ঢাকার মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প
মাত্র ১২ বিঘা জায়গায় ৫৫ হাজার লোকের বসবাস। গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করা মানুষগুলোর শিক্ষাদীক্ষার মতো মৌলিক অধিকার অপ্রতুল। জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসার কারণে মূলধারার মানুষের কাছ থেকেও অবজ্ঞা ও ঘৃণা পেয়ে থাকেন। ইতিহাসের সমীকরণে ভাগ্যহারা বিহারীরা মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকার পায় না। ঢাকার মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে দশকের পর দশক বাস করতে বাধ্য হওয়া এই মানুষগুলো অপরাধচক্রের গুটি হয়ে নারকীয় জীবনে বাস করেন।
ব্রিটিশরা একসময় সস্তা শ্রমের জন্য এইসব বিহারীদের পূর্ববঙ্গে এনেছিল। এরপর ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বহু বিহারী এদেশে আসেন। এ সকল অভিবাসীর বিরাট অংশ ছিল উর্দুভাষী। তখন রাজনৈতিক কারণে এদেরকে উদ্বাস্তু না বলে মুহাজির হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের এই অবস্থান পাল্টে যায়। নিজেদের ভাষা উর্দু ও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের কারণে আগে থেকেই ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটানোরা ন্যূনতম মানবিক অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলে। পাকিস্তান সরকার বড় অংশের বিহারীকে সে দেশে নিতে অস্বীকার করে। তাঁদের জীবন সীমিত হয়ে পড়ে বেশ কিছু ক্যাম্পে। এদের একটি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস, যারা এইসব মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছিল, সেটির অফিস জেনেভায় হওয়ায় ১৯৭২ সালে এই ক্যাম্পের নামকরণ করা হয় জেনেভা ক্যাম্প। লিয়াকত হাউজিং সোসাইটির সাথে চুক্তির মাধ্যমে এ স্থানটিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্যাম্প তৈরি করা হয় যাতে বর্তমানে মাত্র ১২ বিঘা জায়গায় ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে।
হাইকোর্টের ২০০৩ সালে প্রকাশিত এক রায়ে ১৯৭১ সালের পরে জন্ম বাংলাদেশের বিহারিরা বাংলাদেশি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তাঁরাসহ প্রবীণ ক্যাম্পবাসীরা বেশিরভাগ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার হার কম। কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। ফলত, জেনেভা ক্যাম্প পরিণত হয়েছে অপরাধের অভয়ারণ্যে।
তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে চলে অবাধে মাদকের ব্যবসা। প্রতিদিন এখানে কোটি কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা হয়। সেই ব্যবসার দখল নিতে ও আধিপত্য বিস্তারের নিয়মিত খুনোখুনি হয়। সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে খুনোখুনি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ক্যাম্পের আগুনের ধোঁয়া আশেপাশের বহু এলাকার মানুষকে বিচলিত করে। সংবাদমাধ্যমে খবর আসে।
আওয়ামী স্বৈরাচারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে এইসব মানুষের প্রতি ঘৃণা আরও বেড়ে গিয়েছিল, অথচ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ঠিকই এই ক্যাম্পকে অপরাধের অভয়ারণ্য হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। জুলাই আন্দোলনে ক্যাম্পের সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে খুনখারাপি করিয়েছে। হাসিনার পতনের পর পুলিশের অস্ত্র লুটপাট করে ক্যাম্পে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এইসব অস্ত্রের কারণে ক্যাম্পের পরিবেশ আরও বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
এইসব অসহায় মানুষগুলোর প্রতি জাতিগত ঘৃণা বন্ধ করতে হবে। আদালতের রায় অনুসারে এদেশে জন্ম নেওয়া বিহারীদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিতে হবে। যারা আরও আগে এদেশে এসেছিলেন তাঁদের মানুষের মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে। বাংলাদেশে নতুন স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে বিহারীদের প্রতি জাতিগত ঘৃণার চর্চা বন্ধ করতে হবে। জেনেভা ক্যাম্পের মতো মানবেতর জীবনের অস্তিত্ব বাংলাদেশে কাম্য নয়।