাকারবার, দুটোতেই ঝুঁকি রয়েছে। আইনের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি কিংবা আন্তকোন্দলে মৃত্যুর ঝুঁকি। ভারতের অতিপণ্ডিতরা এসব বিষয়কে এড়িয়ে সামনে এনেছেন ভবেশকে যারা ডেকে নিয়ে গেল তাদের এবং তারা মুসলিম বলেই তাদের সামনে আনা, যাতে কথিত সংখ্যালঘু তত্ত্বটা সামনে আনা যায়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার সম্ভব। এক হলো, দেশের ভেতরের পোষ্যদের সাহস জুগিয়ে সক্রিয় করা। দুই হলো, বাংলাদেশকে এক্সট্রিমিস্টদের স্বর্গরাজ্য হিসেব বিশ্বের কাছে পুনর্বার পরিচয় করিয়ে দেয়া। ঘুরেফিরে কথা ফ্যাসিজমের পুনর্বাসন। চিত্রনাট্য মূলত এটাই।
এছাড়াও রয়েছে ভারতে মুসলিমদের উপর বর্বর নির্যাতনের ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শক্ত বিবৃতি। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমদের উপর বর্বর নির্যাতন চলছে। বিশ্বের ঘৃণিত দশটি দেশের তালিকায় রয়েছে ভারত। তার কারণ মূলত ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন। অথচ স্বীকৃত এই ঘৃণিত দেশটি বাংলাদেশের প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এতদিন শুধু ভারত একচেটিয়া বানানো গল্পের ভিত্তিতে বিবৃতি দিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক বিরোধকে ধর্মীয় বিরোধ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। বিপরীতে দেড় দশকে এই প্রথম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের রাষ্ট্রীয় মদতে মুসলিমদের হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটা শক্ত বিবৃতি দেয়া হলো। এমন বিবৃতি স্বভাবতই ভালো ভাবে নেয়নি ভারত। সে কারণেই ভারত ভবেশ চন্দ্র রায়কে নিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পিত কাহিনি নিয়ে এতটা মেতেছে।
এখন আসি মানবেন্দ্র ঘোষের কথায়। তিনিও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত খ্যাতিমান একজন ভাস্কর। তিনি কোনো দাদন ব্যবসায়ী বা চোরাচালানি নন। তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকটা ঘোষণা দিয়েই। তাকে হত্যা করার হুমকি, দেখে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে প্রকাশ্য সামাজিকমাধ্যমে। ঘোষণার পরই তার বাড়ি পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়েছে। মানবেন্দ্র ঘোষের দোষ কী ছিল। তার দোষ ছিল সে এবারের বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন। যে কারণে ফ্যাসিবাদের সমর্থকরা তাকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। তারপর তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কই ভারতের এ ব্যাপারে কোনো বিবৃতি দেখলাম না। মানবেন্দ্র ঘোষ কি ‘সংখ্যালঘু’ নয়? নাকি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন ঘুমিয়ে ছিল! এখন পর্যন্ত মানবেন্দ্র ঘোষের জীবন রয়েছে শঙ্কার মধ্যে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে শঙ্কা কাটাতে কী কোনো বিবৃতি দিয়েছে? জানেন কেউ? জানেন না তো, তবে বোঝেন অবস্থাটা।
ভবেশ চন্দ্র রায় ও মানবেন্দ্র ঘোষের বিষয়টি ভালো করে তলিয়ে দেখলেই ভারতের সকল অভিযোগের অসারত্ব প্রমাণ হয়। ভারতের সকল অভিযোগের কারণ যে রাজনৈতিক তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ভারত তো সেই চাণক্যেরই অনুসারী, যে চাণক্য বন্ধুবেশে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে নিমন্ত্রণে ডেকে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করে। যারা এরপরও সংশয়ে ভোগেন, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
পুনশ্চ : বাংলাদেশের দৈনিক ডেইলি স্টার ভবেশ চন্দ্র রায় সম্পর্কিত তাদের খবরটি তুলে নিয়েছে। অবশ্য কেন নিয়েছে তার ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। এমন একটা খবর দিতেই হলো কেন, কিংবা তুলে নিতেই হলো কেন! যে খবর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে কোন্দল সৃষ্টি করতে পারে এমন স্পর্শকাতর খবর সম্পর্কে ভালোমতো যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করাটাও এক ধরনের অপরাধ। আজকে এই খবরকেই ক্যাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। যখন মাতৃভূমি অভিযুক্ত হয়, আর অভিযুক্ত হবার জন্য যারা দায়ী, তাদেরকে ইনডেমনিটি দেয়া কোনো কাজের কথা নয়। -