তারেক রহমান কি জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারবেন
সুবাইল বিন আলম
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ পিএম
বিভিন্ন গ্রুপে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হুট করে চোখে পড়লো রুহুল কবীর রিজভীর স্বাক্ষর করা নোটিশ। তারেক জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে “আবারও” কোনোরূপ অনুষ্ঠান পালন না করতে নির্দেশ। খুঁজে দেখলাম এই নির্দেশ আগেও দেয়া হয়েছে, এবার তার রিমাইন্ডার। তারপর আর একটা পোস্টার তারেক রহমানের, “আমার নামের সাথে কেউ দেশনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক ব্যবহার করবেন না।“ এরপর মনে হলো উনার সাম্প্রতিক কার্যকলাপের পর আসলে উনাকে নিয়ে যা আলোচনা হওয়ার ছিলো তার কিছুই হচ্ছে না। অথচ কিছু না করলেও বহু পাতি নেতাকে আলোচনার টেবিলে দেখি।
এর দায় কি উনার দেশে না থাকা? নাকি মিডিয়ার সৎ ছেলে হয়ে থাকা? নাকি বিএনপির সফট পাওয়ার না থাকা? যাই হোক, এ দায় থেকে আসলে বিএনপি নিজেই মুক্ত থাকতে পারে না।
নিজের খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে শোনা কিছু গল্প দিয়ে শুরু করি। বিএএফ শাহীন কলেজের সূত্র ধরে উনি আমার কলেজের বড় ভাই। যখন ছাত্র ছিলাম, সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। যারা যারা উনাকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন, কেউ উনাকে চরম মেধাবী বলেন নাই। কিন্তু উনার ব্যবহারের প্রশংসা সব সময়ই ছিলো। এক শিক্ষক বলেছিলেন, সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে কোনো শিক্ষককে দেখলে নেমে সালাম দিতেন। এদিকে জিয়ার কড়া নির্দেশ ছিলো, কখনোই যেন প্রেসিডেন্টের ছেলে হিসেবে ট্রিট না করা হয়। ফলে তখনকার আমলের বেত্রাঘাত দেয়া হলেও কখনোই কোনো শিক্ষককে নাজেহাল হতে হয়নি। এরপর উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ালেখা করলেও আওয়ামী লীগ ওই সার্টিফিকেটও কেড়ে নিতে কম চেষ্টা করে নাই।
চাকরি সূত্রে কিছুদিন ছিলাম ওয়ান গ্রুপে। ২০০৮ সালের দিকে। তখন যারা উনাকে চিনতেন উনার ব্যবহারের প্রশংসা করতেন। যাই হোক, একটা রুম ছিলো বদ্ধ। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওইটা খাম্বার রুম। তো একবার ঢুকে কাগজ ঘাঁটছিলাম। সব দেখতে পারি নাই, কিন্তু ওয়ার্ক অর্ডার ১০০ কোটির খুব বেশি ছিলো না। আর সব ম্যাটেরিয়াল ডেলিভারি হয়েছে। তাহলে দুর্নীতি কয় টাকার হয়েছে? এর মধ্যে ডেডলাইন মিট করার জন্য জেমকনকে দেয়া ওয়ার্ক অর্ডারও ছিলো (অ্যামাউন্ট ভুলে গেছি, কিন্তু সেটাও ১০ কোটি টাকার উপর)। এটা কি এই যুগে বিশ্বাস করা সম্ভব? পিনাকী ভট্টাচার্যের এটা নিয়ে একটা দারুণ ভিডিও আছে, দেখতে পারেন।
র্যাংগস ওয়ার্কশপে উনার গাড়িবহর মেইনটেইনেন্সের জন্য আসতো। তখন ২০০১-এর পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায়। কখনো কোনো টাকা বাকি রাখে নাই। বরং একবার ওয়ার্কশপের সবার জন্য পাঞ্জাবি পাঠিয়েছিলো। এরকম একজন মানুষকে আমরা চিত্রিত হতে দেখেছি ভয়ংকর খুনি, জিঘাংসাপরায়ণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে!
১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর জন্মের পর মাত্র ৪ বছর বয়সে বাবাকে দেখেছেন যুদ্ধে যেতে। মায়ের সাথে নিজেও ছিলেন বন্দী। নিজেদের বাচ্চার দিকে চিন্তা করে দেখুন তো, এরকম জীবন কি দেশের জন্য আপনিও দিতে পারবেন? ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের সময়ে আবারও বাবাকে বন্দী হতে দেখলেন। এরপর রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও নিতে পারেন নাই কোনো সুবিধা। জিয়াউর রহমান হত্যার পর একটা ভিডিওতে উনাকে বাবার জামাকাপড় ছোট করে পরতে শুনি। বাংলাদেশ শুধু না, বিশ্বের কয়জন রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে এমন ছিলো বলতে পারেন? এরপর গ্র্যাজুয়েশনের সময় মা ছিল হাউজ অ্যারেস্ট, এরশাদের সময়ে। এরপর আসলো ২০০৬ সাল। তখন পেয়েছে শাররিক অত্যাচার, বিদেশে যেয়ে থাকতে হলো। দেশে আসতে পারেন না, মায়ের সাথে কথা বলতে পারেন না (রেকর্ড হতো), ভাই মারা গেলো, দেখতে পারলেন না। মা অসুস্থ। যেতে পারেন না। এ রকম ভুক্তভোগী এই দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে খালেদা জিয়ার পরেই উনিই।
২০০১ থেকে বিএনপির দ্বায়িত্বে এসেই দলের তৃণমূল গঠন করেছিলেন। তার ফল পেয়েছেন। এত বছর হয়ে গেছে, লীগ এত চেষ্টা করেছে, কিন্তু দল ভাংতে পারে নাই। আর এটা তারেক রহমানের সবথেকে বড় সফলতা। কিন্তু ব্যর্থতা কি নেই? হাওয়া ভবনের নামে যে কথা উঠেছে, তার বিপক্ষে এখনো কোনো বড় স্টেটমেন্ট দেখা যায় না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর জজ মিয়া নাটকের কি প্রয়োজন ছিলো? আবার ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নষ্টের চেষ্টার দায়ভার থেকে রক্ষা পাওয়ারও উপায় নাই। কিন্তু রাজনৈতিক উপায়ে দায়মুক্তি না নিয়ে আদালতে উনার মায়ের মতো মোকাবেলা করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা। আশা করবো, এখন ঠিকমতো সবকিছুর বিচার হবে।
এখানেই আমাদের আশাবাদী করার শুরু। জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর থেকে দেশের সব হতাশার মধ্যে তারেক রহমানের ভাষণ এবং কাজ। দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ভাষণ এবং চেষ্টা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ নেতারা উনার চাওয়ার সাথে তাল না মিলিয়ে এখনো আগের মতোই চিন্তা করছে, যা আসলে দুঃখজনক।
দল এত দিন ধরে একতাবদ্ধ থাকলেও এখন সেই চেইন অব কমান্ড করে ফেলেছেন সিনিয়র নেতারা। ফলে দলের তৃণমূলের অনেকেই চাঁদাবাজির সাথে জড়িয়ে গেছে। হাজারের উপর বহিষ্কারেও ফল দেখা যাচ্ছে না। নেতাদের মধ্যেও নাই ঐকতান। এক একজন এক এক রকম কথা বলছে। কিন্তু উনি নিজে সরকারকে সব রকম সহায়তা দেয়ার কথা বলেছেন। ৩১ দফা সংস্কার আর সুনির্দিষ্ট করার কথা বলেছেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনীতি পারিবারিক না করা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করাসহ অনেক কিছু করতে চেয়েছেন। যা আসলে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এত সত্ত্বেও সমালোচনা কি নাই?
সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের অনেক খুঁজেও উনার নামে বিদেশে কোনো অর্থ পাননি। কিন্তু উনি একটা গোয়েন্দা রিপোর্ট শেয়ার করেছেন চাঁদাবাজদের নামের। তারা এখনো বহাল আছে দলে। দেশের সমস্যা যদি কমাতে আমরা গণতন্ত্র চাই, তাহলে দলের সমস্যা সমাধানেও গণতন্ত্র সমাধান। কাউন্সিল হলে তারা ছায়া সরকার করতে পারে। যা মন্ত্রণালয় ভেদে এই সরকারকে সাহায্যই করতো। আর নিজেরাও নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারতো ভবিষ্যতের জন্য। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে এই দায় উনারই।
সবশেষে উনার অবশ্যই মিডিয়া ফেস করতে হবে। সব সমালোচনার উত্তর দিতে হবে। প্রফেসর ইউনূস যেমন দেশের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তারেক রহমানের এরকম ঢাল হতে হবে। দেশি-বিদেশি সব মিডিয়ার কাছে যেতে হবে। শুধু ভাষণ এই যুগে যথেষ্ট না।
উনার চারপাশে অনেকেই দেয়াল হয়ে সাধারণ মানুষ থেকে আড়াল করে রেখেছেন বলে শোনা যায়। কিন্তু শহীদ জিয়া তো এরকম ছিলেন না। সারা দেশে উনি হেঁটেছেন, এবং তাই এখনো উনি মানুষের কাছে বেঁচে আছেন। উনাকে এইভাবে গণমানুষের কাছে যেতে হবে। ৬৪ জেলা ঘুরতে তিন মাস হয়তো লাগবে, কিন্তু উনি দেশকে বুঝতে পারবেন। এক এক জেলার এক এক রকম গন্ধ আছে, তা বুঝতে হলে উনার বাবার পথ ধরা ছাড়া উপায় নাই।
সামনে উনি দেশে আসবেন। দেশ এখন আর আগের মতো নাই। ইংল্যান্ডের থেকে ভালোভাবে গণতান্ত্রিক সিস্টেম শেখার জায়গা আর নাই। ২০০৬-এ দ্বায়িত্ব সুষ্ঠূভাবে না ছাড়তে চাওয়ার মতো অবস্থা দেখতে চাই না। আমরা চাই জনতার জিয়াউর রহমান যে জায়গায় বাংলাদেশকে রেখে গিয়েছেন, খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন স্থিতিশীলতা, সেই জায়গা থেকে নতুন স্বনির্ভর বাংলাদেশে এগিয়ে যেতে পারার স্বপ্ন অনেকেই দেখতে চাইবে। আমরা আর স্বপ্ন দেখতে চাই না, বাস্তবে নিয়ে আসা দেখতে চাই। উনার জন্মদিনে এটা কি খুব বড় আশা?
সুবাইল বিন আলম, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]