Logo
Logo
×

অভিমত

চিকিৎসা ও ভারতীয় আগ্রাসন এবং ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম

চিকিৎসা ও ভারতীয় আগ্রাসন এবং ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ

ভারতীয় চিকিৎসকেরা বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা দেবেন না। ভারতের একটি হাসপাতাল ও দু-একজন চিকিৎসকের এমন ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের চিকিৎকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে। বলেছেন, চিকিৎসা ব্যবস্থার ভারত নির্ভরশীলতার কথা। এসব কথা মূলত ভারতীয় প্রোপাগান্ডিস্টদের দ্বারা সৃজিত। যার সিংহভাগই মিথ্যা। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভারতীয় প্রোপাগান্ডায় এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ এখন তার নিজ দেশের চিকিৎসকদের প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগে। অথচ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ভারতীয় গায়ক নচিকেতা আগেই গেয়েছিলেন, ‘হাসপাতালের বেডে টিবি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা। তবু রেডিওটা টিভিটার সাথে সুর ধরে – সারে জাঁহা ছে আচ্ছা’।  

ড. ইন্দ্রজিৎ প্রাসাদ। আমার চিকিৎসক, ভারতেও অনেকের নমস্য। যেহেতু ভারত থেকে আসা প্রচুর রোগী দেখেছি তার চেম্বারে। তিনি একদিন কথায় কথায় বলছিলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের বিভ্রান্তির কথা। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম কয়েক বছর আগেই যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে মানুষের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হয় খুবই অল্প খরচে। আর প্রতিস্থাপনের সাফল্যের হারও সন্তোষজনক। অন্তত ভারতের চেয়ে ভালো। ভারতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে খরচ হতো সেসময়ে পঞ্চাশ লাখ টাকার ওপরে, আর বাংলাদেশে তা করা যেত পনেরো লাখ টাকার মধ্যেই। এখন হয়তো আনুপাতিক হারে বেড়েছে। অথচ কেউ কি এটা জানেন বাংলাদেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হয়, তাও এত কম টাকায়। জানেন না। 

কিডনি প্রতিস্থাপনে বাংলাদেশের ডা. কামরুল ইসলাম দক্ষিণ এশিয়ায় বিখ্যাত মানুষ। বাংলাদেশের কিডনি প্রতিস্থাপনের সাফল্যের হার ভারতের চেয়ে কম নয়। অথচ খরচ ভারতের চেয়ে কম। বাংলাদেশে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঁজর না কেটেই লেজারের মাধ্যমে সফলভাবে বাইপাস করা হয়েছে। করা হয়েছে হার্টের ছিদ্র মেরামত। ভারতের একপাল চিকিৎসক এসে সেই অপারেশন দেখে গেছে, নিজেদের দেশে সেটা করা সম্ভব কিনা তা যাচাইয়ে। এখনো সম্ভবত ভারতে ওই ভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি লেজারের মাধ্যমে হার্টের অপারেশন। 

মাঝখানে বাংলাদেশের ওষুধের মানের কথাও বলা যাক। ভারতের পরম মিত্র রাশিয়াও কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নেয়। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে ওষুধও একটি উল্লেখযোগ্য পণ্য। মান ভালো বলেই বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্বের অনেক দেশেই রপ্তানি হয়। মানের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের ওষুধের চেয়ে এগিয়ে নেই। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানানোর পরিকল্পনা করেছিল। বেক্সিমকোর করোনা টিকার জুয়াচুরিতেই তা প্রমাণিত হয়। করোনাকালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরর গণস্বাস্থ্যের টেস্টিং কীট নিয়ে চলেছে নানান নাটক। দেশে তৈরি করোনার টিকাও বাজারে আসতে দেওয়া হয়নি ভারতীয় টিকা বাণিজ্যের স্বার্থে। 

আমার এক বন্ধুপত্নী মারা গেছেন ক্যান্সারে। বাংলাদেশের স্কয়ার হাসপাতালে কেমো চলছিল তার, কিন্তু ওই যে ভারতীয় প্রোপাগান্ডা, শেষ পর্যন্ত ভারত নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। স্কয়ারের চিকিৎসকেরা যা বলেছিলেন, তাই হয়েছে। উল্টো একগাদা ডলার দিয়ে আসতে হয়েছে ভারতকে চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর নিমিত্তে। ভারতের কলকাতা আর চেন্নাইয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি রোগীদের কেন্দ্র করে হসপিটাল ট্যুরিজম। বিশাল বাণিজ্য এই চিকিৎসাকে ঘিরে। 

গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের বেশকিছু হাসপাতাল চরম বিপর্যয়ে পড়েছে বাংলাদেশি রোগী কমে যাওয়ায়। শুধু হাসপাতাল নয় ওই সব হাসপাতাল অঞ্চলের হোটেল, বাজার প্রায় মানুষশূন্য হয়ে পড়েছে। নিম্নগামী হয়েছে ভারতের চিকিৎসা সেবা থেকে আসা আয়, মানে ডলার। জুলাই বিপ্লবের পর ভারত ভিসা একরকম বন্ধ করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশি রোগী না থাকায় ধুঁকছে কলকাতার হাসপাতালগুলো’। 

খবরের শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘কলকাতার মার্কেট, শপিংমল, হাসপাতালগুলো অনেকটাই নির্ভর বাংলাদেশের পর্যটকদের ওপর। বাংলাদেশি পর্যটক কমে যাওয়ায় নিউমার্কেটের মতো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কলকাতার মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতাল পল্লিতে।’ খবরে বলা হয়েছে, হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে, বাংলাদেশি রোগী কমায় হাসপাতালগুলোর আয় কমেছে ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত। 

