ড. ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের কোনো একজন মানুষকেও যদি সারা দুনিয়া চিনে থাকেন তবে তিনি অতি অবশ্যই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল তো প্রতিবছরই কেউ না কেউ জেতে, কিন্তু প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল পাওয়া ইউনূস সারা দুনিয়াতে পরিচিত হয়েছেন সামাজিক ব্যবসার ধারণা উপস্থাপন করে। পৃথিবীর বহু নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে পড়ানো হয়, বহু দেশে ইউনূসের মডেল বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। দুনিয়ার সব সেলিব্রেটিরা তার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। আর দুর্দান্ত বক্তাও তিনি। উনার বক্তব্য শোনার জন্য চড়া মূল্যর টিকেট কাটতে হয়। কোটি টাকার নিচে উনার বক্তব্য আয়োজন করা যায় না।
অথচ, বাংলাদেশের এক ক্রান্তিলগ্নে এই মানূষটি দেশের ক্ষমতাভার গ্রহণ করেছেন। যেসময় তার পরিকল্পনায় প্যারিসে অলিম্পিক চলছে সেই মুহূর্তে গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনা পালায়, আর ছাত্র-জনতার অনুরোধে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সরকারের ১০০ দিন পার হয়েছে। আর এই উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন সুবক্তা ইউনূস।
এই বক্তব্যে আশাবাদ ছিলো, ভরসা ছিলো, দৃঢ়তা ছিলো, আত্মসমালোচনাও ছিলো। সব মিলিয়ে যথারীতি তিনি মুগ্ধ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’
ভাষণের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদ এবং গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক, জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সব শহীদকে সশ্রদ্ধ সালাম ও গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে স্মরণ করেন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, যারা ৯ দফা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, যারা এক দফা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং যারা দেশকে এক হিংস্র স্বৈরাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তাদের।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।’
শুধু জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, গত ১৫ বছরের সব অপকর্মের বিচার করা হবে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন, খুন হয়েছেন এই সময়ে। গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনপ্রধান তাকে জানিয়েছেন, অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১ হাজার ৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা, এই সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কারও সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।’
শহীদ পরিবারদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সাহায্যর আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। হিন্দু সম্প্রদায়সহ সমস্ত নাগরিককে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা হিন্দুদের উপর অত্যাচারের মিথ্যা বয়ান হাজির করে কিভাবে দেশকে হেয় করতে চেয়েছে সেই চিত্রও তুলে ধরেন।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগগুলো তুলে ধরে ড. ইউনূস স্বীকার করেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সরকার লুকোছাপা করছে না এবং দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদের এই ম্যান্ডেট দিয়েছেন। যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম, তারা ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি দেখছেন। কয়েকটি সংস্কার কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে। আমার অনুরোধ, আপনারা এই প্ল্যাটফর্মে উৎসাহ সহকারে আপনাদের মতামত জানাতে থাকুন। সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে কয়েক মাস লাগলেও তা তিনি নিশ্চিত করতে চান। বাংলাদেশের সামনে যে সুযোগ, তা যেন কোনভাবেই হাতছাড়া না হয়।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বাগপ্টুতায় জাতিকে আবারো মুগ্ধ করেছেন। তবে, তা যেন তিনি অতি অবশ্যই কর্মে পরিণত করেন তার জন্য সবাই অধীর অপেক্ষায় থাকবে। দেশের মরণ-বাঁচন এর উপর নির্ভরশীল।