Logo
Logo
×

অভিমত

ভুয়া গোয়েন্দা রিপোর্ট: বিভ্রান্তিকর প্রচারণার জবাব

Icon

তালিমুল ইসলাম সায়েম

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৬ পিএম

ভুয়া গোয়েন্দা রিপোর্ট: বিভ্রান্তিকর প্রচারণার জবাব

কিছুদিন আগে একটি ভুয়া গোয়েন্দা রিপোর্টের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো সার্কুলেট করা হচ্ছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, ভারত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি চুক্তি করিয়েছে। যার কারণে চুপ্পুকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রাখা, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধকরণে বাঁধা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করতে না পারে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারে এজন্য ভারতের মধ্যস্থতায় বিএনপি চুক্তি করেছে আওয়ামী লীগের সাথে। এখানে আরো বলা হয়েছে যে, আওয়ামীলীগকে ৪৫টি আসন দেবে বিএনপি এবং এই কারণে ভারত বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সহযোগিতা করবে।

এই তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিভ্রান্তিকর। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য, বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট ও বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এই রিপোর্টটা ভুয়া, গুজব ও অপপ্রচার মাত্র।

ভিত্তিহীন দাবিগুলোর বিশ্লেষণ ও বাস্তবতা

১.চুপ্পুকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রাখা: 

৫ই আগস্টের পর এখনো পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সারাদেশে পুরোপুরিভাবে সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন কোন না কোন ভাবে দাবি আদায়ের নামে ঢাকায় রাস্তা বন্ধ করা হচ্ছে। একধরণের মবোক্রেসির বাড়বাড়ন্ত অবস্থা দেখে বিশ্বব্যাপী ৮ই আগস্ট ২০২৪তারিখে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তা খুবই দুর্বল সরকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী চিত্রিত হচ্ছে। দেশের সংসদ কার্যকর নয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানের ১০৬অনুচ্ছেদ মেনে আদালতের পরামর্শ নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে বা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলে বা রাষ্ট্রপতিকে সরাতে সংবিধানের ৫২-৫৪অনুচ্ছেদ কার্যকর হয়। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিশংসন, অপসারণ বা অন্য কোন কারণে রাষ্ট্রপতিকে বাদ দিতে চাইলে নির্বাচিত সংসদ লাগবে, বিশেষ পরিস্থিতি হলেও প্রতিটা ক্ষেত্রেই স্পিকারকে লাগবেই। কিন্তু বর্তমানে স্পিকার নিজেও পদত্যাগ করেছেন। দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দুর্বল সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর মাধ্যমে একটা সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হোক, তা অভিজ্ঞ দল হিসেবে বিএনপি চাইতে পারেনা। রাষ্ট্রপতি তো এখনই ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। তাকে সরিয়ে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার মাধ্যমে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বলে যদি বিএনপি সন্দেহ করে, তাতে কি খুব বেশি ভুল হবে? রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানকে দেশের বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সমর্থন করেছে। দেশে নতুন ক্যাওয়াস সৃষ্টি হোক, তা কেউই চান না।

২.ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধকরণে বিএনপি বাঁধা দিয়েছে?

এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং বিএনপি এই নিষিদ্ধকরণকে স্বাগত জানিয়েছে। দৈনিক কালবেলাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ২৫শে অক্টোবর, ২০২৪তারিখে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বরাত দিয়ে লিখা হয়, "২৩শে অক্টোবর, ২০২৪তারিখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ‘সন্ত্রাসী কাজে’ জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে দলটি বলছে, এটি একটি সাহসী ও বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত দেড় দশকে ছাত্রলীগকে রাষ্ট্রীয় মদদে একটি দানব বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। বিএনপি মনে করে, ছাত্রলীগের বিগত দেড় দশকের কর্মকাণ্ডই তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। সুতরাং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এ জন্য দেশের জনগণ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।"

সুতরাং, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধকরণে বিএনপি বাঁধা দিয়েছে, দাবিটি মিথ্যা। বিএনপি যদি বাঁধা দিতো তাহলে সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সাহস পেত না। আর বিএনপি সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ইস্যুতে যেভাবে স্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছিল, সেভাবেই  এই ইস্যুতেই অবস্থান দেখাতো। বিএনপি, ছাত্রদলসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধকরণকে স্বাগত জানিয়েছে।

৩.অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করতে না পারে এবং আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারে সেজন্য বিএনপি আওয়ামী লীগের সাথে চুক্তি করেছে:

এই দাবিও পুরোপুরিভাবে মিথ্যা।এখানে দুইটা অংশ আছে। 

প্রথমটা মুজিববাদী সংবিধান বাতিল। 

পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে মুজিববাদী সংবিধান এমনিতেই বাতিল হয়ে গেছে। বাহাত্তরে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, তাতে এ পর্যন্ত ১৭বার সংশোধনী এসেছে। এই সংশোধনীর অনেকগুলোই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বেগম জিয়ার সময়েও হয়েছে। এরশাদের সময়েও হয়েছে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই সংবিধানের বিভিন্ন বিধিবিধানের সংস্কার চায়৷ সংবিধানের সংস্কার দরকার বলেই বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার একেবারে শুরুর দফাটাই সংবিধান সংস্কারের দফা। তবে বিএনপি মনে করে, পুরো সংবিধান বাতিল করার এখতিয়ার বা একেবারে নতুন সংবিধান গ্রহণ করার এখতিয়ার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদের হাতে থাকা উচিত। আর সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলেই যে ভালো শাসন নিশ্চিত হয় না তার প্রমাণ শেখ হাসিনা নিজে। ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ নানা অধিকারের সুরক্ষা থাকার পরও তা যেকোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার চাইলে এড়িয়ে যেতে পারে বলেই দেখা যায়। তাই যত ভালো সংবিধানই উপহার দিন না কেন, ভালো সরকার না হলে সেই সংবিধানের বিধিবিধান কার্যকর হবেনা বলেই বিএনপি মনে করে। তাই ১৭বার সংশোধিত সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান বলার মাধ্যমে বাতিল করার চেষ্টার মাঝেও দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির দুরভিসন্ধি আছে বলেই বিএনপি মনে করে।

অভিযোগের ২য় অংশটা হল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারে সেজন্য বিএনপি আওয়ামীলীগের সাথে চুক্তি করেছে:

আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির চুক্তির দাবিটিও সর্বৈব মিথ্যা। আওয়ামী লীগের দ্বারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দল হিসেবে শুরুতেই বিএনপির নাম আসে। গত ১৫বছরে চৌধুরী আলমসহ বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে, ইলিয়াস আলীসহ গুম করেছে ৬শ এর অধিক নেতা-কর্মীকে, ৬০ লক্ষ্যের অধিক নেতা-কর্মীকে মামলায় জর্জরিত করেছে, জেল খাটতে বাধ্য করেছে দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়াসহ লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মীকে, শত শত মামলার শিকার প্রতিটি নেতা-কর্মীকে প্রতিদিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের পাসপোর্ট আটকে রাখার মাধ্যমে এবং মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে দেশে ফিরতে দেয়নি এই আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে বিএনপিরই লাভ। তার একটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগের ভোটের একটা অংশ বিএনপিতে আসার সম্ভাবনাও আছে, কিন্তু বিএনপি সরাসরি শক্ত বিবৃতি দিয়ে দলীয় নির্দেশনা জারি করেছে, নতুন কাউকেই যেন দলে অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। সারাদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, প্রায় সবগুলো মামলা বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই করেছে, অন্যান্য দল নিজেদের উপর এত নির্যাতনের কথা বললেও এসব মামলা করার সাহস করেনি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে এইসব মামলা থেকে লীগের অত্যাচারী নেতা-কর্মীদের বাঁচাতেই যেন তারা বেশি উদগ্রীব। অতএব, আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির চুক্তি করার কথাটা মিথ্যা বলেই প্রতীয়মান হয়। 

তাছাড়া আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে নয় বিএনপি। তবে আওয়ামীলীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে বিএনপি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছে, সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নয় বরং জনগণই আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তার রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি অন্য আরেকটা রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধকরণ কামনা করতে পারেনা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে জামায়াত, ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলে ওইদিনই বিএনপির মহাসচিব বলেন, “সাংবিধানিক অধিকারবলে তারা যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন করতেই পারে। আন্তর্জাতিক মানের ন্যায়সংগত ও বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলকে অপবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অন্যায় এবং সংবিধানসম্মত নয়।” ২৮শে আগস্ট ২০২৪ তারিখে জামায়াত-শিবিরের নিষেধাজ্ঞার সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। এরকম প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হওয়া দলগুলো আবারও জেগে উঠার সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের দায় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি নিতে চাইবেনা, এটাই স্বাভাবিক। গত ১৫বছরের দু:শাসন এবং জুলাই-আগস্টের গণহত্যার কারণে আওয়ামীলীগকে জনগণই বয়কট করবে বলে বিএনপি মনে করে। জনগণের রায়ের মাধ্যমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলে এই দল আর ফিরে আসতে পারবেনা বলেই বিএনপি মনে করে। বিএনপি চায়, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের শাস্তি, নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ নয়।

তাছাড়া, বিএনপি তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নাই। সরকারের যদি এতই ইচ্ছা থাকে, তাহলে সরকারই তো নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। এর বিরোধিতায় বিএনপি কোন কর্মসূচিও দিবেনা। এসব না করে বিএনপির উপর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দায় চাপিয়ে দেয়ার রাজনীতিতে বিএনপি থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। 

৪.ভারত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চুক্তি করিয়েছে:

এটাও বিএনপিকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার অংশ হিসেবে নেয়া যায়। কারণ এরকম চুক্তির কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া বিএনপির এরকম চুক্তিই বা করতে হবে কোন যুক্তিতে? বিএনপি তো এখন বিজয়ীর দলে আছে। বিএনপি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান তো ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৮ই আগস্টের পর থেকে তাদের সরকার হিসেবেই পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন নানা বক্তব্যে। প্রতিটি বক্তব্যে তিনি বলে আসছেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদেরই সরকার। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।” বিএনপি তো নিজেকে বিজয়ী হিসেবেই মনে করে। বিজয়ী বিএনপি হেরে যাওয়া গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের সাথে কেনই বা চুক্তি করতে যাবে যারা তাদের উপর দীর্ঘ ১৫ বছর অত্যাচার চালিয়ে গেছে?

আওয়ামীলীগকে আজকের খুনি, গণহত্যাকারী ও ফ্যাসিস্ট বানানোর প্রধান কারিগরদের একটি দেশ হল ভারত। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে গিয়ে ২০০৭-০৮সময়ের ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকারকে ভারতের প্রণব মুখার্জি কীভাবে ম্যানেজ করেছে তা তো বিএনপি খুব ভালো করেই জানে। এমনকি রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জি ২০১৩সালে বাংলাদেশে আসলে বেগম খালেদা জিয়া তার সাথে দেখা করেননি। ভারতের সহায়তায় আওয়ামী লীগ ২০১৪এর বিনাভোটের নির্বাচন, ২০১৮ এর রাতের ভোটের নির্বাচন, এমনকি ২০২৪সালের ডামি নির্বাচন করেও বিশ্বশক্তিকে পক্ষে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে এখনো ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের নানা তৎপরতা বিএনপি লক্ষ্য করে যাচ্ছে বলেই মনে করি। আর ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার বিষয়ে বিএনপি যে লংমার্চ করেছে আগরতলা ও ভারতীয় হাইকমিশনের দিকে, তা বাংলাদেশের আর কোন বড় রাজনৈতিক দল করার সাহস দেখিয়েছে কি? 

বাংলাদেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাথে সাথে ভারতও ’২৪এর পরাজিত শক্তি। আর বিএনপি বর্তমানে বিজয়ী শক্তির অংশ। বিজয়ী হয়ে পরাজিতের সাথে ক্ষমতায় আসার চুক্তি করতে যাওয়ার মত বোকামি কোন পাগলই করবেনা। 

বাংলাদেশে ভারতের যে প্রভাব খুনি হাসিনার পলায়নের পর তা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বলা যায়। তাছাড়া বাংলাদেশিদের মাঝে ভারতের প্রতি যে বিরোধী মনোভাব আবহমানকাল ধরে চালু আছে, এই বিরোধী মনোভাবের একটা বিশাল অংশ বিএনপির সাপোর্টার। বিএনপি এই সমর্থকদের কথা ভুলে যাবে না নিশ্চয়ই।

বাংলাদেশের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে বিএনপি অনেক আগেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব পেত বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। তাছাড়া এখনো বিএনপির সেই কনফিডেন্স আছে, জনগণের ভোটে বিএনপি নির্বাচিত হওয়ার সামর্থ্য রাখে। তাদের তো ভারতের মতো দেশের সাথে সরাসরি চুক্তি করে ক্ষমতায় আসতে হবেনা।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, যেহেতু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না, তাই তারা ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সমমর্যাদার ভিত্তিতে ভালো সম্পর্ক রাখতে চান, তবে কোনো গোপন চুক্তির মাধ্যমে নয়। 

৫.৪৫টি আসন আওয়ামীলীগকে দেওয়া হবে:

এটাও অবাস্তব ও অযৌক্তিক দাবি। বিএনপি সরাসরি জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে আসছে গত ১৫বছর ধরে। তবে এটা সত্যি যে, সারাদেশে আওয়ামী লীগের একটা স্থায়ী কর্মী-সমর্থক আছে। এখন আওয়ামী লীগ যদি বাধাহীনভাবে নির্বাচন কর‍তে পারে তারা ৩০-৪০টি আসন পাওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ গত ১৫বছর নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া এবং জুলাই-আগস্টে ২হাজারের অধিক ছাত্র-জনতাকে গণহত্যার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছে, সেই অপরাধের পর তাদেরকে স্বাভাবিক নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়ার বিষয়টা জনতার বিবেকের কাছে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চায় আওয়ামী লীগের যারা অপরাধের সাথে যুক্ত, সবাইকে বিচারের আওতায় আনুক বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিনাভোটের নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন এবং ডামি নির্বাচনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা এবং জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় লিপ্ত আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হলে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে বলে বিএনপি মনে করে। বিএনপির তাদের সাথে চুক্তি করার কিংবা তাদেরকে ৪৫টি আসন দেয়ার কোন দরকারই নাই। এই ৪৫টি আসন বিএনপি তার শরীকদের দিলে কিংবা নতুন কোন দলকে দিলে দেশের রাজনীতিতে বিএনপির নতুন বন্ধু তৈরি হয়। এত বছরের অভিজ্ঞ একটি দল এই সামান্য বিষয়টি বুঝার সামর্থ্য রাখেনা বলে কি মনে হয়?

৬.বিএনপিকে ভারত রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাবে?

বিএনপি বাংলাদেশিদের স্বাধীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে বারবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া দল। এই কাজে তার ভারতকে লাগবেনা। বরং জন্মলগ্ন থেকে দেশের ভারতবিরোধী অংশের সমর্থনকে ক্যাশ করা দল হল বিএনপি। ভারতের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নদীর পানির ন্যায্যহিস্যার দাবি তুলেছিলেন ওআইসি, জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনসহ নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে। বেগম জিয়ার সরকারের সময়েও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতের সাথে নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখে এসেছে বাংলাদেশ। জনাব তারেক রহমানের সময়েও ভারত সরাসরি বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে বাঁধা দিয়ে গেছে। আজকে ভারতের সহায়তায় রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার এই ভুয়া প্রচারণার মাধ্যমে মূলত বিএনপিকে ভারতপন্থী দল হিসেবে চিত্রিত করতে চায় দেশের একটা গোষ্ঠী। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক হিসেবে বিএনপি দেশের ভিতরে অন্য কোন দেশের হস্তক্ষেপের সরাসরি বিরোধিতা করে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের  রাজনৈতিক ভূমিকাকেও প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।

গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী?

১.বিএনপির ‘ডানের বামে, বামের ডানে’ অবস্থানকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা। বিএনপির সেন্টার রাইট অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

২.বিএনপিকে ভারতপন্থী দল হিসেবে চিত্রিত করা যাতে দেশের ভারতবিরোধী জনগণকে বিভ্রান্ত করা যায়। 

৩.রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ানো।

৪.নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে গণমানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করা।

তালিমুল ইসলাম সায়েম, সাবেক যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন