পুরোনো ছবি
মানুষ মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্যটি অমানবিক। একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক কোনো শহরে রিকশা নামক যন্ত্রটির উপস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে ওই রাষ্ট্রের ও সমাজের ব্যর্থতা বোঝায়। ঢাকা শহরে রিকশা থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে অন্তত তিন দশক ধরে বিতর্ক চলছে। অনেকে রিকশাওয়ালাদের ব্যাপারে আবেগী হয়ে পড়েন, কেউ পারলে এই মুহূর্তেই রিকশা উঠিয়ে দিতে চান। তবে, সমস্যাটা পলিটিক্যাল ইকোনমির।
আরও প্রায় একশো বছর আগেই ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলের শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের তীব্র অভাবের কারণেই লোকে রিকশা চালনার মতো পেশা বেছে নেয়। গ্রামাঞ্চলে কাজের বা খাদ্যর সংকট হলে লাখো লাখো মানুষ শহরে এসে সবচেয়ে সহজে যেই কাজটার সঙ্গে যুক্ত হয় তা হচ্ছে রিকশা চালনা।
দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হলেও, চিত্রটা হরেদরে একইরকম। এই মানুষগুলোর শিক্ষা-দীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র, এদের জন্য যথেষ্ঠ কর্মসংস্থান নেই। কৃষির বেহাল দশা। দেশে বিনিয়োগেরও পরিবেশ প্রতিকূল। ফলে, এক শ্রেণির তরুণ কোনোভাবে বিদেশ গিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। আর যারা পারে না তারা শহরে এসে রিকশা চালায়।
ফলত, রিকশা রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে রাখঢাক করে রাখে। নাগরিকের শিক্ষা, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি আর কর্মসংস্থান করতে রাষ্ট্রের ও সমাজের যে ব্যর্থতা তা ঢেকে দেয়। শুধু তাই না, রাজধানী ঢাকা শহরে চলাচলের রাস্তা অত্যন্ত কম। অন্যদিকে জনসংখ্যা অত্যাধিক বেশি। একটা বড় অংশের রাস্তা দিয়ে বড়বড় যানবাহন চলতে পারে না। তদুপরি গণপরিবহনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। নারী, শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের জন্য তা মোটেই সহায়ক নয়। এইসব মিলিয়ে রিকশা ছাড়া ঢাকা শহরের গতি নাই।
আর, এই রিকশা নিয়ে চলে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালীদের রমরমা ব্যবসা। রিকশায় লাইসেন্স ব্যবস্থা এমন যে তাতে আসলে ক্ষমতাশীনদের ও কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে চলা ছাড়া উপায় নাই। রিকশা নির্মাণের সঙ্গেও জড়িত লাখো লাখো মানুষ। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ব্যাটারি বা মেশিন রিকশা। এগুলোর লাইসেন্স, নির্মাণের পাশাপাশি আমদানির সঙ্গেও অনেকে যুক্ত হয়েছে।
প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারি রিকশা শ্রেয় হলেও, এর প্রযুক্তি এখন নিরাপদ নয়। জোড়াতালি দিয়ে বানানো এইসব রিকশা ভীষণ ঝুকিপূর্ণ। অথচ, এগুলোকে উন্নত করার জন্য রাষ্ট্রীয় বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোনো উদ্যাগ নেই। রিকশার বাজারের যে আকার এবং যেই পরিমাণ মানুষ এই শিল্পে যুক্ত, তার তুলনায় এর উন্নয়ন করার খরচ একদমই কম। সম্ভবত, রাজনৈতিক পান্ডাদের রিকশার চাঁদা ও অন্যন্য বিষয় নিয়ে রমরমা ব্যবসার জন্যই রাষ্ট্র আগ্রহী হয় না।
মোদ্দা কথা, রিকশার সমস্যাটা রাজনৈতিক ব্যর্থতার। এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। এর সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, প্রয়োজন দক্ষ দিকনির্দেশনা। দেশ থেকে স্বৈরাচারী সরকার বিতাড়িত হয়েছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা কমেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সুবর্ণ সুযোগ রিকশা সমস্যাটাকে সমাধান করার। একটা কার্যকরী কমিশন করে দিয়ে এর সার্বিক সমাধান জরুরি।
রাষ্ট্র যদ্দিন নাগরিকের দক্ষতা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে না পারবে, রিকশা আটকানো কঠিন। এর ফলও ভালো হবে না। ফলে, রিকশা কমিশন করে রিকশাকে নিয়মতান্ত্রিক করা ছাড়া আপাত অন্য উপায় নেই।