Logo
Logo
×

অভিমত

গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় শর্টকাট নেই

Icon

ড. তৌফিক জোয়ার্দার

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৩ পিএম

গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় শর্টকাট নেই

বিএনপির নির্বাচন চাওয়াটাকে অনেকেই নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খায়েশ বলে উপহাস করছেন। তাদেরকে বিনীতভাবে বলি, নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র হয় না, হলে হতে পারে বড়জোর একটা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র। পক্ষান্তরে, নির্বাচন ছাড়া একটা সরকারের স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তর ঘটা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকেনা। এর কোনো ব্যতিক্রম কোনো দেশে, কোনো কালে হয়নি। কাজেই বুঝে দেখেন, রেটোরিকের ধোঁয়াশার আড়ালে কে কী খেলা খেলছেন।

মানুষের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে আমি কেবল সম্মানই করিনা, আমি নিজেও তাতে শামিল। এমনকি বিএনপিও একবারের জন্য বলেনি যে তারা সংস্কার চায়না। যদিও ন্যারেটিভ দাঁড় করানোয় সিদ্ধহস্ত কেউ কেউ এমন কথা বিএনপির মুখে ছল করে বসিয়ে দিচ্ছে। এরাই যখন নির্বাচন দেরি করানোর কারণ, উপায়, ও সময়কাল নিয়ে সবক দেয়, তখন তাদের সদিচ্ছা ও মুখোশের আড়ালের চেহারাটা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়াটা কি খুব অন্যায্য?

সংস্কার কাকে বলে, কীভাবে হয়, কতদিন লাগে—এ সবগুলো প্রশ্নই কিন্তু আপেক্ষিক। এগুলোকে সামনে ঝুলিয়ে একটা অনির্বাচিত সরকারকে যতদিন খুশি ততদিন টেনে নেওয়া সম্ভব। সে খায়েশ যে কারও নেই, তার নিশ্চয়তা কে দেবেন? তারা যে ক্ষমতার মোহে পড়ে নিজেরাই দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে নিমজ্জিত হবেন না, তার জিম্মাদারই বা কে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না জেনেও যারা ‘মাত্র এক-দেড় বছর পর’, ’গণভোট করেই কেবল…’—এসব আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছেন, তারা আসলে দেশের মঙ্গল চান না ক্ষমতায় যেতে চান, সেটা বলার সৎসাহস তাদের থাকা উচিত। বিএনপির আছে; বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়, গণতান্ত্রিক উপায়েই তা চায়।

সংস্কারকে যারা একটা মনোলিথ বলে ভাবছেন, তারা হয় নির্বোধ, নাহয় খল। আর খলের ছলের অভাব হয় না। সেটাই তারা করছেন। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। কতদিন চলবে, কোন পথে বাঁক নেবে—তার কোনোই স্থিরতা নেই। আইসল্যান্ডে গণতন্ত্র এসেছে ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে, ইংল্যান্ডে ম্যাগনাকার্টা পাশ হয়েছে ১২১৫ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৮৭ সালে এবং সুইজারল্যান্ডে ১৮৪৮ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইসল্যান্ডে ১০০০, ইংল্যান্ডে ৮০০, যুক্তরাষ্ট্রে ২৪০, সুইজারল্যান্ডে ১৮০ বছর ধরে সংস্কার চলছে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৬০ বছর না হতেই আপনারা সব সংস্কারের শেষ দেখে এর পর নির্বাচন দিতে চান? এটা কি মূর্খতা না শঠতা?

গণতন্ত্রে উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অভাব, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, সমাজ-রাজনৈতিক বিভাজন, আইনের শাসনের অভাব, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বৈষম্য, রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ। যারা সংস্কার সংস্কার রব তুলছেন, নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আশপাশে যারা বিষ নিশ্বাস ফেলছে তাদেরকেও দেখুন। দেখতে পাবেন এদের অনেকেই ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দটা দেখলেই আঁতকে উঠে ‘অন্যকিছু’ ভাবেন (যার শিকার এনসিপি নিজেই হয়েছে), অনেকেই জনি অ্যাপল সিডের মতো বুনে চলেছেন অনন্ত বীজ, তবে তা বিভাজনের। রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আইনের শাসন, অর্থনৈতিক স্থিরতা ইত্যাদি কীভাবে দাঁড়াবে শক্ত মাটির ওপর? আর সামরিক হস্তক্ষেপ? তার কথা আর না-ই বা বলি। বুঝে দেখেন, কোন্ হ্যামিলনের বাঁশিতে হচ্ছেন দিগ্ভ্রান্ত শিশুর দল।

আমরা ইতিহাসকে আমাদের জীবনের মানদণ্ডে মাপতে চাই। আমাদের জীবন তো সত্তর-আশি বছরের, কিন্তু রাষ্ট্র বেঁচে থাকে হাজার বছর। মহাকালের মানদণ্ডে আমার জীবনকাল তো অতি নগণ্য। অথচ আমরা সব পরিবর্তন এই সময়কালের মধ্যেই প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশা করতে দোষ নেই, কিন্তু পরিণতিগুলোও জাজ্বল্যমান চোখের সামনে। শিশু ভ্রূণকে মায়ের জরায়ুতে থাকতে হয় নয় মাস। শিশুর প্রতি অতিভালোবাসায় তাকে যদি age of viability-র আগেই মাতৃজঠর থেকে বের করে আনেন, শিশু বাঁচবেনা। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাও মানুষের ও সমাজের সামগ্রিক পরিপক্কতা দাবি করে। সমাজ প্রস্তুত হওয়ার আগেই অতিউৎসাহী সংস্কারের খোয়াব দেশকে পরিণত করতে পারে ভেনেজুয়েলা, হাইতি অথবা জিম্বাবুয়েতে।

আমরা চাই একটা সত্যিকার মধ্যপন্থী, উদার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। মূঢ় হঠকারিতায় তাকে পাওয়া যাবেনা। তার জন্য লাগবে ঋষির মতো মৌন দৃঢ়তা ও অবিচল ধৈর্য। অভ্যুত্থান ঘটানো আর অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা রাষ্ট্রকে তিলে তিলে গড়ে তোলার জন্য সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী স্কিল সেটের দরকার হয়। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাপূর্ব একটা দলের মতো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছিল। আমরা কি এখন তেমনই একটা ‘দেজা-ভূ’ মোমেন্টের মধ্যে আছি? দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে বাস্তবে আসুন; আরেকটা ফ্যাসিবাদী ‘বন্দোবস্তে’ নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশ বহন করতে পারবেনা।

কোনো ফ্যাসিবাদীই দেশের অমঙ্গল হবে এমন চিন্তা থেকে ফ্যাসিবাদী হয় না। বরং উল্টোটাই ঠিক। দেশের অতিরিক্ত ভালো করতে গিয়ে নিজেরাই কখন ফ্যাসিবাদী দৈত্যে পর্যবসিত হয় তা নিজেই টের পায়না। যখন টের পায়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই বাংলায় একটা কথা আছে, ‘মার চেয়ে যার দরদ বেশি, তারে বলি ডাইনি’। দরদ দেখানোয় দোষ নেই, কিন্তু বাড়াবাড়ি করতে গেলেই বিপদ। এবং সে বিপদ সবারই।

গণতন্ত্রের যাত্রা অনেকটা ট্রেন যাত্রার মতো। ট্রেনটা গণতন্ত্রের লাইনে থাকাটাই কেবল দরকার। এরপরের ধাপ হলো, নজরে রাখা যে ট্রেন ঠিক পথে যাচ্ছে কিনা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ, ভৈরববাজার, কুমিল্লা, ফেনী, পাহাড়তলী পড়ছে কিনা। যদি দেখেন টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নাটোর পড়ছে, বুঝবেন ট্রেন ভুলপথে চলেছে, এর গতিপথ পরিবর্তন করা দরকার। ট্রেন আস্তে গেলে গতি বাড়ানোর দাবি তুলতে পারেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের দাপট বেশি হয়ে গেলে, কমিয়ে দিতে বলতে পারেন। কিন্তু ট্রেন লাইনে না থাকলে, সেই ট্রেনকে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রে’র নামে সোনায় মুড়িয়ে দিলেও লাভ হবেনা। তা গন্তব্যে পৌঁছুবেনা।

ট্রেনকে গণতন্ত্রের লাইনে তোলার প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তাতেই কি গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে? তা হয়তো হবেনা। গণতন্ত্র যে কেবলমাত্র নির্বাচন না, এটা আমরা বুঝি। প্রকৃত গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে সবার অধিকার ও স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা লাগবে, আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা লাগবে, সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা লাগবে, একটা অত্যন্ত প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ লাগবে। বিএনপির মতো বুর্জোয়া দলগুলো বারবার এগুলোকে পাশ কাটিয়ে, ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে চাইবে। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার, যে গণতন্ত্রের ট্রেনলাইনের ওপর আছে, শতচেষ্টাতেও সে দলটা ফ্রি পাস পেতে পারবেনা। আমরা তাকে লাইনে রাখার জন্য সবকিছু করব।

এটা একদিন দু’দিন, বা এক বছর দু’বছরে হবেনা। একটা স্থিতিশীল গণতন্ত্র পেতে ৫০ থেকে ১০০ বছর লাগে। নেটফ্লিক্স সিরিজ Peaky Blinders-এ দেখা যায়, বার্মিংহামের ১৯৩০ এর দশকের পুলিশের অবস্থাও আমাদের দেশের থেকে খুব একটা ভালো ছিল না। সিরিজটির মূল চরিত্র টমি শেলবি মাত্র ১০০ বছরেরও কম সময় আগে নানা অপকর্মের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছিল। আমি বলছি ইংল্যান্ডের কথা, যারা ১২১৫ সালে ম্যাগনাকার্টা পাশ করে, ১৬৮৮-তে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করে ১৯৩০-এর দশকেও আমাদের দেশের মতোই একটা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র নিয়ে ধুঁকছিল। তার ঠিক ১০০ বছর পর, বর্তমান ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল সংসদীয় গণতন্ত্র বলা যাচ্ছে। ১৯৩৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাওয়া Mr. Smith Goes to Washington-এর কাহিনিও অনেকটা একই রকম। সেখানেও ১৯৩০ এর দশকে মার্কিন রাজনীতিতে দুর্নীতি ও ছলচাতুরীর যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে খুব বেশি দুরে না।

ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের যে পথ পাড়ি দিতে কয়েকশ থেকে হাজার বছর লেগেছে, আপনারা যারা সেই পথ এক দেড় বছরে পাড়ি দেবার ছেলে-ভোলানো গল্প শোনাচ্ছেন, আপনারা আসলে আমাদেরকে কী ভাবেন? আওয়ামী লীগ যা বাংলাদেশের মানুষকে ভেবেছিল? নাকি আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করে আসলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতার একটা দেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার খোয়াব দেখেন? নাকি আপনারা স্রেফ সামনের দিনের সংগ্রামশীলতার চাহিদাকে উপেক্ষা করছেন ক্ষমতার সাময়িক আরামে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার অনন্ত পরীক্ষা পাশ করার কোনো শর্টকাট নেই। দীর্ঘ সময় ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ লড়াই জারি রাখতে হয়।ে

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন