Logo
Logo
×

অভিমত

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির শেকড় এবং নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা

Icon

ফারহান আরিফ

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৮ এএম

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির শেকড় এবং নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা

লেখার শুরুতেই সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি)-কে শুভকামনা জানাচ্ছি। দলটির ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির বাইরে রাজনীতি করার ঘোষণাকে আমরা আমাদের আগামীর রাজনীতিতে একটি শুভ সঙ্কেত হিসেবে দেখতে চাই। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। এদেশের আপামর জনতার স্বপ্ন ছিল, দীর্ঘ শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বতন্ত্র ভূমি; স্বতন্ত্র সত্তা। এমন একটি দেশ আমাদের হবে, যেখানে রাজনীতিবিদরা সরকারে থেকে কিংবা বাইরে থেকে কেবল এই দেশটির কথাই ভাববেন। 

কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নতুন দেশটির শাসকগোষ্ঠী উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। বিদেশিদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি লাভ করলেও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মন-মগজ থেকে বিদেশিদের মান্য করার মানসিকতা দূর হয়ে যায়নি। ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, মার্কিনপন্থী, রুশপন্থী, চীনপন্থী রাজনীতির বাতাবরণে ঘুরতে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের কোনো স্বাধীন সত্তা অবশিষ্ট থাকলো না। 

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের এই মানসিক বন্ধ্যত্ব ঘুচালেন। একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ। জনগণের সামনে কোনো আলোর দিশা ছিল না। এমনই এক কণ্টক মূহূর্তে সিপাহি-জনতা কাঁধে করে জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে দিলেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে হলেন জিয়াউর রহমান। তিনি নিরাশ করেননি। জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে সাধারণ মানুষের মনের কথা শুনেছেন। জিয়া গ্রামে-গঞ্জে খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর মনের ভাব ধারণ করে তার রাজনৈতিক পথপরিক্রমা নির্ধারণ করেছিলেন। এদেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কথা চিন্তা করে সবাইকে একই ছাতার নিচে এনে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শন তিনি নির্ধারণ করেছিলেন—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জিয়ার জাতীয়তাবাদে কেবল বাংলাদেশই স্থান পেয়েছে; স্থান পেয়েছে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাপন, দর্শন এবং চিন্তা ভাবনা। 

এ কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, এদেশে সর্বপ্রথম সকল বিদেশপন্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জয়গান গেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনিই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে কেবল বাংলাদেশবাদকে প্রাধান্য দিয়ে পথ চলতে হবে। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের কণ্ঠে সেই ধারাবাহিকতা থেকেই উচ্চারিত হয়েছে, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে বাংলাদেশকে যখন বিদেশি পরাশক্তিদের শক্তি প্রদর্শনের কুরুক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বর্তমান কাণ্ডারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’। তিনি সম্প্রতিও একই সুরে বলেছেন, ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকতে পারে; কিন্তু কোনো প্রভু নেই। সুতরাং ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা থেকেই যাবে।’ বাংলাদেশের অতীত পরিক্রমা অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাই, বিএনপির ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সকল বিদেশপন্থী রাজনীতির অবসান ঘটেছে। ক্রমেই রুশপন্থী, চীনপন্থী রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে। ভারতপন্থী রাজনীতির কবর রচিত হয়েছে। পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিও বারবার পরাস্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এদেশের মানুষই কেবল টিকে থেকেছে। 

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির এই ধারাবাহিকতা থেকেই সদ্য প্রতিষ্ঠিত নতুন দলটির প্রধান নাহিদ ইসলামের কণ্ঠে ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করার ঘোষণা আমাদেরকে আশান্বিত করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের মানুষ যে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তার রাজনৈতিক দর্শন দেখতে উন্মুখ ছিল, শহীদ জিয়াউর রহমানের নির্দেশিত পথ ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তর একটা অংশ যে রাজনৈতিক দর্শনের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তরুণদের কণ্ঠে সেই অঙ্গীকারই ব্যক্ত হয়েছে বলে মনে করি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য, কর্মপন্থায় বৈপরীত্য থাকলেও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের প্রত্যাশা আমরা তাই করতেই পারি। যে গণতান্ত্রিক ঐক্য এবং বহুত্ববাদী রাজনীতির জন্য এদেশের মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামী পরিক্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সেই স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপ পাবে বলেই মনে করি। 

নবাগত রাজনৈতিক দলটির তরুণ কণ্ঠে উচ্চারিত বাংলাদেশ-প্রধান রাজনীতি আমাদের সামনে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণার বিস্তৃতি এবং জনপ্রিয়তাকেই তুলে ধরে। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, আজ থেকে ৪৫ বছর আগেই জিয়া বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ভাবনাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাকশালের উভয় ধারা, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির চর্চাকারী এবং স্বৈরাচারী শাসকরা এই সত্যটুকু ধারণ করতে পারেনি। তারা এদেশের মাটি ও মানুষের চিন্তাকে কখনো বন্দী করতে চেয়েছে, কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলস্বরূপ, জনগণ তাদেরকে গ্রহণ করেনি এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র মূলোৎপাটন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের পরিক্রমা সাক্ষ্য দেয়, এদেশে কেউ কখনোই বিদেশি অ্যাজেন্ডার প্রতিনিধি হয়ে কিংবা বিদেশিদের পদলেহন করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে হলেও বারবার তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ৭৫, ৯০ এবং ২০২৪ আমাদেরকে সেই শিক্ষাই দেয়। বাংলাদেশপন্থী মানুষদের এই আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং মাটির প্রতি দায়ের রাজনীতির বাইরে গিয়ে কেউই টিকতে পারেনি। 

নবাগত রাজনৈতিক দলটির কাছে তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তারা পথচলা শুরু করেছে সেটি যেন ব্যাহত না হয়। সামষ্টিক রাজনীতিকে ভুলে গিয়ে যেন দলটি এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থের হাতিয়ার হয়ে না দাঁড়ায়। আমাদের এই রক্তাক্ত পথচলার নতুন সারথিদের পথচলা সার্থক হোক। সার্থক হোক বাংলাদেশবাদী রাজনীতির ঐক্যবদ্ধ পথচলা। আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দ্যুতি প্রস্ফুটিত হোক বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক জনগণের মনে। রাজনৈতিক পথচলায় ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকুক এদেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি।  

লেখকঃ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। 


Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন