
আমি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বোধ-বুদ্ধি কম বিধায় বোদ্ধারা যে সকল পেশায় কাজ করেন সেদিকে নজর দেয়ার সাহস করিনি। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখা কম করতাম বিধায় নিজের অফুরন্ত সময় ছিল আর সেই অলস সময়ে মাথায় উদ্ভট চিন্তা/প্রশ্ন ভর করতো। নিজের চিন্তা/প্রশ্নগুলো উদ্ভট হওয়ায় সব সময় নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতাম। পাছে উদ্ভট চিন্তার জন্য শিক্ষক / বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়। যায় হোক, লেখার প্রসঙ্গে আসি, জাতিসংঘ ১২৩ পৃষ্ঠার এক বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করলো, সারা দেশের সকল মিডিয়া শোরগোল ফেলে তা প্রকাশও করলো। আরো একটি বিষয় নিয়ে মিডিয়া গরম ছিল। তা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শন এবং তার সচিত্র প্রতিবেদন।
মোটাদাগে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে যা পেলাম
জুলাই আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার, প্রতিবাদকারীদের নির্মমভাবে দমন করতে চেষ্টা করেছিলেন, যার ফলে ১৪০০ জন নির্মম হত্যার শিকার হন।
শেখ হাসিনা এবং তার সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং জড়িত।
বিক্ষোভকারীদের প্রাণঘাতী যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে গুলি করে ক্ষেত্রবিশেষে পয়েন্ট ব্ল্যান্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, অন্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন করা হয়েছে।
জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে নিহত ১৪০০ জনের মধ্যে ১৩% পর্যন্ত শিশু ছিল।
লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা, যার মধ্যে মেয়েদের শারীরিকভাবে আক্রমণ এবং ধর্ষণের হুমকি, ধর্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা স্বয়ং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের গ্রেফতার করে হত্যার পর লাশ গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনে, আমরা আয়নাঘরের চিত্রসহ কিছু বর্ণনা পেলাম।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং গত দুই দিনের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমি নতুন কিছু পাইনি। হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের প্রতিবেদন জরুরি ছিল, আমাদের এতদিনের চিৎকার-কান্না আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো, একথা সত্য। কিন্তু এর সকল তথ্য আমার এবং আমাদের সকলের বহু বহু আগে থেকেই জানা ছিল। কেউ কেউ ভারী কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আপনার কাছে আয়নাঘরের ছবিগুলো কি নতুন নয়? সহজে উত্তর দিচ্ছি, না, নতুন নয়। কিভাবে? কর্নেল হাসিনসহ অন্য মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা যে পরিমাণ বর্ণনা আমাদের দিয়েছিলেন তা থেকে মিডিয়ার এই ছবিগুলো আমার মনে আগে থেকেই ছিল। হুবহু এমনই ছিল।
আচ্ছা পুরোনো প্যাচাল বাদ দিয়ে লিখতে বসলাম কেন সে প্রসঙ্গে আসি, খেটে খাওয়া এই মূর্খ /স্বল্প শিক্ষিতের মাথায় কিছু উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বোদ্ধারা এর সুন্দর উত্তর দিয়ে আমাকে তুষ্ট করবেন:
১। আমি এবং আমার মতো অনেক মূর্খই বিশ্বাস করে যে, জুলাই আন্দোলন কোটার উপর ভিত্তি করে শুরু হয়েছিল মাত্র, কিন্তু তা শুধু কোটার আন্দোলন ছিলো না। জুলাই আন্দোলন ছিলো , অত্যাচার-নির্যাতন, গুম -খুন আর অধিকার হরণের দীর্ঘ পনেরো বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ। আচ্ছা তাহলে এই দীর্ঘ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কেন্দ্রস্থল আয়নাঘর পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টার এতো সময় লাগলো কেন?
২। পরিদর্শনের ছবিতে দেখলাম দুটি ঘর ভেঙে একটি করা, আলোর ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছে। ইতিপূর্বের বর্ণনায় প্রাপ্ত নির্যাতনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে একটিমাত্র ঘূর্ণায়মান চেয়ার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট্য নেই। আচ্ছা গুম-খুনের আলামত নষ্ট করা কি ফৌজদারি অপরাধ? দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়ার পরেও এই অপরাধ যারা করেছেন, তারা কারা? তারা কি বিচারের আওতায় আসবেন?
৩। অনেক দুঃসাহসী (বুকের ছাতি ৪৮ ইঞ্চি বা তারও বেশি) মিডিয়া সেন্টার দেখলাম আয়নাঘরকে কচুক্ষেতের বন্দিশালা বলে উল্লেখ করার মত সাহস দেখাতে পেরেছেন। কচুক্ষেত উচ্চারণ করার দুঃসাহস দেখানোয় সকল মূর্খের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি আর প্রশ্ন করতে চাচ্ছি, "নাদের আলী, আমি/আমরা তরুণরা আর কত রক্ত দিবো, আর কত অপেক্ষা করবো, আর কত সময় পেরোলে তুমি বিচার না চাও, শুধু নামটুকু উচ্চারণ করার সাহস করবে?"
আর প্রশ্ন করবো না, কলেজ জীবনের একটা ঘটনা শেয়ার করি। আমাদের শহরে একবার এক বেপরোয়া ট্রাক এক মোটরসাইকেল আরোহীকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। আমার কয়েক জন বন্ধু কাছেই উপস্থিত ছিল। অন্য মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ট্রাকটি তাড়া করে পরের মোড়েই ধরে ফেলে। বীরত্বের সাথে ট্রাকটিকে ভস্মীভূত করতে সক্ষম হয়। ট্রাকটি ভস্মীভূত করতে কে কিভাবে কি করেছে, স্বভাবজাতভাবে সবার বীরত্বগাথা শুনতে শুনতে আমি মূর্খ এক অবান্তর প্রশ্ন করে বসলাম, "দোস্তরা, ট্রাকটার কি অপরাধী ছিল? হঠাৎ বীর বন্ধুদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ট্রাক ড্রাইভার কোথায়? ড্রাইভারের পাশে তো হেল্পারও থাকে, সে কোথায়? ফ্যাকাসে মুখে সনি বললো, দুইজনই মনে হয় পালিয়ে গেছে, আমরা ট্রাকে আগুন ধরাতে এতো বেশি ব্যাস্ত ছিলাম যে, ড্রাইভার আর হেল্পারকে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করতে ভুলে গেছি। আবার প্রশ্ন করলাম, দোস্ত, কেউ কি তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল? আবারো সবাই নিশ্চুপ। আমার বন্ধুরা কলেজ পড়ুয়া বাচ্চা মাত্র। ওদের মাফ করে দিবেন।
লেখার প্রসঙ্গে আসি, আচ্ছা কি যেন নাম, আতশি/ ডায়মন্ড / কাচ...কি যেন ঘর ? ও মনে পড়েছে, আয়নাঘর । আয়নাঘর কি অপরাধী?
আমার বুকের ছাতি মাত্র ৩২ ইঞ্চি, সাহসের 'স'-ও নেই। ৪৮ ইঞ্চি ছাতি হলে আর সাহস থাকলে আজকে প্রশ্ন করতাম, আয়নাঘর এর কুশীলবরা কোথায়?
আলামত ধ্বংসের কুশীলবরা কোথায়?
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লিখিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যায় জড়িত নেতারা কোথায়?
উক্ত নেতাদেরকে নিরাপদে রাখতে কারা আশ্রয় দিলো? পালিয়ে যেতে কারা সহযোগিতা করলো? তারা কোথায়?
আয়নাঘর পরিদর্শন করতে ৬ মাস লেগে গেলো? কুশীলবদের ধরতে কতদিন লাগবে? ৬ বছর, ৩৬ বছর, না আরো বেশি?
জাতিসংঘকে প্রশ্ন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে র্যাব বিলুপ্ত করতে হবে, তাহলে দল কেন বিলুপ্ত করা যাবে না? ড. ইউনূসের মতে, সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ছেড়ে অন্য ভালো রাজনৈতিক দলে মিশে গেলে সমস্যা কোথায় ?
শুধু ৪৮ ইঞ্চি ছাতি নাই বলে আজ প্রশ্নগুলো করতে পারলাম না।
প্রধান উপদেষ্টা স্যার, আপনাকে একটি কথা বলতে চায়। আপনি যদি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে সূর্য হন তাহলে আপনার উত্তাপই সবথেকে বেশি থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, সূর্যের চেয়ে বালি গরম। বালির গরমে কি সূর্যও ঝলসে যাচ্ছে? স্যার, আপনার মুখটিও তামাটে লাগছে কেন?