কৃষকলীগ নেতাকে লাঞ্ছনার ঘটনায় তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় কেন প্রধান হয়ে উঠলো?
হাসান আল মাহমুদ
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গত পরশু একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে জনসম্মুখে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিটি হৃদয়বান মানুষকে সাধারণভাবে স্পর্শ করেছে। তিনি কে, তার অপরাধ কী, কী তার অতীত রেকর্ড -এসব জানা ছাড়াই। এতে বোঝা যায় এধরনের মবোক্রেসিকে মানুষের নৈতিক ঐক্য সমর্থন করতে পারে না। অর্থাৎ তার অপরাধ যাইহোক না কেন সেটার শাস্তি ও বিচার থাকতে পারে, কিন্তু কেউ আইন হাতে তুলে নিয়ে কারো সঙ্গে এমন আচরণ করবে তা মোটেই সমর্থন যোগ্য নয়।
সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখলাম তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সংবাদমাধ্যমের জানানোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা জানতে পারলাম তিনি কৃষকলীগেরও নেতা। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল হাই কানু সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা কমিটির সাবেক সহসভাপতি ছিলেন।
বাংলা ট্রিবিউন তাদের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার প্রথম দিকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো থাকার সুবাদে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন তিনি ও তার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯ মামলা রয়েছে থানায়। হত্যা মামলায় তিনি এজহারভুক্ত আসামি। একাধিকবার তিনি কারাগারেও গিয়েছেন নানা অভিযোগে। একসময় নিজ এলাকার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানির নানা অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে। জামায়াত আখ্যা দিয়ে অনেককেই বাড়িতে থাকতে দেননি তিনি। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ভিন্ন দল করায় ভাতা থেকে বঞ্চিত করেছেন।
ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছেন, জনাব আব্দুল হাই কানু এলাকায় নিপীড়ক হিসেবে পরিচিত। বিএনপি-জামায়াত সমর্থক হওয়ায় দাওয়াতে খাবারের প্লেট কেড়ে নেওয়ার মতো জঘন্য কাজও তিনি করেছেন।
তার ও তার ছেলের ব্যাপারে আমরা জানতে পেরেছি, তারা এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য গুন্ডাবাহিনী তৈরি করেছিলেন।
এসব কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে আব্দুল হাই কানুর সাথে যা হয়েছে সেটাকে লঘু করে দেখানো। উদ্দেশ্য এও নয় যে, এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন বা উৎসাহিত করা।
এসব বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, আব্দুল হাই কানু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আক্রোশের শিকার হননি। বরং একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি প্রতিশোধের শিকার হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের সমস্ত গণমাধ্যম এই ঘটনায় যেভাবে তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছেন সেটি অন্যায্য। কারণ এতে এমন জনমত তৈরির প্রচেষ্টা রয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই তিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন। বুঝতে সমস্যা হয় না যে এই ঘটনায় জামায়াত সমর্থকরা জড়িত থাকায় দলটির একাত্তরের ভূমিকার কারণে এধরনের আবেগ তৈরির একটা ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা নৈতিক, বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ হয় না।
কারণ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হওয়া মানেই এই নয় যে তার অন্য কোনো পরিচয় থাকতে পারে না বা তিনি নিজে কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমরা বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, দুর্নীতি, ডাকাতি, নিপীড়নসহ নানা অপরাধে যুক্ত হতে দেখেছি। অনেকেই ফাঁসিতেও ঝুলেছেন। তারা এসব অপরাধ যেমন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে করেননি তেমনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে কেউ কোনো অপরাধের দায়মুক্তিও পেতে পারেন না।
দেশ স্বাধীনের পর যে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলো তারা অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাকশাল গঠনের সঙ্গে জড়িতরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে জড়িতরা রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গত ১৭ বছরে শেখ হাসিনা যে দমবন্ধ করা স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন তা একদল মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে করেছেন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যা পরিচালনার ক্রীড়নক ও প্রধান উসকানিদাতারাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে গণহত্যা চালিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যতম ক্রীড়নক ওবায়দুল কাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা। উসকানিদাতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এরকম সংখ্যা হাতে গোনা নয়। অনেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বলে কি আমরা তাদেরকে দায়মুক্তি দিতে পারবো?
তাহলে জনাব আব্দুল হাই কানু যদি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত না হয়ে থাকেন গণমাধ্যম তাকে কেন তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে প্রধান করে এই মতামত তৈরি করতে চায় যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই লাঞ্ছিত হয়েছেন?
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের এরকম অন্যায্য ফ্রেমিংয়ের আরেকটা উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকায় এক সমাবেশের ডাক দেয় এবং পুলিশ সমাবেশটির অনুমোদন দেয়নি। সমাবেশে সিরাজগঞ্জের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও আওয়ামী লীগ থেকে এমপি পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী জনাব আব্দুর রহমান দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে 'জয় বাংলা' বলে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দেন। এতে উপস্থিত ছাত্রজনতা তার ওপর চড়াও হয় এবং মারধরের ঘটনা ঘটে। জনাব আব্দুর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। ফলে এ ঘটনায় বাংলা ট্রিবিউন, বিডিনিউজ ও কালেরকণ্ঠ তাদের খবরে আব্দুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ও 'জয় বাংলা' স্লোগানকেই প্রধান করে তুলেছে।
সংবাদমাধ্যমগুলো এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে যেন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া ও 'জয় বাংলা' স্লোগান দেওয়ার কারণেই তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন।
এখানে প্রশ্ন ওঠে মুক্তিযোদ্ধা বলেই জনাব আব্দুর রহমান গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত স্বৈরাচারী হাসিনার পক্ষে বেআইনি সমাবেশে গিয়ে স্লোগান দিতে পারেন কিনা? সেটা 'জয় বাংলা' বলে শুরু করায় জায়েজ হবে কিনা? ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের লোকজন কি জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মানুষ খুন করেনি? 'জয় বাংলা' স্লোগানের কারণে সেসব খুন মহান কর্ম হবে কিনা?
গত ৫ আগস্টে আওয়ামী স্বৈরশাসনের পতনের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হওয়ার সুযোগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকেই জনরোষের শিকার হয়ে আহত-নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে হিন্দুধর্মাবলম্বীরাও ছিলেন যারা কিনা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে বিগত সময়ে মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন, এমনকি জুলাই-আগস্ট গণহত্যায়ও অংশ নিয়েছেন।
আগস্ট মাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ৯ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ তাদের প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হিসেবে দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক বহু গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদনের রেফারেন্স দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। পরবর্তীতে নেত্র নিউজ ও দৈনিক সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ৯ মৃত্যুর ৮টিতেই কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র ছিল না। বাকি একটি হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র অজানা। এর মধ্যে জমিজমা নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হত্যা, এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ছিল।
আমার এই লেখার মূল আলাপটা হচ্ছে একটা ঘটনা যে যোগসূত্রে সংঘটিত হয় গণমাধ্যমের উচিত সেটিকে সেভাবেই উপস্থাপন করা। ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্রহীন কোনো পরিচয়কে প্রধান করে তোলা মূলত মিথ্যা তৈরি করারই নামান্তর।
মুক্তিযোদ্ধা জনাব আব্দুল হাইয়ের ক্ষেত্রে-তাকে লাঞ্ছিত করাটা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে খারাপ হয়েছে—
এভাবে প্রতিষ্ঠা করাটা অনুচিত। বরং একজন প্রবীণ নাগরিককে আইন হাতে তুলে নিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়েছে এখানে এটাই জঘন্যতা। উনার বিরুদ্ধে খুনের মামলা রয়েছে, উনি যদি বিচারে খুনি প্রমাণিত হন তাহলে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। তবু জুতার মালা পরানো যেতে পারে না। কারণ এই ধরনের কর্মকাণ্ড একদিকে সমাজে বিকৃতি তৈরি করে, অন্যদিকে মবোক্রেসির নৈরাজ্য তৈরি করে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক