Logo
Logo
×

অভিমত

একটা চেয়ার ও ডগমা আক্রান্তদের আলাপ

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম

একটা চেয়ার ও ডগমা আক্রান্তদের আলাপ

অনেকে অনুযোগ করেন, কোনো বিষয়ে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নেই কেন, এ ব্যাপারে। এর উত্তর আমি আগেও দিয়েছি, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বেশিরভাগ ক্ষেতেই আবেগ প্রসূত হয়ে থাকে, তাতে খুব বেশি লজিক থাকে না। আয়নাঘরের চেয়ারের কথাই দেখুন। অনেকেই সেই লোহার তৈরি চেয়ারের ছবি দেখেই ট্রল করা শুরু করলেন। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু তো কাঠের চেয়ার কেন বৈদ্যুতিক শক দেয়ার জন্য ব্যবহার হয়, কেন লোহার চেয়ার নয়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা প্রবন্ধ লিখে ফেললেন ফেসবুকে। সাথে রীতিমতো ট্রল করলেন ড. ইউনূস ও তার সরকারকে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকে আয়নাঘরের বিষয়টিকে নাটক বলে আখ্যা দিলেন। উনাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সঙ্গতই প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। কেন স্বাভাবিক সে ব্যাপার আলাপেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

চেয়ারের ছবি দেখেই সবাই ধরে নিলেন এটা গুম হওয়া ব্যক্তিদের বৈদ্যুতিক শক দেয়ার কাজে ব্যবহার হতো। গণমাধ্যমও তেমনটাই লিখলো। বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে এই একটা সমস্যা, যোগ্য জায়গায় যোগ্য লোক না থাকাতে এবং দখলদারিত্ব সাথে স্বজনপ্রীতি এই মাধ্যমটাকে ফোকলা করে দিয়েছে। একটা বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে মিনিমাম যে হোম বা গ্রাউন্ড ওয়ার্কের প্রয়োজন তা এই গণমাধ্যমকর্মীদের মাথাতেই নেই। যার ফলে তাদের তাৎক্ষণিক লেখায় আবেগ থাকে কিন্তু লজিক থাকে না। চেয়ার যে শুধু বৈদ্যুতিক শক দেয়ার কারণেই ব্যবহৃত হয় এই বৃত্তবদ্ধ ধারণা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীদের। যার ফলেই সামাজিকমাধ্যমের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সামাজিকমাধ্যমে অনেকেই এই চেয়ারকে ‘স্পিনিং চেয়ার’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই চেয়ারে বন্দিকে বসিয়ে প্রচণ্ড জোরে ঘোরানো হতো। এটাও অত্যাচারের একটা ভয়াবহ ধরণ। হাত-পা এবং মাথা বেঁধে একজন বন্দিকে এভাবে ঘোরানোর মাধ্যমে পৈশাচিক অত্যাচার করা হতো। চেয়ারটাতে বসে তার ডেমোও দিতে হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। সাথে যারা এই চেয়ারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের বর্ণনাও যুক্ত হয়েছে। এতসবের পরও কেউ কেউ তাদের আবেগের জায়গাতেই রয়েছেন, লজিকের বিষয়টিকে ধর্তব্যের মধ্যে নেননি। 

কীভাবে নেবেন? ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতনের পরই আয়নাঘর মানুষের চোখের সমুখে আসে। তখনই ডিবি ও র‌্যাবের আয়নাঘর বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো দেখিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট রেজিমের দোসরদের গোল্ডফিস মেমোরি সেসব দৃশ্য বিস্মৃত হয়েছে। ফলে, ড. ইউনূস সরকারের আনুষ্ঠানিক ভাবে আয়নাঘর পরিদর্শনের বিষয়টি নাটক হিসেবে তাদের চোখে ধরা দিয়েছে। তারা বলছেন, ছয়মাস ধরে ড. ইউনূস এই আয়নাঘর তৈরি করে পরে দেখিয়েছেন। অথচ এই ঘরের অনেকটাই আমরা ৫ আগস্টের পরেই দেখেছি গণ ও সামাজিকমাধ্যমের কল্যাণে। 

যারা এটাকে নাটক বলছেন, তারা জাতিসংঘের রিপোর্টকে কী বলবেন? জাতিসংঘও কি নাটকের অংশ? জাতিসংঘের দলও তো এসকল আয়নাঘর পরিদর্শন করে গেছে। তারাও এর সত্যতা পেয়েছে এবং তাদের রিপোর্টের ব্যাপকতা ড. ইউনূসের পরিদর্শন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার চেয়েও বেশি। অথচ ফ্যাসিস্ট রেজিমের দোসররা একটা চেয়ারকে উপলক্ষ্য করে পুরো ব্যাপারটাকে ট্রলে পরিণত করার অপচেষ্টা করেছে। এরা এতটাই ডগমাটিক যে, মাইকেল চাকমা’র গুম জীবনের বক্তব্যও তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। অথচ অন্যক্ষেত্রে পাহাড়িদের কথা তাদের কাছে অনেকটা বাইবেলের মতন। একজন উকিল আছেন, ইমতিয়াজ মাহমুদ নাম। তিনিও ফ্যাসিস্ট রেজিমের অন্ধ অনুসরণকারী এবং পাহাড়িদের স্বঘোষিত কাণ্ডারি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিষয়ে তিনি মাইকেল চাকমার ব্যাপারেও অন্ধ ও বধির। 

মানসিক সুস্থতার কথা কেন বলেছি, তা নিশ্চয়ই আপনাদের বোধে আসতে শুরু করেছে। গত দেড় দশক ধরে ইচ্ছে হলেই মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া। অন্ধকার ছোট্ট একটা ঘরে দীর্ঘদিন আটকে রাখা। অত্যাচারের নানা প্রক্রিয়া, উপকরণ ব্যবহার করা। ইচ্ছে হলেই গুলি করে লাশ খালে-বিলে-রাস্তায় ফেলে রাখা। পঙ্গু করে দেয়া। এসব জানার পরও যারা আয়নাঘর নিয়ে নির্বিকার ট্রল করতে পারে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য আর যাই হোক, সুস্থ নয়। 

এমন অসুস্থ কিছু মানুষই জুলাই বিপ্লবের সাথে যুক্তদের ‘লাল বদর’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কতটা পৈশাচিক চিন্তা থেকে এমন কথা উৎসারিত হতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো দৃশ্যচিত্র আমাদের সমুখে নেই। আমরা কল্পনাতেই ভেবে নিই, কতটা অত্যাচার হয়েছিল মানুষের উপর। আমরা ঘৃণা করি যারা এই অত্যাচারের সাথে জড়িত ছিল তাদের। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের নৃশংসতা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে রয়েছে গণ ও সামাজিক মাধ্যমে। যা চোখ দিয়ে দেখতে গেলেও মনের সর্বোচ্চ শক্তি জড়ো করতে হয়। চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। বুক মুচড়ে ওঠে। অথচ মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষগুলোর কোনো অনুভূতিই জাগ্রত হয় না। তাদের অনুভূতি জাগ্রত হয় ইট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ দেখে। কেউ কেউ তো বিপ্লবীদের মৃত্যু নিয়েও ট্রল করেন। কতটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হলে এমনটা করা সম্ভব। এদেরকে মানুষ বলতেও মনুষ্যত্ব বিব্রত হয়। 

আবার চেয়ারের কথায় আসি। প্রশ্ন হলো চেয়ারকে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ডগমাটিকদের কাজই এমন। ডগমাটিকরা নিজের মত ও সে অনুসারীদের সম্মিলনে বিষয়টাকে কাল্টের পর্যায়ে নিয়ে যায়। কাল্টের প্রধানকে রক্ষা করাই তাদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই রক্ষা প্রচেষ্টা থেকেই চেয়ারটাকে উপলক্ষ্য করা হয়েছে। যাতে চেয়ারের আলোচনায় মূল বিষয়টাই হারিয়ে যায়। হিটলারিয় থিওরি আর কী। একশটা মানুষের সাথে একটা কুকুর মেরে দাও। পশু প্রেমীরা কুকুর নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হবে, মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি হারিয়ে যাবে। কাল্ট প্রধানকে রক্ষা করতে ডগমায় আক্রান্তরা চেয়ার থিওরি নিয়ে এসেছে। সুতরাং চেয়ার থিওরি নিয়ে যারা কথা বলছেন, মনে রাখবেন তারা সবাই মানসিক ভাবে অসুস্থ। তারা সবাই ফ্যাসিজমের অনুসারী। কেউ সরাসরি, কেউবা ‘ছুপা রুস্তম’।-

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন