জুলাই বিপ্লব
সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগীদের

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম
-67b5d5a22c689.jpg)
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি বিরল সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে আওয়ামী লীগ এই অভ্যুত্থানে পরাজিত হয়েছে, কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, তারা আসলে এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এই বিপ্লব তাদের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। তবে তারা এই সুযোগ কাজে লাগাবে কি না, তা সম্পূর্ণ তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতাদের জন্য নতুন সুযোগ
গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী, হাইব্রিড নেতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর হাতে ছিল। শেখ হাসিনা তার চারপাশে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন যারা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশলে পারদর্শী। ফলে আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতারা রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েন এবং নিজেদের মত প্রকাশের কোনো সুযোগ পাননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ইউনাইটেড ফ্রন্টের বিজয় (১৯৫৪), শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ (১৯৬২), ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬), গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন - এসবই প্রমাণ করে যে আওয়ামী লীগ একসময় ছিল আপোষহীন গণতান্ত্রিক শক্তি। কিন্তু শেখ মুজিবের ১৯৭১-পরবর্তী সময়ের একদলীয় শাসন, এবং পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রকৃত ত্যাগী নেতাদের দমিয়ে রেখেছেন, যারা আওয়ামী লীগের আদর্শিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে পারতেন।
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান সেই সব নেতাদের জন্য একটি নতুন আশার বার্তা নিয়ে এসেছে, যারা আওয়ামী লীগের পুরোনো রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে চান। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার মধ্যে ন্যায্য অবস্থান প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাননি। তবে, জনগণের মাঝে আবারো সেই রাজনৈতিক চেতনা ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা একসময় আওয়ামী লীগের গণমানুষের দল হিসেবে পরিচিত হওয়ার ভিত্তি তৈরি করেছিল।
ভারতকেন্দ্রিক নীতির বিরোধিতা বাড়ছে
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ত্যাগী নেতারা ক্রমশ বুঝতে পারছেন যে, শেখ হাসিনার ভারতকেন্দ্রিক নীতিমালা দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে। শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় যে তিনি ১৯৭১-এর পূর্বে ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবেই দেখতেন। অথচ ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের কূটনৈতিক বলয়ে পুরোপুরি ঢুকে পড়েন। শেখ হাসিনার ভারত-নির্ভরতা সেই প্রবণতাকে আরও চরম আকার দিয়েছে।
ভারতে বসে তার বিভিন্ন অডিও-ভিডিও বার্তা প্রকাশ, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা নিয়ে নিরবতা, মোদির আমেরিকা সফরের সময় আমেরিকা প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এবং আওয়ামী লীগরা ভেবেছিল যে মোদি সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ম্যানেজ করে তাদের পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে পারবে, তা আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের কাছেও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, এবং এই অবস্থায় ভারতপন্থী রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হতে যাচ্ছে।
তারা এটাও অনুধাবন করতে পারছেন যে শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন আসলে সাময়িক এবং কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন আনতে তারা শেখ হাসিনাকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বিজেপির মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গকে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসা, এবং এটি করতে তারা বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। শেখ হাসিনা কার্ড ব্যবহার করে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো আলোচনায় এনে, তখন তা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের মধ্যে বিজেপির জন্য সহানুভূতি তৈরি করবে। মোদি সরকার চায় পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে দেখাতে যে, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি অস্থির রাষ্ট্র, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই প্রচারণা পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের বিজেপির পক্ষে আনতে সাহায্য করবে।
আওয়ামী লীগের শিকড় কতটা গভীর?
বহির্বিশ্বে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে বলার চেষ্টা করছেন যে আওয়ামী লীগের শিকড় এত গভীরে যে কেউ চাইলে দলটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে না। কিন্তু এই চিন্তাধারা পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত এবং তারা অতীত থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করছে না। সত্যি কথা হলো, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলেও, ইতিহাস বলে দেয় যে শক্তিশালী শিকড় থাকা সত্ত্বেও ভুল রাজনীতির কারণে অনেক রাজনৈতিক দল বিলীন হয়ে গেছে। এর বড় উদাহরণ হলো মুসলিম লীগ।
১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ ছিল তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে মুসলমানদের শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই দল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ প্রতিটি গণ-আন্দোলনে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মুসলিম লীগ জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে। এত গভীর শিকড় থাকা সত্ত্বেও, দলটির নেতৃত্ব সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে ক্রমাগত রাজনৈতিক ভুল করতে থাকে এবং একসময় সেটি বিলীন হয়ে যায়।
একই ভুল করেছিল ভারতের কংগ্রেস। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া কংগ্রেস ছিল ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তারা একের পর এক ভুল রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। দলটি যখন আমলাতান্ত্রিক, পরিবারকেন্দ্রিক এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখনই এটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিজেপির উত্থানের ফলে আজ কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতিতে একটি প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে? নাকি এখনো সেই অহংকার ও আত্মতুষ্টির মধ্যে রয়েছে? আওয়ামী লীগ মনে করছে, শুধু শক্তিশালী শিকড় থাকার কারণে তারা চিরস্থায়ী থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি তারা জনগণের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতও মুসলিম লীগ বা কংগ্রেসের মতো হতে পারে। আওয়ামী লীগের যে অংশ এখনো মনে করছে, ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা এবং দলীয় স্বার্থ রক্ষা করলেই ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব, তাদের জন্য ইতিহাস একটি কঠিন বার্তা দিয়ে রেখেছে জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো দলই চিরকাল টিকে থাকতে পারে না।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, আওয়ামী লীগ এখনো মুসলিম লীগের মতো বিলীন হয়ে যাবে না, কারণ তাদের সংস্কৃতিজোট, কূটনৈতিক সংযোগ এবং বিভিন্ন ধরনের সফট পাওয়ার এখনো অটুট আছে। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক মহলে এখনো গ্রহণযোগ্য এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সহানুভূতি তাদের পক্ষে আছে, যা ভবিষ্যতে তাদের আবার ক্ষমতায় আনতে সহায়ক হতে পারে। যারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার এখনো শক্তি, তারা হয়তো বড় ভুল করছেন। আজকের বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির কারণে সত্য গোপন করা কঠিন হয়ে গেছে। অতীতে হয়তো রাজনৈতিক দমনপীড়ন, নিপীড়নের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন প্রতিটি অপরাধের সাক্ষী হিসেবে মানুষের হাতে আছে ভিডিও, ছবি এবং সরাসরি অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগ যতই চেষ্টা করুক, যারা নির্যাতিত হয়েছে, যারা তাদের স্বজনদের হারিয়েছে, যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের হৃদয় থেকে এই স্মৃতি কখনো মুছে ফেলা যাবে না। প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য এই স্মৃতিগুলো রাজনৈতিক বাস্তবতার চেয়েও বড় সত্য হয়ে থাকবে।
তাই যারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ অতীতের মতো আবারো জনগণের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে, তারা বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ এত গভীর যে, রাজনৈতিক কৌশল বা সফট পাওয়ার দিয়ে এই ক্ষোভ প্রশমিত করা সহজ হবে না। আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতারা মনে মনে এটা বুঝতে পারছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। তবে জুলাই বিপ্লব আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতাদের জন্য একটি বিরল সুযোগ তৈরি করেছে, যাতে তারা ভাবতে পারে—আওয়ামী লীগ কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে, নাকি অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে?
আওয়ামী লীগের জন্য বাস্তবতা—নির্বাচন ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব
আওয়ামী লীগ বর্তমানে খুবই কৌশলীভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে - তারা বারবার নির্বাচনের কথা বলছে এবং নির্বাচনকে তাদের রাজনীতির কেন্দ্রে রাখার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা এটি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছেন যে টিকে থাকতে হলে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে- হোক সেটা আওয়ামী লীগের ব্যানারে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
এখানে বড় একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। যারা বারবার বলছেন, "সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে," তারা হয়তো বাস্তবতার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক মিস করছেন। হ্যাঁ, রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি, কিন্তু নির্বাচন এড়িয়ে গেলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। যদি রাজনীতিতে জনগণের মনের মধ্যে একবার ঢুকে যায় যে সরকার ও সরকার সমর্থকরা নির্বাচন চায় না, তাহলে জনগণ রাস্তায় নেমে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে।
বাংলার কৃষক-শ্রমিকরা ঐতিহাসিকভাবেই ভোটাধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাতিল না করলে হয়তো বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনই হতো না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ভোট কারচুপি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া হাইজ্যাক করে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিলেন, যার ফলে জনগণের অসন্তোষ চরমে পৌঁছায় এবং ১৯৭৫ সালে তিনি ও তার পরিবার হত্যার শিকার হন। পরবর্তীতে, জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করেছিলেন, যা তাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। একইভাবে, এরশাদ যখন ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখন জনগণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে।
আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮, এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিন্তু এখন তারা নির্বাচনী বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ তারা জানে জনগণের মনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সংবেদনশীলতা আছে। এই কারণে, যারা বারবার "সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে" বলছেন, তাদের বোঝা দরকার যে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখন আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে নির্বাচনী বার্তা দিতে চাচ্ছে, কারণ তারা জানে, নির্বাচনের বাইরের যেকোনো পরিকল্পনা তাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। অতএব, জুলাই বিপ্লব আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতাদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে এসেছে। তারা উপলব্ধি করেছেন যে আওয়ামী লীগের টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
আওয়ামী লীগের সামনে করণীয়
১. জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া - আওয়ামী লীগকে তিনটি বিষয়ে জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবে: (ক) ১৯৭১-৭৫ সময়কালের একদলীয় শাসনের জন্য, (খ) ২০০৯-২০২৪ সময়কালের গুম, হত্যা,দমন-পীড়নের জন্য, এবং (গ) ২০২৪ জুলাই মাসে সংঘটিত গণহত্যার জন্য । প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই ক্ষমা প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারেন এবং জনগণের কাছে অনুরোধ জানাতে পারেন যেন তারা আওয়ামী লীগের অতীত ভুলগুলো ক্ষমা করে এক নতুন অধ্যায় শুরুর সুযোগ দেয়।
২. নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা - শেখ হাসিনার পরিবারকে রাজনীতি থেকে বিদায় জানাতে হবে এবং নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে।
৩. ভারত নির্ভরতা কমানো - আওয়ামী লীগকে ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
৪. ভবিষ্যতে নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা - আওয়ামী লীগকে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে - তারা কি শেখ হাসিনার ব্যক্তিকেন্দ্রিক, লুটেরা ও সুবিধাবাদী দলে পরিণত হতে চান, নাকি তারা কি শেখ মুজিবের ১৯৭১-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক কৌশল ও আন্দোলনের ধারা ফিরিয়ে আনতে চান? জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে, নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, ভারত নির্ভরতা কমিয়ে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে পারে। অন্যথায়, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
লেখক: মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়