শহীদ নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নাকি এককাট্টা হওয়ার চেষ্টা করেছিল। যদিও অনলাইনে কিছু তর্জনগর্জন শোনা গেলেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। জনতার তাড়ায় পালিয়ে যাওয়া হাসিনার গুন্ডারা মাঠে নামার সাহস পায়নি। তবে, এই ঘটনা কিছু ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে।
নুর হোসেন স্বৈরাচার বিরোধী শহীদ। গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখে তিনি বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। এরশাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশ যখন আন্দোলন করছে, যুবলীগের কর্মী নূর হোসেন সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে নূর হোসেনের দলের নেতারাই তাঁর রক্তদানকে বৃথা করে দেয়। নূর হোসেন ১৯৮৭ সালে মারা গিয়ে আন্দোলনকে তীব্র করে তুললেও হাসিনা আর আওয়ামী লীগের বেইমানিতে স্বৈরাচার এরশাদ টিকে ছিল আরো তিনটি বছর।
নূর হোসেনের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ এরশাদের সাথে আঁতাত করে গেছে। এর আগের বছর, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের ঠিক পূর্বে, চট্টগ্রামে হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিল যে এরশাদের নির্বাচনে যাবে সে জাতীয় বেইমান। এরপর হাসিনা নিজেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণ-আন্দোলনের পিছনে ছুড়ি মারে।
অন্যদিকে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, বিধবা খালেদা জিয়া এরশাদের পুরোটা সময় লড়াই করে গেছেন। সংগঠন হিসেবে বিএনপি অনেক কম শক্তির হলেও নীতিবোধে তাঁরা পিছুটান দেয়নি। যে কারণে, এরশাদ পতনের পর প্রথম নির্বাচনে শক্তিধর আওয়ামী লীগকে হারিয়ে বিএনপিই জেতে। দেশের মানুষ আপোষহীন নেত্রীকে পছন্দ করে।
আওয়ামী লীগের বেইমানির ইতিহাস ৭১ সালের পর থেকেই। যুদ্ধের সময় বন্দী থাকলেও দেশে ফিরে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে মন না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আর তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা চালায় যথেচ্ছ লুটপাট। মুজিব নিজেও শেষতক দলের বেইমানদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন।
আবার নব্বইয়ের দশকে ফিরে আসা যাক। বিএনপির কাছে হেরে পাগলপারা হাসিনা অল আউট আন্দোলনে গিয়ে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও ক্ষমতার লোভে আঁতাত করে গোলাম আযম আর জামাতের সাথে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও পরে যখন তাঁরা ক্ষমতায় আসে নিজেরাই সেই দাবীকে নির্মমভাবে প্রতিহত করে আইনি, অস্ত্র ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা দিয়ে।
কেবলমাত্র বেইমানি ও শঠতা নয়, আওয়ামী লীগ দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে হস্তগত করে এমন একটা বয়ান তৈরি করে যে রাজনৈতিক কৌশল, সংস্কৃতি, শিক্ষাদীক্ষায় তারাই এগিয়ে। বিএনপিকে তুলনামূলক কম কৌশলী, সংস্কৃতি বিরোধী হিসেবে দেখায় এইসব বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়ার দল। সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সোল এজেন্ট বানিয়ে দেওয়া তো আছেই। যদিও মুক্তিযুদ্ধ কোন একক দলের কৃতিত্ব নয়। অনেকটা ২০২৪ সালের আন্দোলনের মতোই সেখানে দলমত নির্বিশেষে লোকে যুদ্ধ করেছিলো দেশকে মুক্ত করার জন্য। বরং অভিযোগ আছে আওয়ামী অনেক নেতা ভারতে পালিয়ে গেলেও রনাংগনে লড়েছিলেন জিয়াউর রহমান বা মেজর জলিলের মতো মানুষ যারা আওয়ামী লীগের শত্রুতে পরিণত হয়। অনেকে আওয়ামী লীগকে ভারতের সামনে নতজানু হয়ে পড়ার কারণে দলটার বিরোধী হয়ে উঠেন আর এ কারণেই তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তকমা লাগানো হয়।
দীর্ঘ স্বৈরশাসনে আওয়ামী লীগের বয়ান এবং সফট পাওয়ার তথা মিডিয়া কিংবা বয়ান তৈরির মেশিন শক্তিশালী হয়। যদিও বিএনপির মতো দল গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে যায়, তবু আওয়ামী বয়ানে তাঁদের ‘অগণতান্ত্রিক’ হিসেবেই দেখানো হতে থাকে।
কিন্তু, এতো কিছু করেও জনতাকে দমানো যায়নি। হাসিনা ঠিকই পালিয়েছে, আওয়ামী স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। গত তিন মাসে চিত্র পালটে গেছে। ক্ষমতা টেকানোর জন্য হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, লাখো লাখো মানুষের উপর হামলা হলেও দেশবিরোধী দলটা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখায়নি।
বরং পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তাঁরা দেশের পিছনে লেগেছে। ভারতীয় মিডিয়া ব্যবহার করে দেশকে খাটো করতে চেয়েছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোতে উসকে দিয়েছে। এমনকি এই দলের সমর্থকেরা হুমকি ধামকি দিয়েছে যে তারা ভয়ংকর রূপে ফিরে আসবে। কতটা নির্লজ্জ, কতটা জনবিরোধী হলে গণহত্যার পর বিন্দুমাত্র লজ্জা না দেখিয়ে এইসব বলেই চলছে। নুর হোসেনকে ঘিরে তারা আবার ষড়যন্ত্রের স্বপ্ন দেখছিলো।
গণহত্যা আর লুটপাটে আওয়ামী লীগ আবারো প্রমাণ করেছে, এই দলটার একমাত্র উদ্দেশ্যে দেশের মানুষকে শোষণ করে ক্ষমতায় থাকে। আর গত তিন মাসে তাঁদের আচরণ নিশ্চিত করেছে এরা কতটা ভয়াবহ মানসিকতার। আরেকটা জরুরি জিনিস প্রমাণ হয়েছে যে, যে সফট পাওয়ারের বড়াই আওয়ামী লীগ করতো তা আসলে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানো।
যদি আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা সত্যিই সেরকম কৌশলী ও দক্ষ হতো, যেমনটা মিডিয়া বহুবছর দেখিয়েছে, তবে এই তিনমাসে তারা জনতার আস্থা ফেরানোর পরিকল্পনা করতো। সেই অনুযায়ী কাজ করতো। এই বুদ্ধিজীবীদের সেই দক্ষতা আর সততা নেই। এরা টাকা, ক্ষমতা আর অস্ত্রের জোরে নিজেদের বড় করে দেখাতো। যেই চেতনার গল্প এরা দিতো তা আসলে ধান্দাবাজি।
তবে, এতো কিছুর পরেও আওয়ামী লীগ যে আপনা আপনি উড়ে যাবে তা না। দীর্ঘদিনের প্রোপাগান্ডার কিছু ফল থাকবেই। অনেকদিন ধরে দুর্নীতি করা টাকারও প্রভাব থাকবে। ফলে, এই দলটাকে নীতিগতভাবে ধ্বংস করতে হবে।
দেশের তরুণ সমাজ আওয়ামী ভয়ংকর রূপ দেখেছে। তাঁরা এই দলটার বুজরুকি বিশ্বাস করে না। কিন্তু, প্রোপাগান্ডার শক্তি হচ্ছে, তা ধীরে ধীরে বিশ্বাস ফিরায়ে আনে, আন্দোলনে গঠিত সরকারকে অবিশ্বাসে ফেলে দিতে পারে।
ফলে, আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে লাগবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস। আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে জনতার বয়ান তৈরি। আওয়ামী বয়ানের অসাড়তা দেখানো। এর জন্য দরকার মিডিয়া। এর জন্য দরকার সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক কাজ।
কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এই দাবি উঠা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু, আওয়ামী বয়ানের বিরুদ্ধে সফট পাওয়ার না গড়তে পারলে, এদের নীতিগতভাবে ধ্বংস করতে না পারলে শুধু নিষিদ্ধ করে এই গণবিরোধী দলকে নির্মূল করা যাবে না।