Logo
Logo
×

অভিমত

আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম হলে দায় নেবে কে?

Icon

মোহাম্মাদ নাকবী হক

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৩ এএম

আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম হলে দায় নেবে কে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিজম শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে, যা কেবল সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবেই দলটির শাসনপ্রক্রিয়ার সাথে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, যেখানে লাখো যুবক প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন এবং হাজারো মা-বোন আত্মত্যাগ করেছিলেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র চার বছরের মধ্যেই গণতন্ত্রের কবর রচনা করে। একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বীজ তখনই বপন করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ভারত-সমর্থিত আওয়ামী শাসনে আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাহবুব আলম “১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ” বইতে উল্লেখ করেন যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মী ও রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, সম্পত্তি লুটপাট, এমনকি বিদেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী পাশের দেশে পাচারের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই দুঃশাসনের চরম পরিণতি দেখা যায় ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে, যেখানে না খেতে পেয়ে, অমর্ত্য সেন-এর মতে, প্রায় ৬ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সেই সময়ের বাস্তবতায় "ফ্যাসিজম" ও "ভারতের দালাল" শব্দ দুটি উচ্চারিত হলেই অধিকাংশ মানুষ বিনা বিশ্লেষণেই আওয়ামী লীগকে বুঝতেন, যা তৎকালীন শাসনের প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরে।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের মুখোশ পরে ও মন ভুলানো প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে। মানুষ তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র ভুলে গিয়ে ধরে নেয়, হয়তো এবার তারা নিজেদের শুধরে নেবে। কিন্তু এই সরল বিশ্বাসের মূল্য বিগত ১৬ বছর জাতিকে চুকাতে হয়েছে। গুম কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে প্রায় ৩,০০০ মানুষ পরিকল্পিতভাবে গুম হয়েছে, যার মধ্যে ২৭% মানুষের কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে ১,৯২৬ জনকে, আর সীমান্তে ৬৩১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে, যার একটিরও কার্যকর প্রতিবাদ করতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের কোনো বন্ধুভাবাপন্ন দেশের মধ্যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নজির প্রায় বিরল।

দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়লেও দেশের সাধারণ মানুষ রয়ে গেছে খাদ্যসংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে পিষ্ট। ২৩৪ বিলিয়ন টাকা দুর্নীতি করেও ক্ষমতার মসনদে বসে জনগণের দুঃখ-দুর্দশাকে উপহাস করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা পরিহাসের সুরে পেঁয়াজ ছাড়াই রান্নার রেসিপি দিতেন, ইফতারিতে মিষ্টি কুমড়ার পিয়াজু খাওয়ার পরামর্শ দিতেন, আর চাল কিনতে না পারলে কাঁঠাল খাওয়ার কথা বলতেন। তার এই বক্তব্য দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টকে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, হত্যার আলামত নষ্ট করতে লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে এবং বিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে আহত ও পঙ্গু করেছে। এত কিছু সত্ত্বেও, দলটি এখনো দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকছে না। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—আওয়ামী লীগ কি আবার পুনর্বাসিত হবে? অথবা, তারা কীভাবে নিজেদের পুনর্বাসনের পথ তৈরি করবে?

বিগত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যে কৌশলগুলো অনুসরণ করেছে, সেগুলোকেই পুনর্বাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এই সময়ে ২,১৪,৯৩৮ জনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হয়েছে। এই নিয়োগের অধিকাংশই দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। প্রশাসনের উচ্চ ও নিম্ন স্তরে ফ্যাসিবাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী মনোভাবাপন্ন লোকদেরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করতে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে, জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়েছে এবং প্রশাসনের প্রতিটি স্তরকে একক দলীয় অনুগত কাঠামোয় রূপান্তরিত করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, যদি অতীতের ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা হয়, তাহলে তারাই আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে, যেসব আমলা ও পুলিশ গণহত্যায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা এখনো তাদের পদে বহাল থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। এমনকি, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারকেও নানা উপায়ে হয়রানি করা হচ্ছে, যা ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্মের এক অশনি সংকেত।

বিগত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতন ঘটলেও, তাদের জনশক্তির বলয় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেছে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। এই জনশক্তির অনেকে ৫ আগস্ট ও তার পূর্ববর্তী নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। যদি এদের দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা হয়, তাহলে তারা পুনরায় সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। সবসময় ছাত্ররা প্রাণ দিয়ে ফ্যাসিবাদ উৎখাত করবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা যে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, সেটি যদি অবহেলায় নষ্ট করা হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ফেলতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসনের পুনরুত্থান সাধারণত অর্থ ও বিদেশি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদের মাধ্যমে ঘটে। এই ক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগের অবস্থান অত্যন্ত সুবিধাজনক। বিগত ১৬ বছরে দলটি যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করেছে, তা তাদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাকে আরও জোরালো করবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাশীল এবং তাদের শাসনকে সমর্থন দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই দুই শক্তির সংযোগ যদি অটুট থাকে, তবে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

বর্তমানে অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে, মুসলিম লীগের মতো আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তবে এই ধারণা ভ্রান্ত, এবং এর বিপরীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মদদপুষ্ট একটি দল ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রভাব একেবারেই শূন্যে নেমে আসে। সেই দিক থেকে আওয়ামী লীগের অবস্থান একেবারেই ভিন্ন, কারণ দলটি সবসময় ভারতীয় সমর্থন পেয়েছে এবং ১৯৭৫ সালের পরও রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের একটি সুসংগঠিত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক বলয় রয়েছে, যারা দলটির গণহত্যা, গুম, এবং গণতন্ত্র হত্যার ঘটনাগুলো বিভিন্ন বিকৃত বয়ানে মানুষের সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট। এই প্রচারযন্ত্র আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যতম সহযোগী মাধ্যম হলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৬টিরও বেশি টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশেই আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ও শিল্পীরা কাজ করছেন। তাদের হাত ধরে নিত্যনতুন কৌশলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত তৈরির প্রচেষ্টা চলতে পারে।

এছাড়াও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগ তাদের অনুগতদের নিয়োগ দিয়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। এরা দলটির রাজনৈতিক সংকটে পাশে দাঁড়াতে পারে এবং প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে ভূমিকা রাখতে পারে। এই সমস্ত কৌশল ও শক্তি বিবেচনায়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুসলিম লীগের মতো নিঃশেষ হওয়ার অনুমান করা বাস্তবসম্মত নয়।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাও ফ্যাসিবাদী আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের দ্বারা প্রভাবিত, যা আওয়ামী লীগের পুনরুদ্ধারের আরেকটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এই বিচার ব্যবস্থা ব্যবহার করে দলটি নিজেকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। ফলে, নতুন নেতৃত্ব বা পুরনো নেতৃত্বকে নতুনভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার, এমনকি ক্ষমতায় পুনরায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বেশ কিছু পথ ও কৌশল এখনো লক্ষ করা যায়।

এই পরিস্থিতিতে, সরকারের উচিত হবে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা। পাশাপাশি, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বস্তরের মতামতের ভিত্তিতে একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে দেশের আর কোনো কিশোর-যুবকদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে না হয়।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব দ্রুত যেকোনো বিষয় ভুলে যায়। তাই, জনগণ যেন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের দুঃশাসন ভুলে না যায়, সে জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এসব বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে ভবিষ্যতে পথচলা, যাতে অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

বিগত সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি বড় কারণ ছিল। এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বিভক্তির সুযোগ না দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। যদি এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে দেশ শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে আশা করা যায়। 

 লেখক: মোহাম্মাদ নাকবী হক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


 


Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন