নিখোঁজ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পথেই সমাধান খুঁজতে হবে
জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষকে কী দিয়েছে? এত রক্তপাত, হত্যাকাণ্ড আর ত্যাগের বিনিময়ে কী পেয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের আরেকটি প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, অভ্যুত্থান মূলত হয়েছিল কেনো? আর বিপ্লবের পর পর বিপ্লবী মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কী চায়? একই সঙ্গে এতগুলা প্রশ্নের উত্তর দিতে না গিয়ে চেষ্টা করা যাক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট। আর সেখানে গেলেই দেখা যাবে, দেশের মানুষ সব ক্ষোভ-দ্রোহ-বিপ্লব আর পাওয়া না পাওয়ার খায়খতিয়ান মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বিপ্লবের নদী মোহনায়।
নিখোঁজ গণতন্ত্রের দৈন্য মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করে তুলেছিল। দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার বদৌলতে রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদদের যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছিল বিভিন্ন ব্যবসায়ী আর ফড়িয়া। ওদিকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে পরিচিত চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিবর্গ, অনলাইন সেলিব্রেটি, টকশোতে টেবিল চাপড়ে মিথ্যা বলতে পারা কিছু লোক, চলচ্চিত্রের নায়ক, গায়ক এমনকি ক্রিকেটার কিংবা ফুটবলাররা চেপে ধরে রাজনীতির স্ট্রিয়ারিং হুইল। তাই জনগণের অধিকার দূরে ঠেলে সংসদে কেউ গাইতে শুরু করেছিল গান। আলোচনা হতে থাকে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নিয়ে।
নচিকেতার যে গান এতদিন মানুষ শুনতে গিয়ে লজ্জাবোধ করেছে, অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখেন, সত্যিই তো! নচিকেতা তো আর এমনি বলেননি, ‘মন্ত্রীরা সব হারামজাদা/আস্ত বদের ধাড়ি, তুড়ুক নাচে, মন্ত্রিসভা এখন বাঈজী বাড়ি।/আজকে যিনি কয়লামন্ত্রী কালকে তিনি শিক্ষা, তাই, কয়লাকালো শিক্ষা নিয়ে মানুষ করে ভিক্ষা।’ ওদিকে বিপথে সংসদে গিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদ কোনোভাবেই কাজ করেনি মানুষের পক্ষে। গুম, খুন আর আয়নাঘরের পাশাপাশি নিবর্তনমূলক ‘ডিজিটাল সিক্যুরিটি অ্যাক্ট’ পারলে ‘মানবাধিকার’ শব্দটিকে কান ধরে অভিধানের পাতা থেকে বের করে দিতে চেয়েছে।
দমবদ্ধ অমনি পরিস্থিতিতে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মূলত একটু মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতেই লড়াই করেছিলেন। ওদিকে প্রধান বিরোধীদলের নেতা সরাসরি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ক্ষমতায়কে আসবে সেটা নির্ধারণ করবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন, আমি আমার আপনার সবার ভোটের অধিকার ফেরত চাই’। সাধারণ মানুষের বিপন্ন জীবন তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুণ জ্বেলেছিল। ওদিকে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী দলগুলোর জনস্রোতে উত্থাপিত নৈতিক দাবি জনগণের আকাঙ্খার সঙ্গে মিলে যাওয়াতে সৃষ্টি হয় এক বিধ্বংসী ‘জন বিষ্ফোরণ’। এই জনবিষ্ফোরণকে সরাসরি বুলেট কিংবা বোমা মেরেও রুখে দিতে পারেনি তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার। জনবিস্ফোরণে ঘটে যাওয়া জুলাইয়ের সেই বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে ফ্যাসিস্টদের নেত্রীকে।
দেড় যুগের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিণতিতে ছত্রিশ দিনের ‘অল আউট আন্দোলন’ সফলতার মুখ ধরেছে। এখানে দীর্ঘদিন রাজপথের লড়াইতে সক্রিয় হাজার লাখো মানুষের অবদান রয়েছে। আর সবার একটাই চাওয়া, সেটা তাদের ভোটদানের নৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়া। ‘জুলাই বিপ্লবে’ সরাসরি গণহত্যার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিচার এখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে। সেখানে বিবিধ সংস্কারের গল্প, অল্প অল্প করে যুক্ত হওয়া নানা জল্পনা-কল্পনা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। মহান জুলাইয়ের অগণন আত্মত্যাগ আর রক্তস্নাত শহীদদের স্বপ্নকে দূরে ঠেলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগদান এমনকি উপদেষ্টা হিসেবে পদায়ন বিপ্লবীদের হতাশ করছে। হতাশার শেষ সীমায় গিয়ে অনেকে মন্তব্য করছেন, জুলাইয়ের বিপ্লব বেহাত হওয়ার পথে রয়েছে।
বিধ্বস্ত অবকাঠামোর উপর নতুন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে শুরুতে স্বভাবতই নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়েছে অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেখানে একের পর এক বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ প্রদান ধীরে ধীরে সরকারের কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন। নানা অন্তর্ঘাত বিপ্লবীদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, ‘আওয়ামী লীগকে যারা নিষিদ্ধ করতে চায় তারা দায়ী করছে বিএনপিকে’। অন্যদিকে বিএনপির তৃণমূলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী মনে করেন, ‘জামায়াত ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার লোভে আওয়ামীতোষণ এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে’।কিন্ত তাদের প্রত্যেকের সামনেই একটা সহজ রাস্তা খোলা রয়েছে। আর সেটা হচ্চে সুষ্ঠু নির্বাচন।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সবাই দাবী উত্থাপন করতে পারেন খুব সহজেই। বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন নাকি দ্রুত নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি হবে না। এই দুটি গুরুতর প্রশ্নে দ্রুত এবং গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে জনগণ ভোট দিয়ে সহায়তা করতে পারে। আর বিএনপি কিংবা জামায়াত যদি বলে ‘কোনো গণভোটের চুদুর-বুদুর আমরা মানি না’। আপনি চাইলে কেবল তখনই বলতে পারবেন, বিএনপি কিংবা জামায়াত অথবা তাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো দল আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে চায়। ওদিকে গণভোট কিংবা জনমতের তোয়াক্কা না করে কারও নির্বাহী আদেশে একটা রাজনৈতিক দলকে যারা নিষিদ্ধ করতে আগ্রহী তারা হৃদয়ে, মন ও মননে ফ্যাসিবাদী। এটা গুরুতরভাবেই একটা ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা।
ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল যে নিষিদ্ধ হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই। কারণ পতনের আগে আওয়ামী লীগও জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। তাদের অনেকে নানাভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করেছিল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করতে। তবে তাতে তাদের শেষরক্ষা হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশের সিংহভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে ‘চুপ্পু কেনো প্রেসিডেন্ট আর আওয়ামী লীগ কেনো নিষিদ্ধ হচ্ছে না’ এর জন্য সরাসরি বিএনপিকে দোষ দেওয়া হচ্ছে। যাই হোক, এটা পুরোপুরি হাস্যকর একটা বিষয়। কারণ একটা রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অন্য কারও হাতে নাই। এটা থাকা উচিতও নয়। এইক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে দেশের জনগণ। তারা যদি প্রত্যক্ষ ভোটে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণে মত দেয় তখন কারও কিছু বলার থাকে না। এক্ষেত্রে বি এন পি কিংবা জামায়াতকে সরাসরি দোষ দেওয়া যায় যদি তারা এই গণভোটের বিরোধিতা করে। কিন্তু বিরোধিতার আগে তাদের দোষ দেওয়ার সুযোগ নাই।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন। তারা সেই কাজে কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে তার একটা ‘এসিড টেস্ট’ হতে পারে গণভোটের আয়োজন। যদি সেটা করা হয় তাহলে কিছু না হোক, অন্তত রাজনৈতিক কাদা নিক্ষেপের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও বন্ধ হতো। তখন আর কেউ বলত না, ‘নায়কের প্লট বাতিল হয়েছে। নায়িকার স্বামী উপদেষ্টা হয়েছে, তাহলে নায়িকার প্লট কোথায়’।
মতপার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষমাত্র স্বীকার করবেন, দেশের বিলুপ্ত গণতন্ত্রকে অন্ততপক্ষে দিনের ভোট দিনে ফিরিয়ে আনা বাদে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি মতান্তরে বিপ্লবীদের সামনে অন্য পথ খোলা নাই। তাই সুষ্ঠু একটা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন করা বাদে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাজ থাকার কথা নয়। বাস্তবে কোনো কাজ থাকার কথাও না। এজন্যই কাকে, কীভাবে, কোন কাজে, কোন যোগ্যতায় উপদেষ্টা বানানো হচ্ছে সেটা নিয়ে শতসহস্র প্রশ্ন উঠলেও উত্তর খোঁজার সময় খুব একটা বেশি নাই। বড়জোর গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ে শাস্তির আওতায় আনাটা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হতে পারে। কিন্তু বিগত তিন মাসের কর্মকাণ্ডে সেখানে বর্তমান সরকারের সাফল্য নেই বললেই চলে।
জুলাই বিপ্লবের অলিখিত ইশতেহার সামনে রেখেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনা করার কথা। কিন্ত গণহত্যাকারী এবং তাদের মদদদাতাদের সরাসরি বিচারেরে আওতায় আনার ব্যাপারে যে শম্বুকগতি তা বিপ্লবীদের আশাবাদী করতে পারেনি। পাশাপাশি সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান গড়িমসি সবাইকে বিব্রত করেছে। একই সঙ্গে হাস্যকর ‘সংস্কার’ শীর্ষক ‘সিদ্ধান্তের খেলাধুলা’ বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের বাতুলতা হিসেবে নিছক লোক হাসানো প্রপাগান্ডার বাইরে কিছু দিতে পারেনি।
উদাহরণ হিসেবে দখল হয়ে যাওয়া তুরাগ-বুড়িগঙ্গা নিয়ে একটা কথা বলতে না পারা পরিবেশ উপদেষ্টা প্লাস্টিকের বোতল সরিয়ে জগ এনে বিরাট বাহবা কুড়াতে চেষ্টা করলেন। তিন ফসলী ধানের জমিতে ইটভাটার মতো ধ্বংসাত্মক স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধকরণে তার কোনো বক্তব্য নাই। কিন্তু তিনি হাস্যকরভাবে গুঞ্জন তুলেছেন পলিথিন নিষিদ্ধকরণ নিয়ে। এই ধরনের লোক হাসানো বিব্রতকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রেখে ঢাকার চারপাশের দখল হয়ে যাওয়া নদী আর খালের জমি উদ্ধার করে সেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা তিনি নিতে পারতেন। নদীতে উপযুক্ত স্রোত থাকলে এইসব হালকা পলকা পানির বোতল কিংবা বাজারের পলিথিন ব্যাগের ক্ষতি কমে যেতে পারত বহুলাংশে। অন্যদিকে জলাবদ্ধতার যে অভিশাপ তা থেকে যেমন ঢাকাবাসী মুক্তি পেতেন। তেমনি শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব থেকেও কিছুটা স্বস্তি মেলার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত।
আলোচনা হচ্ছে সংবিধান নিয়ে। এই ফাঁকে ভেঙ্গে পড়েছেন আইন-শৃঙ্খলা। বিপ্লবের সময় ফ্যাসিবাদের পক্ষাবলম্বনকারী পুলিশরা ৫ আগস্টের পর থেকেই তাদের কর্মকাণ্ডে আন্তরিক নয়। তাদের অনেকে কর্মস্থলেও ফেরেনি। ওদিকে রাস্তায় তাকালে দেখা যায় ‘বেশিরভাগ ট্রাফিক পুলিশ বসে বসে টিকটক দেখে নয়তো ফেসবুক স্ক্রল করে’। তাদের বেশিরভাগ রুটিন দায়িত্বও পালন না করাতে রাজপথে যেমন নৈরাজ্য চলছে তেমনি দেশের নানা স্থানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও তথৈবচ।
চটকদার বক্তব্য কিংবা লোকরঞ্জক বক্তব্য দিয়ে সংবাদের শিরোনাম তৈরি করা যায়, কিন্তু দেশের সার্বিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে ঘুরেফিরে সেই নিখোঁজ গণতন্ত্রেরই খোঁজ করতে হবে। বাংলাদেশের সার্বিক সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পথেই সমাধান খুঁজতে হবে। এজন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে গেলে নিঃসন্দেহে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সুনিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে যে অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে কিংবা হবে, তা শুধু প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে কিছু উপস্থাপনযোগ্য শিরোনামের বাইরে অন্য কিছুর জন্ম দিতে পারবে না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।