পহেলা অগ্রহায়ণঃ বাংলার আদি নববর্ষের খোঁজ
আকবরের বৈশাখ নাকি শশাঙ্কের অগ্রহায়ণ! শকাব্দ নাকি বঙ্গাব্দ? বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক যাত্রার অভিমুখ হবে কোন দিকে? ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুশীলন আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়? এখানে তর্ক বিতর্ক আর বর্ণনার ডামাডোলে হারিয়ে হাওয়া ইতিহাসের সেই নবান্ন আর অগ্রহায়ণকে একটু খোঁজ করা যাক। আমরা তো জানি যে সৌর বছরের হিসেবে আমাদের যে দিনপঞ্জি সেখানে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর একবারের আবর্তন সম্পন্ন করার সময় থেকে খুঁজে নেওয়া হয় আধুনিক বছরকে। অন্যদিকে কেউ কেউ দিনপঞ্জি তৈরি করেন চান্দ্র বছরের বাস্তবতায়। ওদিকে দিনপঞ্জির এই বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বদলে যায় বছরের প্রথম মাস তথা নববর্ষের দিনও।
আকবরের চাপিয়ে দেওয়া খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তৈরি সেই পহেলা বৈশাখি নববর্ষের আগেও বাংলার মানুষের নববর্ষ ছিল। মরা কার্তিকের পর তাদের জীবনে নবান্নের নামান্তে আনন্দের জোয়ার নিয়ে হাজির হতো অগ্রহায়ণ। মানুষ কীভাবে এই সময় নির্ধারণ করেছিল তখন? প্রশ্ন উঠতে পারে চাঁদ কিংবা সূর্যের হিসেবে প্রচলিত মাসগুলোর ধারণা যখন তাদের ছিলোই না। তারা কীভাবে তৈরি করেছিল তাদের এই বছরের হিসেব? বাস্তবতা হচ্ছে চন্দ্র-সূর্যের গতি লক্ষ করার আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা ধারণা বাংলার মানুষের প্রয়োজনই হয় বছরের বারোটা মাসকে আলাদা ভাগ করে নিতে। তারা প্রকৃতি প্রতিবেশ আর ফসলের উপর নির্ভরশীল জীবনে বছরের বারোমাসের নাম দিয়েছিল বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে। তখন কোন মাসের নাম কীভাবে কিংবা কেনো দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে বক্তব্য থাকতে পারে। তবে বছরের প্রথম মাস কীভাবে অগ্রহায়ণ না নিয়ে আলোচনার অবতারণা করা যেতে পারে ঠিক এভাবে।
শব্দের উৎপত্তি তথা ব্যুৎপত্তি থেকে দেখতে গেলে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস হিসেবে ‘অগ্রহায়ণ’ নামটাতেই রয়েছে বড় প্রমাণ। কারণ সেখানে ‘অগ্র’ শব্দের মানে আগের তথা প্রারম্ভিক। আর ‘হায়ণ’ মানে বছর। অর্থাৎ ‘হায়ণ’ বা বছরের প্রারম্ভে তথা ঠিক শুরুতেই যেই মাস সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল অগ্রহায়ণ। কবি জীবনানন্দের সেই মরা কার্তিকের পর নবান্নের পয়গাম নিয়ে হাজির হওয়া এই অগ্রহায়ণেই ছিল বর্ষবরণের আমেজ। তখনকার দিনে নতুন ধান থেকে তৈরি চালের পিঠা-পুলি আর ভাত খেয়ে সবাই শুরু করতো নতুন বছরের দিন গোনা। আর সেখানে কৃষিপ্রধান দেশের বর্ষবরণ হতো পুরোপুরি কৃষিকেন্দ্রিক।
কৃষি ইতিহাসের গবেষকগণ আরও ভালো বলতে পারবেন। প্রত্নতাত্ত্বিক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহসান ধান ও চালের এই বিবর্তনকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপনে। তিনি বলেছিলেন দুটি বিশেষ ধরনের ধান-চালে আবর্তিত হতো তখনকার দিনের বাংলার মানুষের খাদ্যচক্র। আশু তথা আউশ আর আমন। আর আশু কিংবা আউশকে একপাশে রাখলে বাংলার মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য তথা ধান হিসেবে আমনকে রাখা হতো তালিকার সবার উপরে। আর সে হিসেবে আমন ধান ওঠার পর তাকে কেন্দ্র করে পালিত হতো নবান্ন উৎসব। এই নবন্নের সঙ্গে নববর্ষ যুক্ত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আনুষঙ্গিক আলোচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক সৈয়দ কামরুল আহসান আরও বলেছিলেন তখনকার দিনে ধানের পাশাপাশি খড় এবং ধানগাছের নাড়াও ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই খড় খাওয়াতে হতো গরুর মতো গবাবি পশুকে আর উচ্ছিষ্টাংশ তথা নাড়া দিয়ে চলতো গ্রামের মানুষের জ্বালানির কাজ।
গ্রামীণ শৈশবের সঙ্গে আপনারা কেউ কেউ নিজেকে একটু মিলিয়ে নেবেন !! এই ধানগাছের নাড়া দিয়ে গর্তের মধ্যে আগুন লাগিয়ে কলাগাছের খোল দিয়ে তৈরি পাইপে ধোঁয়া বের করার গল্পটা তাদের জানা থাকার কথা। শৈশবে ‘ইটভাঁটা খেলা’ নামে পরিচিত সেই খেলার সঙ্গেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যাই হোক চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী এই মাস সামনে রেখেই বলেছিলেন-
‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস।
বিফল জনম তার, নাই যার চাষ।’
তিনি বোঝাতে চেয়েছে মানুষের খেয়ে পরে বাঁচবনার জন্য অগ্রহায়ণ কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের জীবনে। ওদিকে খনার বচনেও জানা গিয়েছে অগ্রহায়ণ বন্দনা। খনা বলছেন ‘যদি বর্ষে আঘনে। রাজা যান মাগনে।’ আমরা যদি তার বক্তব্যে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তা অর্থ দাঁড়ায় ‘অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি পড়লে রাজাকে ঋণের মধ্যে পড়তে হয়’। কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে অগ্রহায়ণের ধান কাটা মৌসুমের বৃষ্টি ফসলকে নষ্ট করে দেয়। আর নতুন ফসল তোলার কালের রোদ ঝলমলে আকাশ তৃপ্তির হাসি নিয়ে আসে কৃষকের মুখে। কৃষিপ্রধান অঞ্চল হিসেবে বাংলার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। তাই নতুন ফসল তোলার মাসটাই তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ তথা গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আর হয়তো এ কারণেই মাছ, ধান আর কৃষির দেশ বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরে নিয়েছিল অগ্রহায়ণকেই। সে হিসেবে বছরের প্রথম দিন ছিল নবান্ন। আর এই নবান্ন ও নববর্ষ মিলে মিশে একাকার হয়েছিল অভিন্ন সাংস্কৃতিক স্রোতধারায়।
ওপার কিংবা এপার বাংলায় সাংস্কৃতিক বাস্তবতা থেকে ধর্মীয় অবস্থান আর জোরাজুরি হয়ে গিয়েছে বর্ষবরণের মূল প্রতিপাদ্য। এখানে ইতিহাসের তথ্য, সাংস্কৃতিক উদ্যাপন আর বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়েছে ‘পহেলা বৈশাখ’ কিংবা ‘পহেলা অগ্রহায়ণের’ উদ্যাপনের পাদপীঠ। বাংলা সন তথা এই চিরচেনা ‘বঙ্গাব্দ’ এটার প্রবর্তন করেছিলেন কে? কিংবা এই ‘বাংলা নববর্ষ’ উদ্যাপন শুরু হবে কোথা থেকে তা নিয়ে দেদার বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশের গবেষকদের বিশ্বাস শুরুটা হয়েছিল সম্রাট আকবরের মাধ্যমেই। আর সে হিসেবে তাদের দুস্তর আগ্রহ এটাকে বৈশাখ থেকে শুরু করার। মজার ব্যাপার বাংলাদেশে এই বৈশাখকে করা হয়েছে ‘সেকুল্যারকরণ’। বাংলাদেশের বাস্তবতায় খোদ ‘বৈশাখ উদ্যাপনকে’ অনেকে অধর্মের প্রতীক মনে করেন’। যার বিপরীতে ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর মধ্যে আরএসএস ও তাদের অনুসারী বিভিন্ন সংগঠনগুলো পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এর উল্টোটারই জোরালো প্রচার ও তাদের ভাষায় ‘সচেতনতা অভিযান’ শুরু করে দিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশে যে ‘বৈশাখ উদ্যাপন’ কে মনে করা হচ্ছে এর মাধ্যমে ‘ধর্ম নষ্ট হয়ে গেল’। ঠিক ঐ বৈশাখ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেকের ক্ষোভ ‘এর মধ্য দিয়ে আমাদের জাত গেল’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আর কবিতায় বৈশাখকে খুঁজে পাওয়ার পর বাংলার ‘রবীন্দ্রফেটিশ ইতিহাস তাত্ত্বিক ও সংস্কৃতিবানদের’ মধ্যে আবেগ সঞ্চার হয়। তাঁরা মনে করতে থাকেন ‘যা রবীন্দ্রনাথে আছে সেটাই বিধির লিখন’ তার বাইরে আর কিছু নাই, কিছু বলার কিংবা করার নাই’। তবে বক্তব্যটা আমার একান্ত নিজস্ব। ওদিকে ওপার বাংলার অনেকে বাস্তবতা জানেন। তারা বোঝেন নিরাকার ব্রহ্মার আরাধনাকারী ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী রবীন্দ্রনাথ তাদের কেউ নন। তারা জানেন সাভারকর আর রবীন্দ্রনাথ দুটি দুই মেরু। তাই তাদের কাছে ‘গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক নন, মোগল সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক’ এই কথা মেনে নেওয়া অনেক কঠিন। তারা প্রচার করছেন নতুন করে বাংলা নববর্ষ হবে সেই মাস থেকে যা তাদের আদি ও আসল ‘হিন্দু রাজা’ শশাঙ্ক শুরু করেছিলেন। এমনকি তারা সময়কাল হিসেবে শকাব্দকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। তাই তারা নতুনভাবে প্রচার শুরু করেছেন ‘মোগল সম্রাট আকবর কোনোভাবেই নন, গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বাংলা সনের জনক হিসেবে ধরতে হবে। তাদের হিসেবে শকাব্দই বাংলা সন আর সে হিসেবে ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করেছিলেন ‘হিন্দু রাজা শশাঙ্ক’।
বিষয়টিকে আপনাদের কাছে অতিরঞ্জন মনে হচ্ছে ? আসুন একটু ইতিহাসের পাতায় নাড়াচাড়া করে আসি। আপনাদের কী মনে আছে রাজা গণেশের কথা। সেই দনুজমর্দন দেব আর মহেন্দ্র দেবের গল্পটা কী মনে পড়ে? আমি বলছি মহারাজ গণেশ নারায়ণ রায়ভাদুড়ির কথা। বিখ্যাত কাশ্যপ গোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ভাদুড়ি বংশের সন্তান এই গণেশ নারায়ণ রায়ভাদুড়ি তথা রিয়াজ-উস-সালাতিন অনুসারে রাজা গণেশ বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়ার জমিদার ছিলেন প্রথম জীবনে। তিনি যখন আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন তার মুদ্রায় তিনি উল্লেখ করেন ‘শ্রী শ্রী চণ্ডিচরণ পরায়ণ’ পাশাপাশি নিজের নামটাও বদলেছিলেন ‘দনুজমর্দন দেব’ হিসেবে। অবাক ব্যাপার তার এই পরিবর্তনে তিনি যে সাল উল্লেখ করেছিলেন সেটাও হিজরি কিংবা বঙ্গাব্দ ছিল না। সেটা ছিল ‘শকাব্দ’। তাই আদি বাংলা নববর্ষের খোঁজ করাটা ঐতিহাসিক দিক থেকে যতটা কঠিন, রাজনৈতিক দিক থেকে ততটাই জটিল, সাংস্কৃতিক দিক থেকে নানাবিধ সংকট সৃষ্টিকারী আর ধর্মীয় দিক থেকে অবশ্যই বিপজ্জনক।
ইতিহাস থেকে একটু জেনে নেই। আমরা জানি যে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক মারা গিয়েছিলেন ৬৩৭ কিংবা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। তিনি এর আনুমানিক ৪৫ বছর পূর্বে সিংহাসনে দখল করেছিলেন। অনেকে মনে করেন তখন থেকেই তথা ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শকাব্দের নামান্তে বঙ্গাব্দ চালু করা হয়েছিল। আর তারপরের বঙ্গাব্দের সঙ্গে খ্রিষ্টীয় অব্দের ব্যবধানও ঠিক এই ৫৯৩ বছরই হয়। তাই এখনকার ১৪৩১ বাংলা সন শেষ হয়ে যে ১৪৩২ সাল আসবে সেখানে ইংরেজি সময়কাল হবে ঘুরেফিরে ঐ ২০২৪ কিংবা ২০২৫। একটু খোঁজ করে দেখুন সেখানে গণনা করতে গেলে ব্যবধান থাকে ঐ ৫৯৩ বছরেরই। কিন্তু এই সংখ্যাগত দিক থেকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেকেই সরাসরি সম্রাট আকবরকেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশের নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন আর বর্ষবরণ সামনে রেখে সুরটা রবীন্দ্রনাথের লিখে যাওয়া সেই লাইনটার সঙ্গে সিম্ফোনি তৈরি করেছে। ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥’। কিন্তু এই আবর্জনা দূর করা হয় ‘বঙ্গাব্দে’র সূচনা সম্পর্কে প্রচলিত ভিন্নমত গুলো ইঙ্গিত করছে অন্যদিকে। সপ্তম শতাব্দীর গৌড়রাজ শশাঙ্ক তৎকালীন বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক হিসেবে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন কর্ণসুবর্ণ তথা কান সোনায়। তার সময়েও নাকি অগ্রহায়ণ মাসেই শুরু হতো ধান কাটার উৎসব। আর তাই শকাব্দের এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। মাসের নামও রাখা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম আর ‘হায়ণ’ অর্থ বর্ষ বা ধান সে হিসেবে তাদের বছরের প্রথম মাস নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়নি।
ভারতবর্ষের পুরোটা জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায় মোগল সাম্রাজ্য। হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতে গেলে নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাদের। ওদিকে কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলিয়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে গিয়ে বিভিধ ভোগান্তি হয় হয় তাদের। আর এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতেই সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন নতুন এক বাংলা সালের। প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনতে তৎকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি কাজ করেন। তিনি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তন করেনছিলেন নতুন বাংলা সনের নিয়ম। পরে সেটাই পরিচিতি পায় ‘ফসলি সন’ হিসেবে ‘বঙ্গাব্দ’। তারপর এটাকে বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি দেওয়ার পাশাপাশি বৈশাখের প্রথম দিনটিকে পালন করতে দেখা যায় নববর্ষ হিসেবে।
অন্য গবেষকদের বক্তব্য নেওয়ার আগে সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা ‘বঙ্গাব্দের উৎসকথা’ বইটির বিবরণ আমলে নেওয়া যাক। তিনি লিখে গিয়েছেন ‘৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল গৌড়ের সিংহাসনে বসেন শশাঙ্ক। সেদিন থেকেই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন। এই মত অনুসারে, পরবর্তীকালে অনেকেই দাবি করেন যেদিন শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহণ করেন সেদিন থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দের গণনা শুরু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঠিক কোন সময়ে শশাঙ্ক ক্ষমতায় এসেছিলেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঐতিহাসিকরা তার যে শাসনকালের উল্লেখ করেন, তার অনেকটাই নিছক অনুমান। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, তার শাসনকাল ছিল ৬০০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ। সেই সময়ের কিছু প্রামাণ্য পুঁথিতে আবার ‘গুপ্তাব্দ’ শব্দটার উল্লেখ পাওয়া যায়’।
প্রাচীন বাংলার শিলালিপি ও তাম্রশাসন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি শকাব্দের থেকে ‘গুপ্তাব্দ’ কিংবা বিভিন্ন রাজার রাজ্যাঙ্কের বহুল ব্যবহার দেখেছি। আর হিসেবে আমার মনে হয় ‘শকাব্দ’ বাংলার একক কোনো ধারণা ছিল না। এর আগে ও পারে বিভিন্ন নামে সন গণনার রীতি প্রচলিত ছিল বাংলায়। এমনকি পাল বাংলার হিসেবে প্রচলিত সাল ও তারিখ কিংবা দক্ষিণ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন বংশের রাজাদের অনুসৃত সাল ও তারিখ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আমরা চন্দ্র, বর্ম, খড়্গ, নাথ, রাত কিংবা দেব বংশের পাশাপাশি স্বাধীন তিন রাজা হিসেবে গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেবের সময়কাল হিসেবেও শকাব্দকে পাইনি। যা পাই সেটা অন্য কিছু। যদি তাই হয় তবে আদি বাংলা নববর্ষের খোঁজে ‘শকাব্দকে’ সর্বজনীন মনে করার সুযোগ থাকছে না।
শুরুতে শকাব্দের সেই অগ্রহায়ণকে যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে অন্য সালগুলোর কী হবে? গৌড়েশ্বরখ্যাত শশাঙ্কই যদি বঙ্গাব্দের সূচনা করন, তাহলে বঙ্গাব্দের বদলে ‘গুপ্তাব্দ’ শব্দটা কেনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। অনেক রাজা কেনো তাদের জন্য সময়কালের থেকে রাজ্যাঙ্ককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন? আর সে হিসেবে এতোগুলা সাল থাকতে ‘শকাব্দ’ কিংবা ফসলি সনের ‘বঙ্গাব্দের’ অনিবার্যতা আরোপ ভয়ানক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হবে না কেনো? চিন্তার দিক থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে এই শকাব্দ কিংবা বঙ্গাব্দ কোনোটাকেই আমরা অনিবার্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না।
ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করা যাক খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকে। ভানুগুপ্তের ব্যর্থতায় গুপ্তরা তাদের সাম্রাজ্যের শেষদিন দেখতে শুরু করেছেন ততদিনে। তখন ‘বঙ্গ’ নামে কোনো শাসক না থাকায় হয়তো তাদের নামে কোনো সাল হিসেবে ‘বঙ্গাব্দ’ কে পাওয়া কঠিন। তবে ১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করেন মেঘনাদ সাহা। তিনি অনেকটা অঙ্ক কষেই নিশ্চিত করেছিলেন সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। কিন্তু বাংলা অঞ্চল ঐ আকবরের সময়েও ‘হিজরি’ সনে পরিচালিত হয়েছিল। কৃষিপ্রধান এই এলাকায় খাজনা দেওয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুর হিসাব করতে যে বিবিধ সমস্যা তার থেকে উত্তরণ ঘটাতে সম্রাট আকবর প্রচলন করেন চিরচেনা বাংলা সন।
আকবর প্রবর্তিত বাংলা সনের শুরুটা পহেলা বৈশাখ দিয়ে। ওদিকে রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত শকাব্দের শুরুটা ছিল অগ্রহায়ণের প্রথম দিন দিয়ে। গুপ্তাব্দ কীভাবে হিসেব করা হতো সেটা নিয়ে চিন্তার রকমফের রয়েছে। ওদিকে সম্রাট আকবর যে সন চালু করেছিলেন তা পরিচিতি পায় বঙ্গাব্দ হিসেবে। কৃষকদের কর দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে যায় বেশ। অগ্রহায়ণ কৃষকের ঘরে ফসল আনত। তাই আগে এই মাসের প্রথম দিন ছিল নববর্ষের প্রথম দিন। পরে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে যে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় তার শুরুটা ‘পহেলা বৈশাখ’। এগুলো মিলেমিশে একাকার হলে সংস্কৃতির মূল স্রোতধারা খুঁজে নেওয়া বেশ কঠিন।
গবেষক তাপস রায়হানের ধারণা ‘একই সাম্রাজ্যে দুরকম ক্যালেন্ডারের প্রচলন থাকায় নানাক্ষেত্রে বিপদে পড়তেন সাধারণ মানুষ। দুটি ক্যালেন্ডারের গণনা পদ্ধতিতে দিনের তফাত থাকায়, কর সংগ্রহে খুবই অসুবিধা হতো। যে সময় চাষির ঘরে ফসল উঠত, কর সংগ্রহ করা হতো তার অনেক পরে হিজরি ক্যালেন্ডার মেনে। স্বাভাবিকভাবেই এতে সমস্যায় পড়তেন গরিব কৃষক। দেরিতে হলেও, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিকভাবে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। ৩২টি সৌরবর্ষ ৩৩টি চান্দ্রবর্ষের সমান হওয়ায় চাষিরা বাধ্য হতেন অতিরিক্ত এক বছরের খাজনা দিতে। আকবর ভাবলেন খাজনা আদায় যাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় হয় এবং দেশের গরিব চাষিদের যাতে কোনোভাবেই অতিরিক্ত খাজনা না দিতে হয়। সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সহযোগিতায়, সৌর সন আর হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন।’
তিনি আরও লিখেছেন ‘সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন ৯৬৩ হিজরি সনে, ইংরেজি হিসেবে সেটা ১৫৫৬ সাল। তার নির্দেশ অনুসারে, ওই ৯৬৩ হিজরি সন থেকেই তারিখ-ই-ইলাহির প্রথম দিন ধরা হয়েছিল। ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ফতেহউল্লাহ সিরাজি প্রবর্তিত এই নতুন সাল ‘ফসলি সন’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সন বা ‘বঙ্গাব্দ’ নাম ধারণ করে। তারিখ-ই-ইলাহিতে মাসগুলোর নাম ছিল ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুরর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজর, দয়, বহ্মন এবং ইস্ফন্দারমজ। পরে আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়।
চান্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বছর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চান্দ্র বছরে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এ জন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওদিকে বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে। ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে। ‘সন’ একটি আরবি শব্দ। আবার ‘সাল’ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষায় ব্যবহৃত হয়। আর বাংলায় সনকে ‘অব্দ’ নামে অভিহিত করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর এই সময়টাকে বছরের শেষ কিংবা শুরুর আয়োজনে যুক্ত করেছিলেন।
তবে এটা ঠিক যে দুই বাংলার জনপ্রিয়তম কবি রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায় হেমন্তকাল তথা অগ্রহায়ণ সেভাবে আসেনি। কিন্তু রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্তকে আমরা খুঁজে পাই অন্যভাবে। তিনি লিখেছেন : ‘অশ্বত্থ পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে/ শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া, অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু;। এটা তার অঘ্রান প্রান্তর, বনলতা সেন থেকে নেওয়া। ওদিকে রমেশচন্দ্র দত্তের ‘বাংলার কৃষক’ (১৮৭৪) গ্রন্থে আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল ‘আমন ধান ভরা বর্ষায় রোপণ করা হয় নীচু জমিতে। ধান কাটা হয় বাংলা সনের অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে। তার হিসেবে অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসব যেমন ‘আমন পার্বণ’ তেমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস তবে তিনি এটাকে বছরের প্রথম মাস দাবি করেননি।
যাই হোক ড. এনামুল হকের লেখায় পাওয়া গিয়েছে ‘বাংলাদেশের উৎসব প্রধানত আর্তব উৎসব বা কৃষি উৎসব। আর্তব আদিমকালের উৎসব। আদিম অবস্থায় মানুষ যখন যাযাবর জীবনযাপন করত, তখন তারা স্বাভাবিক নিয়মেই ঋতু পরিবর্তনের সময় কালোপযোগী উৎসব পালন করত। মানুষ যখন কৃষি আবিষ্কার করে এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল, তখন সে হলো গৃহী। উপযুক্ত ঋতু দেখেই গৃহীকে শস্য ঘরে তুলতে হয়। তবে ঋতু ধর্মী উৎসব বা আর্তব উৎসবের নজির হিসাবে নববর্ষের কথা বলা যায়।’
নানা তথ্যসূত্র ও তত্ত্বকথার মারপ্যাঁচে সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে জটিল করে তুলে লাভ নেই। পহেলা বৈশাখ কিংবা পহেলা অগ্রহায়ণ এর দুটোই আমাদের আদি ও অকৃত্রিম সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অংশ। এদের কোনোটাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যটাকে খারিজ করে দেওয়াটা সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিপত্তির জন্ম দেয়। অন্যদিকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলে যে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছে সেটাও সাংস্কৃতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ বাংলা সন হিসেবে বঙ্গাব্দ, গুপ্তাব্দ কিংবা শকাব্দই এক কিংবা একমাত্র নয়। এর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও দিন গণনা করা হয়েছিল নানাভাবে। কিন্তু সেগুলোর উপযুক্ত ঐতিহাসিক দলিল এখনও আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোন দিনটির উদ্যাপন মহান, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটি গুরুত্বহীন। কিংবা কোন দিনের উদ্যাপন ঠিক হবে না তা নিয়ে ‘সাংস্কৃতিক পুলিশিং’ কিংবা অহেতুক বিতর্ক জাতি হিসেবে আমাদের যেমন বিভ্রান্ত করবে। তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক উদ্যাপনকে নিঃসন্দেহে খণ্ডিত ও বিপন্ন করবে। তাই বৈশাখ কিংবা অগ্রহায়ণ এগুলোর উৎসব হোক নিছক উদ্যাপনের জন্য। এর বাইরে কোনোভাবেই বাধ্যবাধকতার সীমারেখা তৈরি করা না হোক।