আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ডলার সংকট ছিল তীব্র। একদিকে অর্থনৈতিক মন্দা, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ লুটপাট আর টাকা পাচারে রিজার্ভের অবস্থা ছিল তথৈবচ। ডলারের সংকটে জরুরি রপ্তানি ও কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী সরকারের পতনের পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও আবার তা আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে।
বেশ কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সের (প্রবাসী আয়) ডলারের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কে ডলারের দাম ১২১-১২২ টাকায় স্থিতিশীল ছিল। এরপর গত এক-দেড় সপ্তাহে তা আবার নাটকীয়ভাবে বেড়ে ১২৭-১২৮ টাকায় পৌঁছে গেছে এবং এই দাম বেড়ে চলছে। এই হঠাৎ বৃদ্ধির জন্য এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির অজুহাত দিলেও রেমিট্যান্স ডলারের বাজারে এমন দামের উল্লম্ফন বিদেশে পুঁজি পাচার আবার চাঙা হতে শুরু করার একটা লক্ষণ বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতের পর লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীদের প্রায় সবাই নানাভাবে দেশ থেকে বিদেশে পালিয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত সরকার এদের ধরতে পারা বা এদের অবৈধ সম্পদ উদ্ধার বিষয়ে প্রায় কিছুই করতে পারেনি।
এইসব লুটেরাদের বেশিরভাগই বিদেশে পালিয়ে গেছে। বছরের পর বছর এরা নানারকম হুন্ডি ও পাচারের চ্যানেল তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক ডলারের চাহিদার কারণে এই আশঙ্কা অমূলক নয় যে, এই চক্র আবার তাঁদের কাজ শুরু করেছে। এরা নানাভাবে দেশের থেকে টাকা পাচার করছে। হয়তো এই চক্রে নতুন খেলোয়াড়রাও যুক্ত হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী কয়েক মাসে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের জোয়ার দেখা গিয়েছিল। জুলাই আন্দোলনের ফলে উদ্বুদ্ধ প্রবাসী শ্রমিকরা হুন্ডি বাদ দিয়ে বৈধ চ্যানেলেই রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এর সঙ্গে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি-ব্যয়ের স্থিতিশীলতার কারণে ডলারের রিজার্ভ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।
তবে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে রেমিট্যান্স ডলার ও রপ্তানি আয়ের ডলারের জন্য একই দাম প্রযোজ্য হবে, কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা দিতে হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি পরিত্যাগ করে দিনে দুবার ডলারের দাম (ভিত্তিমূল্য) নির্ধারণ করে বাজারের ওপর ডলারের দামের ওঠানামাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১২ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হবে।
আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে যে, ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা হিতে বিপরীত হতে পারে। এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার হুন্ডিওয়ালাদের ‘সংগঠিত সিন্ডিকেট এই সুযোগ নেবে।
ফলে, এই ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। হুন্ডির সাথে জড়িতদের কেবল জরিমানা নয়, লাইসেন্স বাতিল এবং আরো কঠিন শাস্তি দিতে হবে। এই ব্যাপারে শিথিল হলেই সরকার ও অর্থনীতি গভীর বিপদে পড়বে।