মনে করিয়ে দিই, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথা। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক নিয়ে তিনি পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একরকমই মৃতই বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা তাকে ঠিকই সুস্থ করে তুলেছিলেন। তৎকালীন সরকার ভারত থেকে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠিকে বাংলাদেশে উড়িয়ে এনেছিলেন। তিনি এসে বলেছিলেন, এর থেকে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের কোথাও দেওয়া সম্ভব নয়, এমন কথা। সুতরাং প্রোপাগান্ডার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে কিছু নেই যারা বলেন, তারাই মূলত বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত বিশ্বের সমমানে নিতে প্রধান বাধা। 

যাকগে, ভারতের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে এই লেখা শুরু করিনি, করেছিলাম ভারতীয় আগ্রাসন নিয়ে। কিন্তু ভারতের এক সরকারি হাসপাতাল, যেখানে নচিকেতার ভাষায়, ‘টিবি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা’ যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভুলেও যাননি কোনো বাংলাদেশি। সেই হাসপাতাল গলা বাড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা দেবে না। আজব না। আরেক চিকিৎসক নাকি বলেছেন, তিনি বাংলাদেশি রোগী দেখবেন তবে ভারতীয় পতাকাকে নমস্কার করলে। হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের পয়সা না পেলে যাদের বাড়িতে হাঁড়ি উঠবে না, তারাও বলে কিনা বয়কটের কথা। কুঁজোরও চিৎ হয়ে শোবার ইচ্ছে আর কী। 

চিকিৎসা বাদ এবার আগ্রাসন নিয়ে বলি। ভারতীয় আগ্রাসন নয়া কোনো বিষয় নয়। নেহেরু ডকট্রিন ঘিরে এই আগ্রাসনের শুরু। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের অচ্ছুত বাঙালদের পশ্চিমবঙ্গের ঘটিরা বাঙালি স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল। না করলে, আজকে বাংলাদেশের মানচিত্র আরো বড় হতো এবং আমরা হয়তো স্বাধীনতা পেতাম সাতচল্লিশেই, একাত্তর পর্যন্ত অপেক্ষা করতো হতো না। কিন্তু ঠাকুরবাড়িসহ পশ্চিমবঙ্গের সামন্ততন্ত্রের ষড়যন্ত্রে তা সম্ভব হয়নি। দুইটা আলাদা ভূখণ্ড, মানুষের কৃষ্টি-কালচার আলাদা, এমন অদ্ভুত সংযুক্তির দেশ যে টিকে থাকতে পারে না তা বুঝেছিলেন ঝুনা পলিটিশিয়ান জহরলাল নেহেরু। তাই তিনি এমন ভাগই চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এর মাধ্যমেই পুনর্বার সম্পূর্ণ ভারত ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সে আশা এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। বরং উল্টো ঘটেছে। ভারতের সীমান্তে আরেকটি ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীন হবার পর ভারত মনে করেছিলো, এই সীমান্তে তার সামরিক খরচ কমবে। ওই যে বললাম, মানুষ চায় একরকম, নিয়তি চায় অন্যরকম। ভারত চিন্তা করেনি, যে জাতি পাকিস্তানের কাছে মাথা নত করেনি এমনকি ধর্মের ভিত্তিতেও না। সে জাতি কীভাবে কোন যুক্তিতে ভারতের কাছে নত হবে। এখানেই ভারতের ভুলটা। তারা ইতিহাসও ভুলে গিয়েছিল কিংবা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। শিক্ষা নেয়নি লক্ষণ সেনের পলায়ন থেকেও। শিক্ষা নেয়নি যে এই ভূখণ্ড সেন বংশের সময়কাল ছাড়া কখনো আর্যদের দ্বারা শাসিত হয়নি। শোষিত হয়েছে, কিন্তু শাসন মেনে নেয়নি। 

এবারও সেই একই ভুল করেছে ভারত। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ভারতের বিজেপি সরকার। বাংলাদেশে ধর্মীয় দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে ভারতের তরফ থেকে। এতদিন হয়তো আড়েঠারে একথা বলতে হতো। কিন্তু ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হিন্দুত্ববাদীদের হামলার পর তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিগত রেজিম যে ভারতের মাধ্যমেই টিকে ছিল, তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে দ্বন্দ্বে থাকা মানুষদের কাছেও। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশিদের আরো ঐক্যবদ্ধ করেছে। বিশেষ করে তরুণরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ এই স্লোগান নিয়ে। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। সারাদেশের মানুষ শিক্ষার্থীদের স্লোগানে গলা মিলিয়েছে। সারাদেশে প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দেবার। 

ফুটনোট: কথায় কথায় ভারতীয় রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, চাল, আলু রপ্তানি বন্ধ করে দেবার কথা বলেন। তাদের প্রিয় শাসক শেখ হাসিনার আমলেও একবার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন বাধ্য হয়েই বাংলাদেশকে তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। আটকে থাকেনি পেঁয়াজ আসা। মূলত আটকে থাকে না কিছুই। চাল আমদানির আরও দেশ রয়েছে বরং পাওয়া যাবে ভারতের চেয়েও কম দামে। সুতরাং অযথা ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশি রোগী কমে যাওয়ায় ভারতের হসপিটাল টুরিজমের যে বেহাল দশা, পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলেও সে দশাই হবে। পচবে পেঁয়াজ সাথে ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বিষয়টিও। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন