
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছে। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্যের সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তারা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন দলে যোগ দিতে পারেন।
তবে এই গুঞ্জন পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, "উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা এখনো নিইনি। তবে আমরা ভাবছি, আমাদের ভূমিকাটা সরকারের ভেতরে বেশি কার্যকর হবে, নাকি বাইরে থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করাটা গুরুত্বপূর্ণ হবে।" প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
নতুন রাজনৈতিক দল কেন?
নাহিদ ইসলামের ভাষ্য, "৫ আগস্টের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় হয়েছে। তবে যেসব শিক্ষার্থী বা নাগরিক কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন, তারাও নেতৃত্ব দিতে চান, রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে চান। তাদের ঐক্যবদ্ধ করতেই নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।"
গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকেই এ বিষয়ে আলোচনা চলছিল বলে তিনি জানান। তখন শিক্ষার্থীরা ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কাজ করে সরকারকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কিন্তু এখন গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার ভাবনা সামনে আসছে।
নতুন দলে কী ভূমিকা নেবেন?
নাহিদ ইসলাম বলেন, "আমাদের সরকার থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে—১৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে।"
দলের নাম ও নেতৃত্ব কারা নেবেন?
নতুন দলের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে সূত্র বলছে, উপদেষ্টা পরিষদের অন্তত একজন শীর্ষ ব্যক্তি নতুন দলে সরাসরি যোগ দিতে পারেন, অন্য দুজন আপাতত সরকারে থেকে যাবেন।
বিএনপির বক্তব্যে এক-এগারোর ইঙ্গিত?
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে "এক-এগারোর ইঙ্গিত" বলে মনে করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, "সরকার বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন থাকলেও বিএনপি সমর্থন না দেওয়ায় সরকার এ বিষয়ে এগোয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "যদি বিএনপি কোনো নতুন অন্তর্বর্তী সরকার চায়, তাহলে সেটাও এক-এগারো ধাঁচের সরকার হয়ে যাবে। আগেরবার বিএনপি ভুক্তভোগী ছিল, এবার হয়তো তারা সুবিধাভোগী হতে চায়।"
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত?
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য, "আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে না"—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাহিদ ইসলাম বলেন, "আমরাও মনে করি, আওয়ামী লীগের আর রাজনৈতিক বা নৈতিক অধিকার নেই রাজনীতি করার। তবে সরকার এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালত বা নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ আসতে পারে, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।"
জুলাই অভ্যুত্থান ও শহীদ পরিবারগুলোর দাবি
আহত ও শহীদ পরিবারগুলোর জন্য সরকার ৩০ লাখ টাকা অনুদান বরাদ্দ করেছে, যার প্রথম কিস্তি ১০ লাখ টাকা এ মাস থেকেই দেওয়া শুরু হবে। আহতদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বলে জানান নাহিদ ইসলাম।
তবে শহীদ পরিবার ও আহতরা বিচারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় সরকারের উদ্যোগ আরও জোরালো করতে হবে বলে তিনি স্বীকার করেন।
গণমাধ্যম ও সরকারের সম্পর্ক
গণমাধ্যমের ওপর সরকার কোনো চাপ দেয়নি বলে দাবি করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, "নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন বা মামলার আসামিদের বিষয়ে গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে সরকারের সমালোচনা করলে কোনো গণমাধ্যমের ওপর কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "গত ১৫ বছরে কিছু গণমাধ্যম ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। এখন তাদের নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ এসেছে। সরকারের কাজ হলো উন্মুক্ত গণমাধ্যমকে সমর্থন দেওয়া, সেটাই আমরা করছি।"
রাজনীতিতে বিভক্তি ও অভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎ
গণ-অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে বিভক্তি ও দূরত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা দলীয় স্বার্থে ঢুকে গেছি, ফলে ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তবে এটা পুরোপুরি ভেঙে যায়নি, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হচ্ছে। আমাদের এখন জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।"
সংস্কার বনাম নির্বাচন
সরকার সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্য থেকে সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান তিনি। "নির্বাচন দ্রুত করার জন্য বিএনপি চাপ দিচ্ছে, কিন্তু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করা হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তাই আমরা সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।"
সরকার কতটা সফল?
গত ছয় মাসে জনগণের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে—এই প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ ইসলাম বলেন, "আমি ১০-এর মধ্যে ৫০ শতাংশের কিছু কম দেব। সরকারের সদিচ্ছা আছে, তবে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জও প্রচুর। তবে রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানের শক্তি ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেলে সরকার আরও কার্যকর হতে পারবে।"
গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শ বাস্তবায়ন ও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন দল গঠনের চিন্তা সামনে এসেছে। তবে সরকারের অভ্যন্তরে থেকে সংস্কার করা হবে, নাকি নতুন দলে যোগ দিয়ে আন্দোলন চালানো হবে—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতারা এখনো দ্বিধায় রয়েছেন। আগামী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে বলে জানান নাহিদ ইসলাম।