
ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিক নির্মল সেন ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ শিরোনামে। যখন তিনি এই লেখাটি লিখছিলেন তখন দেশ জুড়ে ভয়াবহ বিশৃঙ্খল এক অবস্থা বিরাজ করছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখন বেশ নাজুক। চারিদিকে ডাকাতি ছিনতাই হত্যা খুন গুমসহ নামা অরাজকতা চলছিল।
নির্মল সেনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরপরই সারাদেশে ৪ হাজার ২০০ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। আর গণকণ্ঠে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালে এক বছরে গুপ্তহত্যা ১ হাজার ৪৬৭টি, ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে ৩১টি, ডাকাতি ২ হাজার ৩৯টি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১৭ হাজার ৩৪১টি।
একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, এককেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন, কালোবাজারি লুটপাট ধর্ষণ এসব কিছুই মানুষকে হতাশ করে তুলছিল। সমাজে সর্বস্তরে ভয় উৎকণ্ঠা আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। ফলে স্বাধীনতা ঘিরে যে স্বাদ আর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল তা যেন শুরুতেই একটা হোঁচট খেলো। কোনো কিছুই যেন নিয়ন্ত্রণে নেই! বরং রাজনৈতিক দমন পীড়নও শুরু হলো। এমনই পরিস্থিতি নির্মল সেনের ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ লেখাটি বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন দেশের কাছে কি এক করুন দাবি তুলেছিলেন সাংবাদিক নির্মল সেন!
আজ আমাদের সামনে আরেকটি প্রেক্ষাপট হাজির হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ যখন আরেকটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে আজ লিখতে বসেছি ‘নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি চাই’ ! কি অদ্ভুত এক পরিস্থিতি! যখন এই লেখাটি লিখছি তখন এই দেশের নারীরা অপমানে ক্ষোভে পথে নেমে এসেছে। রাতভর বিক্ষোভ করেছে। নারীদের উপর ধর্ষণ নিপীড়ন জবরদস্তিমূলক আচরণের প্রতিবাদেই আজকে বিক্ষুব্ধ হয়ে পথে নেমেছে মানুষ। যে নারীরা এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা প্রায় সবাই জুলাই অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনের সৈনিক। শেখ হাসিনার দানবীয় ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা । আমাদের নারীদের সেই সাহসী লড়াই বিশ্বের গণতন্ত্রকামী, মুক্তিকামী মানুষের ভেতর নতুন আশা জাগিয়েছিল।
সেই নারীদের যখন দমন করার স্পর্ধা দেখান কোন কোন গোষ্ঠী তখন এই দেশের মানুষ আবার ফুঁসে উঠেছে। শুধু তাই না, নারী পুরুষ সবাই নিরাপত্তার প্রশ্নে সরব হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েক দিনে ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। একই সাথে বেড়েছে চুরি ছিনতাই ডাকাতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, মব ভায়োলেন্স বন্ধে ব্যর্থতাসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগও দাবি করেছেন অনেকে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি গণঅভ্যুত্থানের পরও। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে এ বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে অন্তত ৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১০টি ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। এই সংখ্যা এখন আরো বেড়েছে।
মানুষ প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে। পথে নামছে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে ছিল একটি ভয়াবহ দুঃশাসনের অধীনে। জানমালের নিরাপত্তা যেমন ছিল না তেমনি দেশের নাগরিকদের কোন মর্যাদা ছিল না এই আওয়ামী গ্যাংয়ের কাছে। প্রতিনিয়ত অপমান অপদস্থ অনিরাপত্তা এবং এক অমর্যাদাকর জীবনযাপন করতে হয়েছে আমাদের। যার ফলে এক পর্যায়ে মানুষ জীবন দিয়ে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আওয়ামী বাহিনীকে মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ করেছে। পরাজিত করেছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে।
মানুষ আশা করেছে এইবার বোধ হয় তাদের দুঃখ বঞ্চনা লাঘব হবে। কিন্তু সরকারের দুর্বলতায় একদিকে যেমন অপরাধীরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অপরাধ করে যাচ্ছে অন্যদিকে পতিত সরকারের দোসররা বিভিন্ন রকম চক্রান্ত চালিয়ে মানুষকে আরো বেশি বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। বিপুল জনসমর্থনে মাধ্যমে বসা একটি সরকার সেই বাস্তবতাকে ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারছে না? স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভূমিকা জনমনে আরো অসন্তোষ তৈরি করছে।
মানুষ বলছে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করুন, শেখ হাসিনা গ্যাংয়ের মতো পদ আঁকড়ে বসে থাকবেন না। ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে যান। কেন ব্যর্থ হয়েছেন তা জনগণকে পরিস্কারভাবে জানান। নতুন কাউকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু এইভাবে চলবে আর কতদিন? আমরা কি বারবার শুধু জীবন দিবো? আমরা কি শুধু বিক্ষোভের ময়দানেই থাকবো?
আমরা কি ফসলের মাঠে যাবো না? কারখানায় যাবো না? বাজারে যাবো না? পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে যাবে না? আমাদের শিশুরা কি নিরাপদে এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারবে না? আমরা কি সারাজীবন শুধু জীবন দেওয়ার কথাই বলবো? এই অভ্যুত্থানের পরেতো নতুন করে শুরু হওয়ার কথা ছিল? কথা ছিল লড়াই শেষে আমরা ফিরে যাবো যে যার জীবনের কাছে স্বপ্নের কাছে।
কিন্তু আমরা ফিরতে পারছি না কেন? স্বাধীনতার ৫ দশক পরেও কি আমাদের এখনো স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইতে হবে? নাকি ভাষা বদলে নতুন করে বলবো ‘নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি চাই’
আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও অ্যাক্টিভিস্ট।