পরিকল্পিত ‘চরম নৈরাজ্যে’র পূর্বাপর এবং হঠকারীতার আলাপ
বিবিসির বাংলাদেশ নিয়ে খবরের শিরোনাম, ‘ঢাকায় চরম নৈরাজ্য, যখন তখন সংঘর্ষ বিক্ষোভ, ইচ্ছে হলেই রাস্তা বন্ধ’। যারা বোঝেন এই একটা খবরেই বর্তমান পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারবেন। যারা ঘটনা প্রবাহে চোখ রাখেন, তারা বিবিসির এই খবরটা পড়ার পর বিবিসির জন্য প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন, গত একমাস ধরে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান’ নামে একটি সংগঠন ঢাকায় লোক জমায়েতের চেষ্টা করলো, তা নিয়ে বিবিসির কোনো খবর নেই কেন?
গতকাল সোমবার সকালে শাহবাগে ওই সংগঠনের লোক জমায়েতের চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর কেন এই ‘চরম নৈরাজ্য’র খবর প্রকাশিত হলো। নাকি তারা আরও বেশি নৈরাজ্যের আশায় ছিল, প্রশ্নটা এভাবেও তুলতে পারেন। প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করার শক্তিটা অর্জন করেছি আমরা জুলাই বিপ্লবের পর। এখন প্রশ্ন করলে অন্তত মামলার ভয় নেই। গণমাধ্যমের ওপর সরকারি পর্যায়ে হয়রানির সুযোগ নেই। প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশের না হয় প্রশাসনে একধরনের অস্থিরতার কারণে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল, কিন্তু বিবিসির অনুসন্ধান তো ব্যর্থ হবার কথা নয়, এমন কথায়।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘বিপ্লবের অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকায়’। তিনি সরকারে আছেন, তিনি তো তার সাফাই গাইবেনই। তাই এ বিষয়ে পরে বলি। আগে বলি, গত কদিনের দৃশ্যপটের কথা। কদিন আমরা কী দেখতে পেলাম। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর এই তো। সাদাচোখে দেখা এসব ঘটনাকে যদি বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে কিন্তু অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুধুমাত্র সাদাচোখের ভরসাতে এসব ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল।
বিশেষ করে রবি ও সোমবার ঢাকায় তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা, বুটেক্স ও ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গোলযোগ এসব ঘটনাকে নজর-আন্দাজ করা হবে চরম বোকামি। কেন বোকামি তাও বলি, লক্ষ্য করুন জুলাই বিপ্লবে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ছিল ফ্যাসিস্ট প্রতিরোধের অন্যতম স্থান। এখানেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে জুলাই বিপ্লবে। সেখানে যে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে তারাই আজ নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত। অর্থাৎ বলতে গেলে তারা বিভক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে। একই কথা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেলাতেও।
এই বিভক্ততার বিপরীতে দেখুন, কৌশলে ঢাকায় লোক জড়ো করার চেষ্টা হচ্ছে। অহিংস গণঅভ্যুত্থান নামে একটি ভূঁইফোঁড় সংগঠন হঠাৎ করেই এমন একটা কাণ্ড ঘটানোর চেষ্টা করবে, এমন ভাবাও চরম বোকামি। গণমাধ্যম জানিয়েছে, এই প্রচেষ্টা চলছে গত একমাস যাবত। বিশেষ করে গ্রামের কিংবা শহরের বস্তি এলাকার মানুষদের টার্গেট করে এই চেষ্টা চালানো হয়েছে। যারা সহজ-সরল, রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি যাদের মধ্যে নেই সেই সব মানুষদেরই ঢাকায় জড়ো করার চেষ্টা হয়েছে। সাথে রয়েছে ব্যাটারিচালিত রিক্সাওয়ালাদের দাবি। যোগ হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও। এনিয়েও বিক্ষোভ হয়েছে। সবমিলিয়ে বিবিসির শিরোনামে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া ‘চরম নৈরাজ্য’ সৃষ্টির চেষ্টা ছিল ঢাকায়। ঢাকার শাহবাগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ। ব্যাটারি চালিত রিকশাওয়ালারা, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জড়ো হওয়া লোকজন। অন্যদিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ। কী ভয়াবহ অবস্থা কল্পনা করুণ তো একবার।
প্রশ্ন করতে পারেন অন্যসবের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘাতের যোগটা কোথায়। বলছি, ভেবে দেখুন, আনসাররা যখন অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলো, তখন ঠেকিয়েছিল কারা, এই শিক্ষার্থীরাই তো। বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে যে মূল শক্তি তারা জানে, বিবিসির শিরোনাম সৃষ্ট ‘চরম নৈরাজ্য’ কারা ঠেকাতে পারে, পারে শিক্ষার্থীরাই। সুতরাং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান ইস্যুতে যদি বিভেদ বাঁধিয়ে রাখা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা আর জোটবদ্ধ হবে না। অতএব ‘চরম নৈরাজ্য’ সৃষ্টিকারীদের বাধা দেয়াও সম্ভব হবে না।
‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান’ তখন সহিংস হয়ে উঠবে। আর সরকার পড়বে চরম বেকায়দায়। আর সে বেকায়দা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সম্পর্কে সম্ভবত বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ক্ষমতার ভাগাভাগি আর দখলদারিত্বে লিপ্ত থাকা রাজনীতিকদের। অথচ তাদেরই এই সম্ভাবনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাববার কথা। কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে।
কতটা পরিকল্পনার সাথে এগুচ্ছে জুলাই বিপ্লবের বিরোধীরা। এককথায় প্রতিবিপ্লবীরা। একদিকে বিপ্লবের শক্তিকে বিভক্ত করছে, অন্যদিকে প্রতিবিপ্লবীদের একতাবদ্ধ করছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে ইসকন বহিষ্কার করেছে। তারপরও সে ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ নামে একটি জোট গঠন করে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় হিন্দু সম্প্রদায়কে উস্কানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের রাস্তায় নামানোর চেষ্টা চলছে। সে চেষ্টা যে খুব একটা ব্যর্থ তাও বলা যাবে না। এতদিন পারেননি কেন, এমন প্রশ্নও তাদের করা যাচ্ছে না। এমন প্রশ্ন করলেও তা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিধা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে খেয়াল করেন, ছাত্র সমন্বয়করা সংঘর্ষে লিপ্ত তিনটি কলেজকেই আলোচনার জন্য ডাকলেন, কিন্তু দুটি কলেজ আসেনি। ‘আজকের পত্রিকা’ এ ব্যাপারে তাদের খবরের শিরোনাম করেছে, ‘সমন্বয়কদের বৈঠকে যাচ্ছে না কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ’। এই খবরের ভেতরেই সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি থেকে বলা হচ্ছে, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী কলেজ কবি নজরুল কলেজ যেহেতু যাচ্ছে না সেহেতু আমরাও যাব না। আমাদের ছাত্রদের রক্তের ওপর দিয়ে আমরা কোনো সংলাপে যাব না।
মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সঙ্গে কোনো বৈঠক করব না।’ জানি না, এই অধ্যক্ষ মহোদয় ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের ভয়াবহ মুহূর্তগুলিতে শিক্ষার্থীদের সাথে এমন ভাবে ছিলেন কিনা। জানি না, কাকলী মুখোপাধ্যায় জুলাই বিপ্লবে অগনতি শিক্ষার্থীদের মৃত্যুতে এমন কঠিন কথা উচ্চারণ করেছিলেন কিনা। করলে অবশ্যই তার নামটা শোনা যেত। কিন্তু যায়নি। তবু তাকে ধন্যবাদ জানাই, সে এখন অন্তত শিক্ষার্থীদের পক্ষে রয়েছেন। কেন রয়েছেন, এমন প্রশ্ন রেখেই তাকে ধন্যবাদ জানানো।
বিবিসির শিরোনাম অনুযায়ী এই ‘চরম নৈরাজ্য’ এর পেছনে কে বা কারা অথবা কোন শক্তি তা সবার কাছেই পরিষ্কার, শুধু পরিষ্কার নয় জেগে ঘুমানো মানুষদের কাছে। সেই শক্তি বা জেগে ঘুমানো মানুষদের কথা থাক।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কথায় আসি। তার কথা অনুযায়ী সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবের মিত্র অনেকেই আজ হঠকারীর ভূমিকায়। এই ভূমিকাগুলোয় যারা, তাদের মুখোশ উন্মোচন এখন সময়ের দাবি। তবে বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমান সবচেয়ে ভালো কথা বলেছেন এই ‘নৈরাজ্য’ বিষয়ে। তিনি বলেছেন, ‘দেশের ভেতরের-বাইরের অপশক্তি ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা করছে’, যা গণমাধ্যম উদ্ধৃত করেছে। এটাই সত্যি। সুদূর লন্ডন থেকেও তারেক রহমান যেভাবে সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন, সেভাবে কি পারেন অন্যরা? প্রশ্নটা রাখলাম ভেবে দেখার জন্য। তারেক রহমান দেরিতে ফিরলে এবং দ্রুত নির্বাচন হওয়ার সমীকরণে যাদের প্রধানমন্ত্রী হবার ইচ্ছে, প্রশ্নটা তাদের জন্যেও।