Logo
Logo
×

অভিমত

গুম কমিশন বলছে

গুম ও হত্যার পর লাশ ফেলা হতো রেললাইনে, ফাগুনকেও পাওয়া গিয়েছিলো রেললাইনে

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৮ পিএম

গুম ও হত্যার পর লাশ ফেলা হতো রেললাইনে, ফাগুনকেও পাওয়া গিয়েছিলো রেললাইনে

প্রতীকী ছবি

তরুণ গণমাধ্যমকর্মী, দেশের অন্যতম একটি গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগে সাব-এডিটর ফাগুন রেজার লাশ পাওয়া গিয়েছিল রেললাইনের পাশে। প্রথম গুম ও পরে রাতে রেললাইনের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। ২০১৯ এর ২১ মে। সাতষট্টি মাস হয়ে গেলো, এখন পর্যন্ত ফাগুন রেজা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মাস্টারমাইন্ডদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। কিলার গ্রুপ চিহ্নিত হলেও, একজন অভিযুক্ত খুনির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও কিলার মিশনের অন্য চারজনকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, জামালপুরের কর্মকর্তারা। 

ফিরি গুম কমিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টের দিকে। প্রথম আলোর এ বিষয়ে খবরের শিরোনাম হলো, ‘গুমের পর লাশও গুম : কারও লাশ রেললাইনে, কারও নদীতে’। ফাগুন রেজার লাশও পাওয়া গেছে রেললাইনের ধারে। এমনভাবে রাখা হয়েছিলো যাতে কোনো একটা ট্রেন এলেই ফাগুনের শরীরটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। কিন্তু বিধাতা এতটুকু সদয় যে, ট্রেন আসার আগেই ফাগুনের শরীরটি নজরে আসে স্থানীয়দের। ফলে পরিচয়হীন করার প্রাথমিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তারপরেও পরিচয়হীন তথা বেওয়ারিশ করার চেষ্টা থেমে থাকেনি। রেলওয়ে পুলিশ কোনো রকম পরিচয় চিহ্নিত করার চেষ্টা না করেই ফাগুনকে বেওয়ারিশ কবরস্থানে দাফনের তোড়জোড় শুরু করে। ফাগুনের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। অথচ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে ফাগুনকে শনাক্ত করা কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। যেহেতু ফাগুনের শরীর পাওয়া গিয়েছিলো জামালপুরের সীমানায় তাই দায়িত্বটা ছিলো জামালপুর রেল পুলিশের। কিন্তু তারা অজানা কোনো কারণে ফাগুনকে শনাক্ত করার বদলে পরিচয়হীন তথা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের চেষ্টায় বিস্ময়করভাবে তৎপর ছিলো। তাদের সে চেষ্টা ভেস্তে যায় সে সময় পুলিশে থাকা আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবের জন্য। তারা জানতে পারেন, জামালপুর বেওয়ারিশ কবরস্থানে একটি লাশ দাফনের চেষ্টা চলছে অনেকটা গোপনেই। তারা সেই লাশের ছবি সংগ্রহ করে আমাকে পাঠায়। আমি নিশ্চিত করি ফাগুন রেজার পরিচয়। তার ফলেই সেই পুলিশের উচ্চপর্যায়ে থাকা কয়েকজনের প্রচেষ্টায় ফাগুনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার চেষ্টা সফল হয়নি। অবশ্য চেষ্টার সবটাই করা হয়েছিল। 

ফাগুনকে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দিলে কী হতো, সোজা উত্তর আমাকেও মায়ের ডাক সংগঠনের স্বজনহারাদের মতন ফাগুনের ছবি গলায় ঝুলিয়ে সন্ধানের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়াতে হতো। এই দাঁড়ানো যে কতটা কষ্টের তা আমি বুঝতে পারি। আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি, তারপরও তার কবরটা কোথায় আমার জানা আছে। আমি জেয়ারত করতে পারছি। কবরে হাত বুলিয়ে অন্তত ছেলেটাকে অনুভব করতে পারছি। কিন্তু যাদের সন্তান বা স্বজনদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেরে ফেললেও তাদের কবরটা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের অবস্থাটা ভাবুন। আমি ভেবে কিনারা পাই না। মানুষ রাজনৈতিক কারণে কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই গুম, খুন এবং জুলাইয়ের নির্বিচার হত্যা। 

অনেকে বলেন, আপনি ফাগুনের কথা বর্তমান সরকারকে জানাচ্ছেন না কেন? উল্টো প্রশ্ন করি কেন জানাবো? গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ থেকে বলা হয়েছিল আবেদন করতে, যেন কিছু টাকা আমি পেতে পারি। উত্তরে বলেছিলাম, ক’লাখ টাকার জন্য আমি আমার বাচ্চার শাহাদৎ বেচতে পারবো না। কথা পরিষ্কার। ফাগুন হত্যাকাণ্ড আলোচিত হত্যাকাণ্ড। এটা সরকারের অজানা থাকলে, তা সরকারের ব্যর্থতা আমার নয়। 

প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটি কথা আছে। কোনো অন্যায়ই বিনা দণ্ডে যায় না। ফাগুনের মাস্টারমাইন্ডের একজন, যাকে ছোঁয়া যাবে না অনেকেই বলেছিলেন। তাদের কথা হয়তো ঠিক, ফাগুন হত্যাকাণ্ডে তাকে হয়তো ছোঁয়া যায়নি। তবে প্রকৃতির প্রতিশোধ, তিনি ঠিকই কারাগারে এবং হত্যা মামলায়। যে মামলা থেকে বেরোনো তার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। 

ডয়চে ভেলে এবং দেশে বিদেশের অন্যান্য গণমাধ্যম ফাগুন রেজা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলো, খবর প্রকাশের জন্যই কি ফাগুনকে হত্যা করা হয়েছিলো- এমনটা। এ প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ উত্তর আমাদের জানা নেই। ফাগুনের সাংবাদিকতা তো অবশ্যই এ হত্যাকাণ্ডের একটা ভাইটাল পার্ট, সাথে আমার সাংবাদিকতা, আমার বাবার সাংবাদিকতা, আমার মামার সাংবাদিকতা এবং তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও এ হত্যাকাণ্ডের অন্য পার্টও হতে পারে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাস লিখতে গেলে আমাদের পরিবারকে অস্বীকার করা যাবে না। এতদিন হয়তো উপেক্ষা করা গেছে রাজনৈতিক কারণে, কিন্তু অস্বীকার করা পুরোটাই অসম্ভব। রাজনৈতিক ইতিহাস লিখতে গেলেও আমার পরিবারকে ছুঁয়ে যেতে  হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতি কোনো ক্ষেত্রেই এ পরিবারকে অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং ফাগুন রেজার গুম ও খুনের বিষয়টি নজর-আন্দাজ করারও কোনো সুযোগ নেই। 

ফুটনোট : একজন পিতা হিসেবে যখন ফাগুনকে নিয়ে লিখতে বসি। তখন বুকে পাথর রেখে দিই। নিজেকে অনেক্ষণ ধরে প্রস্তুত করি। না-হলে এমন লিখা কোনো পুত্রহারা পিতার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জাস্ট, সম্ভব নয়। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন