বাংলাদেশের এলিট সেটেলমেন্ট ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি

দিলশানা পারুল
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
এই আলোচনার মাধ্যমে আমি তিনটি মূল প্রশ্ন বোঝার চেষ্টা করব:
১. বাংলাদেশের এলিট সেটেলমেন্ট কারা এবং তাদের চরিত্র কী?
২. আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধরন ও প্রকৃতি কী?
৩. বাংলাদেশের এলিট সেটেলমেন্ট ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি কীভাবে দেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করছে?
এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ ব্যবহার করব।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রথম সরকার গঠন করে। এরপরে, ভোটকেন্দ্র দখল এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয়েছে ভোটবিহীন এবং ডামি প্রার্থীদের মাধ্যমে। বিশেষ করে পরবর্তী দুটি নির্বাচনের কোনো নৈতিক বা আইনগত গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।
যদি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র ইন্ডিকেটর নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ কীভাবে বিগত ১৬ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারল? এর উত্তর হলো—এলিট সেটেলমেন্টের সাথে সমঝোতা।
এলিট সেটেলমেন্ট ও ক্ষমতার সম্পর্ক
২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৮২ জন ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১৯৯ জনে পৌঁছায়। এই সংখ্যা থেকেই স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এলিট শ্রেণি কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন লাভ করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিগত ১৬ বছরে এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে দলীয় সদস্যরা হয় এলিট শ্রেণির অংশ হয়েছে, নয়তো লুটপাটের মাধ্যমে নিজেরাই এলিট শ্রেণি তৈরি করেছে।
দলীয়করণ ও প্রভাব বিস্তার
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দলীয়করণ করেছে। সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, আমলা, সাংবাদিক, এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসন পর্যন্ত দলীয়করণের আওতায় এসেছে। এ প্রক্রিয়া কখনো প্রমোশন, কখনো অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে রাজি হননি, তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়েছে।
একই প্রক্রিয়ায় তারা আঞ্চলিক পর্যায়েও এক ধরনের সমঝোতা বা সেটেলমেন্টে পৌঁছেছে, যা রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং স্থানীয় ক্ষমতাবানদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। সাধারণত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেখা গেছে, তারা স্থানীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে মাদক ব্যবসায়ী, অপরাধী গোষ্ঠী, কিংবা গুন্ডাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আঞ্চলিক পর্যায়ে এই সমঝোতা দ্বিমুখী ছিল—কখনও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি ও গুন্ডামির সঙ্গে জড়িয়েছে, আবার কখনও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয়েছে।
রাজনৈতিক চরিত্রের প্রশ্ন
এই প্রক্রিয়া আসলে কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শিক বা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সাথে খাপ খায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এই কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি এবং গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এলিট সেটেলমেন্টের সাথে আওয়ামীলীগের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
এলিট সেটেলমেন্টের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কটি ছিল পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার সমঝোতার উপর ভিত্তি করে। একদিকে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে এলিট শ্রেণি অর্থনৈতিক শোষণ ও আত্মসাৎ করেছে। এই প্রক্রিয়া একটি লিনিয়ার মডেলে পরিচালিত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগাভাগি করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়েছে। এলিট সেটেলমেন্টের অংশীদারদের আদর্শিক বা নৈতিকভাবে রাজনৈতিক ব্যানারের প্রয়োজন হয় না। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে একটি রাজনৈতিক আম্ব্রেলার নিচে থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। ফলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বদলালেও এই সেটেলমেন্টের চরিত্র সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকার মূলে রয়েছে এলিট সেটেলমেন্টের সাথে পারস্পরিক সমঝোতা এবং এর প্রভাব দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে।
এখন আসি ৩৬শে জুলাইয়ের পরবর্তী পরিস্থিতিতে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর আমরা লক্ষ্য করলাম, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস, সচিবালয়, এবং বিশেষ করে পত্রিকাগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের দায়িত্ব ও পদবির পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন একদিকে প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে প্রত্যাশিত ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সেটেলমেন্টের এই অংশটিকে দায়িত্বে রেখে ইন্টারিম সরকারের পক্ষে কার্যকরভাবে প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না।
আমরা পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে কর্মপরিধিতে বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, শুধু ইন্টারিম সরকার নয়, বরং আওয়ামী লীগের পরবর্তী যেকোনো সরকারকেই প্রশাসনের নির্দিষ্ট পর্যায়ের পদের পরিবর্তন করে এগিয়ে যেতে হতো।
বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সব গুরুত্বপূর্ণ পদ বিএনপি এবং জামাত-ই-ইসলামী সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এখানেই মূল প্রশ্নটি উঠে আসে—কেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী সময়ে এসব দায়িত্বে বিএনপি এবং জামাতের লোকদের পদায়ন সম্ভব হলো? এর একটি কারণ হলো, এরা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, কিন্তু এর বাইরেও একটি বড় কারণ রয়েছে।
এই কারণ হলো, রাজনৈতিক সেটেলমেন্টটি একটি পরিচিত কাঠামোতে পরিচালিত হয়। যে এলিট সেটেলমেন্ট ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাদের জন্য আওয়ামী লীগের পরবর্তী স্বাভাবিক বিকল্প হলো বিএনপি এবং জামাত-ই-ইসলামী। কারণ, এটি তাদের জন্য পরিচিত এবং নিরাপদ। অপরিচিত বা নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসালে এলিট সেটেলমেন্টের জন্য ভাগাভাগি ও স্বার্থ রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সম্পূর্ণ নতুন একটি মেইনস্ট্রিম রাজনৈতিক দলের উঠে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। উদীয়মান রাজনৈতিক দলের প্রতি আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা না থাকার অন্যতম কারণ হলো—এই সেটেলমেন্ট জানে না, নতুন শক্তিটি তাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করবে। অপরিচিত রাজনৈতিক শক্তি কীভাবে কাজ করবে বা কতটুকু সহযোগিতা দেবে, তা অনিশ্চিত থাকার কারণেই তারা ঝুঁকি নিতে চায় না।
গত পাঁচ মাসে আমরা এই বাস্তবতার প্রতিফলন দেখেছি। এই অনাস্থার কারণে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থান কঠিন হয়ে পড়ে। এলিট সেটেলমেন্ট বিদ্যমান কাঠামোর উপর নির্ভরশীল থাকে এবং যেকোনো নতুন শক্তির সম্ভাবনাকে দমন করার চেষ্টা করে।
এই অনাস্থা উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়াটি মিডিয়া এবং অন্যান্য তথ্যমাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি আরও সহজ হয়ে যায়। দেশের শতকরা ১০০ ভাগ নিউজ মিডিয়া হাউস যেহেতু এই এলিট সেটেলমেন্টের আওতায় কাজ করে, তাদের মাধ্যমে জনমত নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে যায়।
গত পাঁচ মাসে আমরা ঠিক এই প্রতিচ্ছবি দেখেছি। ২০০৭-০৮ সালেও যেমন বিএনপি-বিরোধী মিডিয়ার ভূমিকা দেখেছিলাম, তেমনি গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের পক্ষে মিডিয়ার অবস্থান ছিল দৃঢ়। এই অবস্থানই ক্রমাগত জনগণের সম্মতি তৈরি করেছে। ক্ষমতায় কে থাকবে বা থাকবে না, সেই সিদ্ধান্ত একমাত্র এই সম্মতি উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়েছে।
এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই এলিট সেটেলমেন্ট এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বন্দোবস্ত বা সমঝোতা কতটা জনগণের পক্ষে রাজনীতি করে বা কতটা জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলো পরিচালিত করে। বিগত ৫৪ বছরে, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে আমরা যা দেখেছি, তা স্পষ্ট করে বলে যে, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রক্ষমতা, এবং এলিট সেটেলমেন্ট—এই তিনটি সত্তা যদি জনগণের সম্মতি ছাড়া নিজেদের অভ্যন্তরে স্বার্থকেন্দ্রিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি সেটেলমেন্টে পৌঁছে, তাহলে সেটি কখনোই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে বাধ্য থাকে না বা তা রক্ষা করে না। শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা এর সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। এলিট সেটেলমেন্ট এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থকেন্দ্রিক অরাজনৈতিক এই সমঝোতা কখনোই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি।