Logo
Logo
×

অভিমত

জুলাই বিপ্লবকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়ার চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:৪০ পিএম

জুলাই বিপ্লবকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়ার চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র

যখন ফ্যাসিস্ট রেজিমের মাস্টারমাইন্ডদের অপরাধ প্রমাণ করার সময়, শাস্তির দাবি তোলার সময়। তখন খোঁজা হচ্ছে বিপ্লবের ক্রেডিট। খবর হচ্ছে ছাত্রদল ও শিবিরের সংঘাত সংঘর্ষ নিয়ে। বাহাস হচ্ছে সোকল্ড ইসলামিস্ট ও সেকুলারিস্টদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে। হারিয়ে যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবের দৃশ্যচিত্র। জাতিসংঘের রিপোর্ট নিয়ে যে তুমুল আলোচনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ এসেছিল, তার বিন্দুমাত্র হয়নি। গত ফ্যাসিস্ট রেজিম যে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক তা প্রমাণ করার সুযোগ ছিল সে রিপোর্টে। কিন্তু গণমাধ্যম আশ্চর্য রকম নীরব ছিল সে ব্যাপারে। অথচ এটা যদি ফ্যাসিস্ট রেজিম ছাড়া অন্য কারো বিরুদ্ধে ঘটতো তাহলে অন্তত ছয় মাস গণমাধ্যম সরব থাকতো। এক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দিই, এক সময় কানাডার একটি আদালত কর্তৃক বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল আখ্যা দেয়া নিয়ে গণমাধ্যম কী তুলকালাম করেছিলো। বিপরীতে জাতিসংঘের রিপোর্টকেও ততটা পাত্তা দেয়নি সেই একই গণমাধ্যম।  

প্যাটার্নটা বুঝতে পারছেন তো। যেখানে ফ্যাসিস্ট রেজিমকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়া সম্ভব ছিল, সেখানে জুলাই বিপ্লবকেই অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা চলছে। যমুনা টিভির সোকল্ড নিকোল শোতে খুব সচেতনভাবে তৈরি করা হচ্ছে ছাত্রদলের চাঁদাবাজি ও শিবিরের রগকাটার বয়ান। অন্যরা তৈরি করছে তৌহিদি জনতার কর্মকাণ্ডের আলাপ। এর আগে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে মবোক্রেসির ন্যারেটিভ। এসবের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে জুলাই বিপ্লব। এসব করে বিপ্লবে জান দেয়া শহীদ ও জানবাজি রাখা আহতদের আড়াল করে দেয়া হচ্ছে গণমাধ্যম থেকে। বলুন তো, কারা লাভবান হচ্ছে এই বয়ান ও ন্যারেটিভ থেকে? নিশ্চিত বিপ্লব বিরোধীরা। 

প্রধানতম দল বিএনপির এক নেতা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে বললেন, ‘চাকর’। বিএনপি গণমাধ্যমের প্রতি আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল। কিন্তু তারপরেও গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের আধিপত্যের কাছে বিএনপি নস্যি। এর কারণ হলো বিএনপির এ ধরনের নেতারা। তাদের সফট পাওয়ার সম্পর্কে সম্ভবত কোনো ধারণা নেই। তাদের ধারণা নেই জুলকারনাইন শায়ের, তাসনিম খলিল, মুবাশ্বার হাসানের মতন সাংবাদিকরা যদি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ এর মতন একটি প্রতিবেদন না করতো। আয়নাঘরের বিষয়টি প্রচার না করতো, তাহলে সারাবিশ্বে ফ্যাসিস্ট রেজিম সম্পর্কে একটা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ধারণা দেয়া ছিল অনেকটাই অসম্ভব। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগানো গলাবাজ কোনো রাজনৈতিক নেতার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। হিসেব করে দেখুন তো, শেখ হাসিনার সামনে যে সম্পাদক-সাংবাদিকরা গদগদ হয়ে বসে থাকতেন, তাদের যেভাবে আপনারা চেনেন সাংবাদিক হিসেবে বিপরীতে বিএনপিপন্থী সাংবাদিক কজনকে চেনেন? কজনকে চেনেন যারা একটি ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারেন। আর যারা পারেন, তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনেকটা তাড়িয়ে বা সরিয়ে দেয়া হয়েছে বিএনপির বলয় থেকে। যেমন করা হয়েছে প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে। যার ফলেই যত দ্রুত ফ্যাসিজমের পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি হয়, বিএনপির পক্ষে তার ন্যূনতমটুকুও সম্ভব হয় না।  

বয়ান তৈরি ক্ষেত্রে বিএনপির দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেছেন, সাংবাদিক মুবাশ্বার হাসান। তিনি সামাজিকমাধ্যমে লিখলেন, ‘বিভিন্ন লেখা পড়ে মনে হচ্ছে  জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তারেক  রহমানের তেমন কোনো ভূমিকা নাই, আমার জানা মতে ব্যাপারটা উল্টা।  সাধারণ মানুষের  অনেকের মধ্যেও এই ধারণা বিরাজমান। কিন্তু তারেক সাহেবের দলের লোকজনেরই ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে হবে।  তারা কি চান তাদের নেতাকে স্বাধীনতার পরে  বাংলাদেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যুত্থানে সাইড নায়ক হিসেবে রাখবেন না জনগণকে তার  প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে জানতে দিবেন।’ এখানে তারেক রহমানের ভূমিকাটা প্রকাশ্য হবে কীভাবে, নিশ্চিত গণমাধ্যমের সহায়তায়। কিন্তু গণমাধ্যম হ্যান্ডেলিংয়ে বিএনপির ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে আওয়ামী ন্যারেটিভের পাল্টা বয়ান তৈরিতে ভয়াবহ রকম ব্যর্থতা রয়েছে তাদের। 

আমি যতটা জানি, তারেক রহমানের জুলাই বিপ্লবে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল। অথচ এ ব্যাপারে বয়ান তৈরি নিয়ে মিডিয়ার সাথে বিএনপির কৌশলগত যোগাযোগের বিষয়টি চোখে পড়েনি। দূর থেকে ওয়াহিদুজ্জমান অ্যাপেলো ভাই লিখছেন। তিনি সামাজিকমাধ্যমে লিখলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম, Asif Mahmud এবং Mahfuj Alam যদি কখনো নির্মোহভাবে কিছু লেখেন, হয়তো তারেক রহমান সাহেবের ভূমিকা প্রসঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখবেন।’ অর্থাৎ জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া প্রধান তিনজনের সাথে যোগাযোগ ছিল তারেক রহমানের। একই ভাবে অ্যাপেলো ভাইয়ের লেখায় উঠে এসেছে ভিপি নূর, রাশেদ খান ও তারেকের মতন ইয়ং লিডাররাও বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমানের পরামর্শে কাজ করেছেন বিপ্লবকে সর্বজনীন রূপ দিতে। আপনারা যদি বিস্মৃত না হন, তাহলে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের ডেডলাইন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সরে এসেছিলেন তারেক রহমানের সাথে আলাপের পরেই। এনিয়ে গণমাধ্যম খবরও করেছিল, ছাত্রনেতাদের কাছে তারেক রহমানের ফোনের বিষয়ে। এই তারেক রহমানকে গণমাধ্যম কতটা তুলে ধরেছে কিংবা বিএনপির পক্ষ থেকে কতটা তুলে ধরতে বলা হয়েছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরেই রয়েছে বিএনপির সাথে গণমাধ্যমের রসায়ন। 

ফিসে আসি আবার জুলাই বিপ্লবকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়ার চেষ্টার বিষয়ে। কেন এই চেষ্টা? এই চেষ্টার মূল কারণ হলো কারো কারো ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখার প্রয়াস। বলতে পারেন কতিপয় বুড়োদের ব্যর্থতা। অন্যার্থে বলতে পারেন বুড়োদের ঈর্ষার শিকার তরুণ নেতৃত্ব। দেশের মানুষ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভুল রাজনৈতিক কৌশলের কারণে ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি চব্বিশের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত। আর এই ভুল কৌশল ছিল বুড়োদের। যে কারণেই বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমান অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে যোগাযোগ রাখছিলেন তরুণ-যুবা নেতৃত্বের সাথে। তারেক রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, তরুণরা অন্তত ফাঁদে পা দেবে না। লোভের কাছে পরাজিত হবে না। আপোষকামী হবে না। তারেক রহমানের দূরদর্শিতার প্রমাণ জুলাই বিপ্লব এবং আগস্ট ভিক্টোরি। 

এই ভিক্টোরি কোনো কোনো বুড়ো নেতাকে ঈর্ষাপরায়ণ করে তুলেছে। জুলাই বিপ্লবের সফলতা তাদের সকল রাজনৈতিক জীবনকে ম্লান করে দিয়েছে, তাদেরকে ম্লান করে দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট রেজিমকে বিতারণের কথা উঠলেই তাদের নামের আগে বসে যায় তরুণ-যুবাদের নাম। এটা মেনে নেয়া অনেক বুড়োদের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। যেমন এক সময় তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন কতিপয় ‘বুড়ো’ নেতা। কিন্তু তারেক রহমান তার নেতৃত্বের গুণে আজ বিএনপির কাণ্ডারি। যোগ্যতাকে মেনে নিতে হয়। তেমনি জুলাই বিপ্লবের তরুণ-যুবাদের মেনে নিতে হবে। আর না নিলে ইতিহাস বুড়োদের ব্যর্থ হিসেবে অভিহিত করবে এবং কাউকে কাউকে মীর জাফর। 

ফুটনোট : আপনাদের পরিষ্কার হতে হবে, জুলাই বিপ্লবকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়ার চেষ্টা একটা ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রের শেকড় আমাদের দেশে নয়, ডালপালা শুধু আমাদের দেশে। যার ফলে শেকড় কাটা মোটেই সহজ কাজ নয়, আপাতত আমাদের ডালপালা কেটেই চলতে হবে।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন