Logo
Logo
×

অভিমত

আসাদের ফ্যাসাদ ও সিরিয়া সংকটের পূর্বাপর

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পিএম

আসাদের ফ্যাসাদ ও সিরিয়া সংকটের পূর্বাপর

ছবি: সংগৃহীত

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসের ভূখণ্ডে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকা একটি পরিবারের সঙ্গে এসেছিল শিশু আইলান। কিন্ত তার আর গ্রিসে যাওয়া হয়নি। নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া আইলান মুখ থুবড়ে পড়েছিল সৈকতে। তার মৃত্যু জানান দিয়েছিল বিশ্ব এখন এভাবেই বালিতে মুখ গুঁজে আছে সব মানবিক আবেদন উপেক্ষা করে। তার শবদেহের সেই ভয়াল দৃশ্য ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বের, কিন্ত থামাতে পারেনি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ্। অথচ পৃথিবীর প্রথম বর্ণমালার নিদর্শন হিসেবে উত্তর সিরিয়ার উগারিতের (Ugarit, northern Syria) সেই কাদামাটির শ্লেটের কথা জানে সবাই। 

তারপর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার অনেক সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ জড়িত এই সিরিয়ার সঙ্গেই। ইসলামী বিশ্বাসে অনেক নবী-রাসূলের আগমনস্থান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ এই সিরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে যতগুলো বড় বড় বাঁকবদল হয়েছিল তার প্রাণকেন্দ্রেও ছিল সিরিয়া। কিন্ত কালের আবর্তে সেই দেশ পরিণত হয়েছে ভয়াবহ এক ধ্বংসস্তূপে, যার মাটিকে ক্যানভাস বানিয়ে প্রতিদিন ছোপছোপ রক্তে আঁকা হচ্ছে বিভীষিকাময় সব মৃত্যুর হিমশীতল চিত্রকর্ম। 

বিশ্ববাসীর নানা আবেগ, উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষার বিপরীতে এক ক্ষমতালোভী শাসনের সবকিছু উপেক্ষা করার যে অসুস্থ প্রবণতা সেখানে হার মেনেছিল সব। আর সে হিসেবে ৮ ডিসেম্বর হয়ে গিয়েছে সিরিয়াবাসীর জন্য উদযাপনের একটি দিন। এদিনে পালিয়ে গিয়েছে তাদের দেশের ঘৃণ্য স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ। রাস্তার মোড়ে তার বাবা হাফিজ আর আসাদের মূর্তি ভাঙছে উল্লসিত জনতা। 

কেউ তার ঘাড়ে দড়ি বেঁধে ট্রাকের পেছনে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে করছে উল্লাস। কেউ কেউ আবেগ সামলাতে না পেরে চরম ক্রোধে বাশার কিংবা তার বাবা হাফিজের মূর্তির মুখ বরাবর মূত্রত্যাগ করছে। এমনকি মুহূর্তে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে কবে থেকে শুরু হয়েছিল এই সিরিয়ার ইতিহাস? ইতিহাসের অন্তরালে তাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি আর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের খরবাখবর কেমন হতে পারে?

সমৃদ্ধ সিরিয়া ধীরে ধীরে ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় মূলত বিগত এক যুগে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ থেকে ২০২৪—মাত্র এক যুগের আবর্তে চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে গেল একটি দেশ। ক্ষমতালোভী বাশার আল আসাদের সিংহাসন আঁকড়ে রাখার লোভ, বিদেশিদের কায়েমি স্বার্থ আর কথিত ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচ কেড়ে নিল হাজার লাখো প্রাণ। 

সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অভিযোগে ক্লাস সেভেন স্ট্যান্ডার্ডের পড়ুয়া মাত্র চৌদ্দবছর বয়সী এক কিশোরকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানাতে চেয়েছিল বাশারের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী। ছেলেটিকে দিগম্বর করে প্যাদানো থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক শক দেওয়া। ওয়াটার বোর্ডিং কিংবা হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা—কী করেনি বাশারের বাহিনী ! তাদের উদ্দেশ্যে ছিল ভয় দেখিয়ে পুরো দেশের জনতার প্রতিবাদের সাহস ভেঙে দেওয়া। কিন্ত হয়েছিল হিতে বিপরীত। 

স্কুল শিক্ষার্থী কিশোরের উপর নারকীয় অত্যাচার থেকে সিরিয়াবাসী দমে যায়নি। তারা এর প্রতিবাদে শুরু করেছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ্। তাদের সন্তানের উপর হওয়া অত্যাচারের বদলা নিতে চেয়েছিল সিরিয়াবাসী। ঠিক যেভাবে ১৮ জুলাই গুলি চালিয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করার পর বাংলাদেশের জনগণ নেমে গিয়েছিল রাস্তায়্। তারা তাদের সন্তানের খুনীদের দেশছাড়া না করে পথ ছাড়েনি। ঠিক সেভাবেই যুগযুগান্তের লড়াই চালিয়ে গিয়েছে সিরিয়াবাসীও। 

খুনি বাশারকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে রাশিয়া। ফলাফল হিসেবে পুরো সিরিয়া পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। ওদিকে রক্তপাত আর প্রাণহানি হয়ে গিয়েছিল সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। তবুও হাল ছাড়েনি সিরিয়ার মানুষ। মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু—এই ব্রত নিয়ে তারা লড়াই চালিয়ে গিয়েছে দীর্ঘদিন। আর তাদের এই লড়াই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। 

বিবর্তনবাদী ইতিহাসবিদদের বর্ণনা আমলে নিয়ে সিরিয়ার সাংস্কৃতিক বিকাশ প্রত্নপ্রস্তর যুগে। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক প্রায় ৮,০০,০০০ অব্দ থেকে প্রত্নপ্রস্তর যুগের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে সিরিয়া থেকে। ১৯৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাপান ও সিরিয়ার একটি যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক দল এখানে খনন শুরু করেছিল। তারা দামেস্কের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে ডেডেরিয়েহ গুহায় খনন চালায়। সেখানে প্রত্নপ্রস্তরযুগীয় মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল তখন। বিবর্তনবাদী ইতিহাসবিদদের মতে, তখন আবিষ্কৃত এই জীবাশ্ম আদিমানব নিয়ানডার্থালের।  

এরপর থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন সিরিয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার পীঠস্থান হিসেবে যে উর্বর অর্ধচন্দ্রাকৃতির ভূমিরূপের কথা বলা হয় তার অংশবিশেষ সিরিয়া সংলগ্ন। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০,০০০ অব্দ থেকে এই অঞ্চলকে নব্যপ্রস্তর তমদ্দুনের একটি কেন্দ্র মনে করা হয়। চাষাবাদ ও গবাদিপশু পালন খুব সম্ভবত এখানকার মানুষই প্রথম আয়ত্বে এনেছিল। মুরেইবেত তমদ্দুনের নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন হিসবে পাথর, জিপসাম ও পোড়া চুন দিয়ে তৈরি পাত্র পাওয়া গিয়েছে। তুরস্কের আনাতোলিয়ার আদলে অবসিডিয়ানে তৈরি নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে এখান থেকে। সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিকাশে এখানে গড়ে উঠেছিল দুটি সমৃদ্ধ জনপদ নব্যপ্রস্তর এবং ব্রোঞ্জ যুগে যথাক্রমে হামোকার ও ইমার।  

এফরেম ইলদিজের লেখা থেকে জানা গিয়েছে, ‘১৯৭৫ সালে উত্তর সিরিয়ার ইদলিবের কাছে এবলার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে খনন করে একটি পূর্ব সেমিটিকভাষী নগর-রাষ্ট্র পাওয়া যায় যা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে স্থাপিত হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের ধারণা। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২৪০০ অব্দে এবলা ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরে আনাতোলিয়া, পূর্বে মেসোপটেমিয়া এবং দক্ষিণে দামেস্ক পর্যন্ত একটি সাম্রাজ্য ছিল এর নিয়ন্ত্রণে। 

এবলা সুমের, আক্কাদ ও অ্যাসিরিয়া নামক মেসোপটেমিয়ান রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিমের জনগণের সাথে এদের ছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল সিরিয়া জবরদখলের লড়াই। তখন থেকে সুমেরীয়, এবলাইট, আক্কাদীয়, অ্যাসিরিয়, মিসরীয়, হিট্টি, হুরীয়, মিটানি, অ্যামোরাইট ও ব্যবিলনীয়রা সিরিয়াকে পর্যায়ক্রমে দখল করেছিল। আর সে জন্য ধারাবাহিক অনেকগুলা যুদ্ধ হয় তখন । 

যুদ্ধবাজ নেতা আক্কাদের কসাই সারগন এবলা জয় করে খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৩০ অব্দের দিকে। তারপর এলাকাটিকে মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের (২৩৩৫-২১৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কয়েক শতাব্দী পরে তাদের পুনরুত্থান ঘটেছিল অ্যামোরাইট জাতির অংশ হিসেবে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে হিট্টিরা দখল করে নেয় এই দেশ।

খ্রিস্টপূর্ব বাইশ শতক থেকে আঠারো শতক নব্য-সুমেরীয় সাম্রাজ্য, আদি অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্য এবং ব্যাবিলনিয় সাম্রাজ্য সিরিয়ার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর খ্রিস্টপূর্ব পনের শতক হতে তেরো শতকের মাঝে হিট্টি, মিসরীয়, অ্যাসিরিয় ও মিটানি সাম্রাজ্য অঞ্চলটি দখলের জন্য লড়াই চালু রাখে। পরবর্তী তিন শতকের জন্য নব্য-অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্যের (৯৩৫-৬০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অধীনে চলে যায় এই এলাকা। এসময় এবের নারি ও আরাম নামে পরিচিত দেশটি পরিণত হয় সিরিয়ায়। 

অ্যাসিরিয়ার সেই দেশটি উত্তর ইরাক, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম ইরান জুড়ে অবস্থিত। তাদের পতনের পর কিছু সময় নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের (৬১২-৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পাশাপাশি মেসোপটেমিয় আধিপত্য চালু ছিল। প্রায় ৭০ বছরের মতো এলাকাটি শাসন করেছিল তারা। এরপর ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের আকামেনীয় বাদশাহ সাইরাস দ্য গ্রেট সিরিয়াকে দখল করে তার সাম্রাজ্যের অংশ বানিয়েছিলেন। তখন সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসকেরা দামেস্ক, সৈদা অথবা বর্তমান লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বসবাস করত। তারপর সেখানে হেলেনিক ও হেলেনিস্টিক যুগের ব্যাপক রদবদল ঘটেছিল। বিশ্ব ইতিহাসের নানা রদবদল হলেও শান্ত হয়নি সিরিয়া। একের পর এক দ্বন্দ্ব সংঘাত আর যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল সিরিয়ার জমিন। 

হিট্টাইটদের (Syro-Hittite states) পর ফিনিশীয় (Phoenicia) আকামেনীয় (Achaemenid Syria), সেলুসিড (Seleucid Empire), পার্থিয়ান (Parthian Empire), রোমান (Roman Syria), সিরিয়া প্যালেস্টিনা (Syria Palaestina), পালমিরীয় (Palmyrene Empire) কিংবা সাসানীয় (Sasanian Empire) সাম্রাজ্যের পর মধ্যযুগের শুরুতে সিরিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় আরব মুসলিমরা। 

উমাইয়া খলিফাদের থেকে শুরু করে সেখানে সেলজুক শাসন বিস্তৃত হয়েছিল বেশ পাকাপোক্তভাবে। তারপর এডেসা কাউন্টি কিংবা প্রিন্সিপ্যালিটি অব এন্টিয়ক ইতিহাসের অনেক ভয়াল অধ্যায়ের স্বাক্ষী। কাউন্টি অব ত্রিপোলি থেকে শুরু করে সেই কুখ্যাত ইলখানাত কিংবা মামলুক সালতানাতের বিস্তার কোন ঘটনায় যুক্ত ছিল না এই সিরিয়া। এমনকি হালাকু খানের সেই খুনে মোঙ্গল বাহিনীকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাস বিখ্যাত ‘আইন জালুতের যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল এই সিরিয়াতেই। এই সময় থেকে মনে করা হয় বিশ্ব ইতিহাসের পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সিরিয়ার ইতিহাস ও ভূরাজনীতি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল নিঃসন্দেহে। 

১৬ শতকের গোড়ার দিকে মামলুক থেকে সিরিয়া কেড়ে নিয়েছিল অটোমান তথা উসমানীয়রা। তারা ১৫৩৪ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল দামাস্কাস আইলেট তথা প্রদেশ। এরপর আলাদা একটি এলাকা হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে আলেপ্পো এবং ত্রিপোলি। এডেনা এবং সিডনের উৎপত্তি এই এলাকায় স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিকাশের পথ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে সিরিয়া ভিলায়েত, বৈরুত ভিলায়েত এবং আলেপ্পো ভিলায়েত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা হয়েছিল। 

১৮৬৪ সালে উসমানীয়দের তানজিমাত সংস্কারের ঢেউও এসে লেগেছিল সিরিয়াতে, ১৮৭২ সালের দিকে মুতাশরিফাত অব জেরুজালেম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল সিরিয়া ভিলায়েত থেকে। তাদের সেখানে একটি স্বায়ত্বশাসিত রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। উসমানীয়দের সানজাক তথা জেলা হিসেবে ধরতে গেলে আইলেট অব আলেপ্পোর মধ্যে ছিল আলেপ্পো, আদানা, আবলিস্তান, আইন্তাব, বিরেজিক, কিলিস, মা’ আরা, হামা, সালামিয়া কিংবা হোমস। আর ওদিকে দামাস্কাস আইলেটসের মধ্যে ছিল ত্রিপোলি, এক্রে, সাফাদ, নাবলুস, জেরুজালেম, লাজুন, সালত, গাজা আর খোদ দামাস্কাস। এই এলাকাগুলো আলাদাভাবে সিরিয়ায় উসমানীয় শাসনকে সুদৃঢ় করেছিল। 

১৮৭২-১৯১৮ সালের সিরিয়ার ইতিহাস ছিল একটু অন্যরকম। জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ১৮৭২ সাল থেকে বিকাশ লাভ করে মুস্তাশারিফাত অব জেরুজালেম। এটাকে আলাদা প্রশাসনিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এই সময় থেকে আলেপ্পো, বৈরুত, ও সিরিয়া ভিলায়েতের পাশাপাশি লেবানন, জেরুজালেম ও কারাকের মর্যাদা ছিল মুস্তাশারিফাত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সানজাক ছিল জর যা মূলত ভিলায়েত আলেপ্পোর অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। এরপর নানা যুদ্ধবিগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে নানাবিধ বদল আসে সিরিয়ার মানচিত্রে। 

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সেই বিখ্যাত বিলাদুশ শাম কোথায় ছিল? মুলত খুলাফায়ে রাশিদুন, উমাইয়া ও পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফতের সময় বিলাদুশ শামস ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তার আগে এই অঞ্চল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শাব্দিক দিক থেকে বিলাদুশ শামস বলতে মূলত বামদিকের জমিন বলা হয় যা মূলত বৃহত্তর সিরিয়া অঞ্চল। বর্তমান সময়ের সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন বিলাদুশ শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। 

ইসলামের ইতিহাসে সিরিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত কেয়ামতের আলামতসহ রাসূল (সা.) এর সিরিয়াকেন্দ্রিক বিভিন্ন ভবিষ্যৎবাণী একে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে ইসলামের ইতিহাসে। তিরমিজি শরিফের ২১৯২ নং হাদিস থেকে জানা গিয়েছে ‘মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন শাম ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়বে, তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে আর কিয়ামত পর্যন্ত কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবে না’।  

মুসনাদে আহমদ এর ৮৯৬ নং হাদিস থেকে জানা যায় শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, হজরত আলী (রা.) একবার শামবাসীদের প্রতি অভিশাপ দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন ‘আমি রসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, শামে আবদালরা (আল্লাহর বিশেষ ওলি) অবস্থান করেন। তারা ৪০ জন থাকেন। যখন একজন মারা যান, আল্লাহ তার স্থানে আরেকজনকে নিযুক্ত করেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ হয়’। 

বিশ্ব ইতিহাস এবং ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত সিরিয়ার উপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছিল বাশার আল–আসাদ। সম্প্রতি তার পতন সিরিয়ার জন্য নতুন দিক উন্মোচন করবে নিঃসন্দেহে। ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদের বিশাল মূর্তিটির ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে বিদ্রোহীরা নতুন যুগের জানান দেয়। তারা মূর্তির ঘাড়ে দড়ি বেঁধে গাড়ির সঙ্গে সেঁটে দিয়ে উল্লাস করে বেড়ায় শহরজুড়ে। 

দীর্ঘ যুদ্ধ সিরিয়ার সব শেষ করে দিয়েছে শুধু পাহাড়ের মতো শক্তি নিয়ে টিকে ছিল স্বৈরাচারী বাশার আল আসাদ। তাই তাকে পরাজিত করার প্রতীকী চিহ্ন হিসেবে তার বাবা হাফিজের বড় মূর্তিটিকেও ধ্বংস করে জনতা। বিশ্ববাসী তখন মিলিয়ে নিতে শুরু করে বাংলাদেশের আগুনঝরা বর্ষার জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে। পাশাপাশি ইতিহাসের পাতা থেকে স্মরণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানির সেই একনায়কের কথা যার মূর্তিও ঠিক এভাবেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল। রোমানিয়ার বিপ্লবের পার ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক নিকোলাই চশেস্কুর মূর্তিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আধিপত্যের চিহ্ন দাঁড়িয়ে থাকা লেনিন ও স্তালিনের মূর্তিগুলোকে ভেঙে চুরমার করে জনগণ। 

তারপর ২০০৩ সালে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কিংবা ২০১১ সালে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে মুয়াম্মার গাদ্দাফির মূর্তি পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জিম্বাবুয়েতে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা রবার্ট মুগাবের মূর্তিগুলোও টেনে হিঁচড়ে নামানো হয় ২০১৭ সালের দিকে। বাশার আল আসাদের বিদায়ের পর সবাই প্রশ্ন করছেন সিরিয়া কি খণ্ড বিখণ্ড হতে যাচ্ছে? তবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়।

বিশেষত, রাশিয়া আর ইরানের সমর্থনে এতোদিন টিকে থাকা বাশারের বিদায়ের পরেও তারা ছাড় দিবে না কোনোভাবেই। ইউরোপ অভিমুখে যাওয়া পাইপলাইন ঠেকাতে বাশারের গদি রক্ষার মিশনে নামে রাশিয়া। সিরিয়ার কসাই বাশার মূলত কাতার-টু–ইউরোপ পাইপলাইন বসানোর অনুমতি না দেওয়ার চুক্তিতেই শতসহস্র অপরাধ করে গদি আঁকড়ে বসেছিল। পাশাপাশি ইরান তাদের মতাদর্শগত কারণেই শিয়া বংশীয় আসাদ পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠার পাশাপাশি ব্যস্ত ইরান যখন ইসরায়েলকে সামাল দিতে গিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে চেয়েছে সেই সুযোগ নিয়েছে সিরিয়ার বিপ্লবীরা। তারা ঝড়ের বেগে আক্রমণ চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছে খুনী বাশার আল আসাদের রাশিয়ার দুগ্ধপোষ্য মসনদের আগাগোড়া। রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের পুতুল হিসেবে যখনই তাদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে তখনই চোরের মতো পালাতে হয়েছে বাশার আল–আসাদকে। 

সিরিয়ার বিপ্লবীরা সব বাধা অতিক্রম করে রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়েছে। দীর্ঘদিনের কুকর্মের শাস্তি আর প্রাণভয়ে বাশার পালিয়ে গেছে অজ্ঞাত কোনো স্থানে। তারপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য ভিডিও চিত্রে সয়লাব হয়ে গিয়েছে। অনেকে সিরিয়ার একটি ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে লিখছেন ‘সিরিয়ার গণভবন’। যাই হোক এই ঘটনাগুলো সিরিয়ার ইতিহাসের বিরাট একটি বাঁকবদলের সূচনা। 

এখন আগামীর দিনগুলোতে বোঝা যাবে কী হতে যাচ্ছে বাশার পরবর্তী সিরিয়াতে। বিশেষত, বিপ্লবীরা দখল করার পর সিরিয়ার সরকার চালাবে কারা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন অনেকে। ওদিকে রাশিয়া-ইরানের ঘি-মাংস খেয়ে সাধারণ মানুষের উপর ছড়ি ঘোরানো আসাদ–সমর্থকদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে সেটাও সময় বলে দেবে। 

সামনের দিনগুলোতে সিরিয়া কেমন চলবে তা অনেকাটাই নির্ভর করছেন বাশারের বিদায়ে একাধারে আতঙ্কিত এবং হর্ষচিত্তে উৎফুল্ল জনতার সিদ্ধান্তের উপর। হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের যে মুজাহিদ গ্রুপটির নেতৃত্বে এই বিপ্লব হয়েছে তাদের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি ভবিষ্যৎ সিরিয়ার কর্ণধার হচ্ছেন নাকি অন্য কেউ— সেটা নিয়েও এখন নিশ্চিত করে বলা কঠিন। 

আল–নুসরা ফ্রন্টের এই নেতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছে বছরের পর বছর। তারা সিরিয়ায় কেন্দ্রভিত্তিক একটি ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে আল-জোলানি ও তার অনুগামীরা বারংবার দলের নাম ও গাঠনিক অবস্থানে বদল এনেছিলেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাঁচতেই আল–নুসরা ফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তারপর বাশারের অপকর্মের বিপরীতে দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ে সফলতার মুখ দেখে আবু মোহাম্মাদ আল–জোলানির নেতৃত্ব। 

সিরিয়ার জনগণের মধ্যে এইচটিএসের গ্রহণযোগ্যতা বাশারের পলায়নের পাশাপাশি দামেস্ক পতনের অন্যতম কারণ। রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক এই শক্তির বিরুদ্ধে আবু মোহাম্মাদ আল–জোলানির অনুসারীরা কতটুকু সফল হতে পারেন তার উপরেই নির্ভর করছে বাশার পরবর্তী সিরিয়ার ভবিষ্যৎ। সালাফি মতাদর্শের সুন্নি মুসলমান হিসেবে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এর বিপ্লবীরা মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট পাল্টে দিতে কোনো হঠকারি উদ্যোগ নেবে নাকি আলেপ্পো থেকে হোমস আর দামেস্ক পর্যন্ত আধিপত্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে তার উপর নির্ভর করছে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ। 

দীর্ঘদিনের দমন পীড়নে সিরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ এইচটিএসের প্রতি অনুগত হয়ে গিয়েছে পাশাপাশি বাশার ও তার মতানুসারীদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বাশার পালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় মানুষ যেভাবে বিপ্লবীদের স্বাগত জানিয়ে রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে তার পরিণতি এখানেই শেষ হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে খুন, জখম, জেল, জুলুম কিংবা গুম করে দেওয়ার মতো অপরাধের কোনোটাই বাকি রাখেনি বাশার আল আসাদের বাহিনী। তাই ক্ষিপ্ত জনগণ যদি প্রতিশোধ নিতে যায় তাহলে সেখানে আরেকটি গণহত্যা হবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন অনেকে। তবে আশার বাণী হচ্ছে বিপ্লবীরা ঘোষণা করেছে তারা এখানে প্রতিশোধের থেকে দেশগড়ার দিকে বেশি আগ্রহী। তারা যে কোনোকিছুর বিনিময়ে সিরিয়ার শান্তি চায়। 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিপ্লবীরা বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালির তত্ত্বাবধানে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে দীর্ঘ প্রাণঘাতী সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে এবার যেকোনো মূল্যে থামিয়ে দিতে। তাই তারা শুরু থেকেই বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। বিপ্লবী প্রতিশোধ নেওয়ার বদলে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেই বেশি আগ্রহী। 

রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের বিরুদ্ধে টিকে থাকা কতটা কঠিন তা শুরুতেই বুঝতে পেরেছেন এইচটিএসের নেতা আবু মোহাম্মাদ আল–জোলানি। তাই তিনি যুদ্ধের তুলনায় কূটনিতকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি দামেস্কে গিয়ে বিপ্লবীদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল করা থেকে পুরোপুরি নিবৃত করেছেন। সি এন এনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি সরাসরি বলেছেন “When we talk about objectives, the goal of the revolution remains the overthrow of this regime. It is our right to use all available means to achieve that goal. The seeds of the regime’s defeat have always been within it… the Iranians attempted to revive the regime, buying it time, and later the Russians also tried to prop it up. But the truth remains: this regime is dead.”। 

আবু মোহাম্মাদ আল–জোলানি সিরিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণের থেকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ফলে ভেঙে পড়া তাদের সামাজিক ঐক্যকে শক্তিশালী করতে। তিনি বাশার আল আসাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের উপর ন্যায্যতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন সিরিয়াকে গড়তে চান বলে বারংবার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছেন। বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটলে তবেই বাশার আল আসাদের পতনের সুফল ভোগ করতে পারবে সিরিয়ার সর্বস্তরের জনগণ। নচেৎ রাশিয়া, ইরান আর তুরস্কের আরেকদফা হস্তক্ষেপে বিপ্লবের সুফল বঞ্চিত হয়ে ধ্বংসের মুখে পড়ে ধুঁকতে পারে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন