Logo
Logo
×

অভিমত

ন্যায়বিচার এবং বি-আওয়ামীকরণ প্রক্রিয়া ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন

Icon

রেজাউল করিম রনি

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩৪ পিএম

ন্যায়বিচার এবং বি-আওয়ামীকরণ প্রক্রিয়া ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন

‘দ্রুত পরির্বতনশীল সমাজে, আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন কৌশলী আক্রমণের সামনে আত্মসত্তা হারাবার সমস্যাটির জন্য স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কম কার্যকরী।’

-আশিস নন্দী

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন কার্যকর হতে পারে না- আত্মশক্তি হারানোর ফলে। আওয়ামী আমলে বিপুল মানুষ তাদের আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ফ্যাসিবাদের সামাজিকীকরণ হয়েছিল প্রতিটি স্তরে। মানুষ কেন আওয়ামী লীগের মতো একটা পরিক্ষিত ফ্যাসিবাদের মধ্যে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিল তার কারণগুলো নিয়ে অনেক ধরনের বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি মোটাদাগে বুঝতে চাই মানুষ কেন আওয়ামী লীগ করে? তা হলে আমরা পাঁচটি কারণকে সামনে রাখতে পারি। এক.  রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত হওয়া। দুই. অনৈতিকতা বা গুন্ডামিকে পূজা করতে আপত্তি না থাকা। তিন. পরিবারের বা ব্যক্তিগত লোভের কারণে বা টাকার প্রয়োজনে। চার. মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, ইতিহাসের দলীয় বয়ান ও মিথ্যার উপর ঈমান বা বিশ্বাস রাখার ফলে। পাঁচ. লীগ করে নাই, আসলে লীগ সেজে ছিল।  

আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এটা ছিল বাংলাদেশ-বিরোধী লুটপাটের একটা সিন্ডিকেট। কেন-না ফ্যাসিবাদ কোনো আদর্শ হতে পারে না। এর কোনো আদর্শ থাকেও না। থাকে এক দানবীয় সংগঠন। আর এই সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকে কিছু ক্রিমিনাল। এখন, আপনি যদি আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট মনে করেন তাহলে এটাকে কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নাই। অন্যদিকে আপনি বলবেন আর ফ্যাসিবাদ চাই না। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে, তার মানে আপনি ফ্যাসিবাদকে বুঝতে পারেন নাই। আপনি যদি রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদ মুক্ত রাজনীতি ও সমাজ চান তা হলে আপনাকে আওয়মীমুক্ত একটি দেশের কথা চিন্তা করতে পারতে হবে। এ কান্ট্রি ইউথআউট আওয়ামী লীগ- এটা ভাবতে পারলেই আপনি পরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলবেন সেই আলাপে প্রবেশ করতে পারবেন। কিন্তু সেটা লীগের মতো একটা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে আমলে নিয়ে আপনি পারবেন না। মনে রাখতে হবে- দুনিয়াতে সব ফ্যাসিবাদই গণতন্ত্রের কথা বলে, জনগণের অধিকার আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় আসে। কাজেই রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদি চিন্তাকে গণতন্ত্রের নামে জায়গা করে দেওয়ার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য সব সময় উদার হতে হবে এমন নীতির বাধ্যবাধকতার কথা বলবার সুযোগ নাই। বিখ্যাত দার্শনিক, কার্ল স্মিথ এই বিষয়টা আরও পরিষ্কার করে ধরতে পেরেছেন, 

‘Every actual democracy rests on the principle that not only is equals equal but unequals will not be treated equally. Democracy requires, therefore, first homogeneity and second—if the need arises elimination or eradication of heterogeneity.’

― Carl Schmitt, (Crisis of Parliamentary Democracy)

এই কথাটা সহজ করে বাংলায় বললে এভাবে বলা যায়- সবাই সমান মানে আসলেই সবাই সমান না। আবার যে সমান না মানে- আন-ইকুয়াল, সে ইকুয়াল হিসেবে বিবেচিত হয় না। এইজন্য গণতন্ত্রও এক ধরনের হোমোজেনিটি বা সমজাতীয়তা দাবি করে। আবার যখন দরকার মনে হয় বা প্রয়োজন পড়ে তখন হেট্রোজেনিইটি বা বিসমজাতীয়তা বা ভিন্নতার সন্নিবেশ বিনাশও করে দিতে পারে। 

কাজেই ইকুয়াল বা সবাইকে সব সময় সমান হিসেবে ট্রিট করার মধ্যেই যে গণতন্ত্র নিহিত তা মনে করার কারণ নাই। বরং সবাইকে একইভাবে ট্রিট করলে গণতন্ত্র অকেজো হয়ে যাবে। এই জন্যই ভ্যালুজ বা মূল্যবোধের কথাটা আসে। গণতন্ত্রের নামে কেউ যদি বলে সবাইকে সমান করে দেখার ব্যবস্থা করবে তা হবে মিথ্যা কথা। এবং এখন যে বৈষম্যবিরোধী শ্লোগান ধারণ করে গণঅভ্যুত্থান হলো এবং এখনও ছাত্রদের একটা অংশ নানানভাবে মাঠে আছে তারাও যদি বলে সমতা এনে দেবে –বুঝতে হবে তারা গণতন্ত্রকে এমন কিছু মনে করে যা গণতন্ত্র নিজে ধারণ করে না। বরং তারা যদি বলে অধিকার বা রাইট প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা লড়ছে- সেটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। মহান কোনো উদ্দেশ্যের কথা বলে, গণতন্ত্রের নামে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া একটা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা।  কাজেই আমাদের বলতে হবে আপনার অবস্থান যাই হোক, আপনার অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হবে- এটা বরং সত্যের কাছাকাছি। আর নাগরিক হিসেবে তার অধিকার নিশ্চিত হলে সে নিজের উন্নতির পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাবে। আর অধিকার নিশ্চিত করার কাজটা করা হবে- মূল্যবোধের আলোকে ব্যক্তি, রাষ্ট্র- প্রতিষ্ঠানে তা কায়েম ও আইনের পক্ষপাতহীন প্রয়োগের মাধ্যমে। কাজেই ফ্যাসিস্ট মূল্যবোধের জন্য সমতা নিশ্চিত করে গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব না। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ দরকার। আজ এখানেই থাক। মূল আলাপে ফিরি। 

আমরা দেখেছি, এই দানবীয় সংগঠন লুটপাটের জন্য উন্নয়নের বয়ান ফেরি করে গোটা সমাজে লোভ উস্কে দিয়ে মানুষের চরিত্রের মৌলিক মানবিক ও সত্যাশ্রয়ী স্বভাবকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিরল ব্যতিক্রম বাদে গোটা সমাজের কালেক্টিভ মোরালিটিকে অতি নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। আলেম থেকে তারকা- যারা সাধারণ মানুষের আইডল ছিল তাদের অনেকেরই চরিত্র হরণের আয়োজন করেছে তাদের এই দানবীয় সংগঠনের সাথে যুক্ত করে। শেখ মুজিবের আমলেই এই দলটি যে ফ্যাসিস্ট তা প্রমাণিত হয়েছিল। তারপরেও দেশে বিপুল মানুষ এই দলটিকে সমর্থন করার মধ্যদিয়ে আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিয়েছিল। এবং গত ১৫ বছরে প্রায় সব ধরনের বিরোধী দল ও মতের উপর আওয়ামী লীগ যে ধরনের অত্যাচার চালিয়েছে তা নজিরবিহীন। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে দলটি যেভাবে শিশু-কিশোর, ছাত্র, সাধারণ জনতার উপর গণহত্যা চালায় তাতে গোটা বিশ্ব তাজ্জব হয়ে যায়। বিপুল রক্তের বিনিময়ে জনতার সকল অংশের সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভয়াবহ ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু এইভাবে ক্ষমতাচ্যুত হলেও ফ্যাসিবাদের সমস্ত কাঠামো অটুট থেকে যায়। যার কারণে ড. ইউনূস সরকারকে পদে পদে ভুগতে হচ্ছে। চারদিকে ফ্যাসিবাদীদের দোসরা এখনও প্রভাব বলয় ধরে রেখেছে। প্রথম দিকে গা ঢাকা দিলেও ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট শক্তি নিজেদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করছে। প্রশাসনে তো বটেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ফ্যাসিস্ট দালালেরা ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকে বিভিন্ন কৌশলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন বাণিজ্যে শামিল হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকে লীগ নেতাদের বিদেশে পার করে দেওয়ার ইজারা নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিষয়টি এখন বিপুল টাকার বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ৫ আগস্টের পরে আটক ছয়শত –এর বেশি নেতাদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সকারকে প্রশ্ন করেও কোন সদোত্তর পাচ্ছে না।  

এখন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে একটা প্রশ্ন উঠছে যে, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যারা এই প্রশ্ন তুলছেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন ফ্যাসিস্ট শক্তির জন্য গণতান্ত্রিক সুযোগ রাখা আর খাল কেটে কুমির আনা সমান কথা। এরা আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে আগের চেয়ে ভয়াবহরূপে ফিরে আসবে। আওয়ামী লীগের খুনিদের বিচারের আগে তাদের রাজনীতিতে দেখতে চায় না কোন রাজনৈতিক দলই। কিন্তু বিচার যে ভাবে এগুচ্ছে তাতে ন্যায় বিচার আদৌ হবে কি না সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদকে বুঝতে না পারার কারণেই হোক বা গণঅভ্যুত্থানের পরের রাজনৈতিক স্পিরিটকে বুঝতে না পারার কারণেই হোক- আওয়ামী লীগ বিষয়ে একটা মীমাংসা ছাড়া জাতিগত ঐক্য সংহত করার কাজটি দুরূহ। আওয়ামী আমলে হারানো আত্মশক্তি না ফিরিয়ে আনা গেলে ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার ভয়ে মানুষ পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস দেখাবে না। বিগত আমলের ভয়াবহতা জনগণের মধ্যে একধরনের ট্রমাও তৈরি করেছে। কাজেই সমাজের আরোগ্য দরকার।  

২.

‘কোন কিছু বিশ্বাস না করার চেয়ে মিথ্যা জিনিস বিশ্বাস করা বেশি ভয়ংকর’

-উমবার্তো একো

প্রথম কথা হলো- আওয়ামী লীগকে একটা রাজনৈতিক সংগঠন মনে করলে আমরা বিরাট ভুল করবো। এটা একটা এমন মতাদর্শগত সংগঠন যার চরিত্রই হলো ক্ষমতা পেলেই ফ্যাসিবাদ কায়েম করা। এটা বাপ-বেটি মিলে দুই শেখ আমলেই প্রমাণিত হয়েছে। এখন কথা হলো- যারা গণহত্যায় অংশ নিয়েছে আপনি তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনবেন। না আনলে হাজারের বেশি শহীদ ও হাজার হাজার আহতদের কাছে আপনিও অপরাধী হয়ে উঠবেন। কিন্তু যারা এই ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকে লালন করে। যারা এখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেই নানানরূপে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী এবং সুযোগ পেলেই বিভিন্নরূপে ফিরে আসার চেষ্টা করে, সমাজে নানান রকম অস্থিরতা তৈরির জন্য আড়ালে থেকে নিজেদের সব শক্তি নিয়োগ করে চলেছে তাদের বিষয়ে আপনি কি করবেন? সে যদি অন্যদলে যোগ দিয়ে সহজে নিজের অবস্থান ও প্রভাব বজায় রাখতে পারতো তা দ্রুত করে ফেলতো, অতীতে যেমন বহু হয়েছে। কিন্তু এবার এমন বিপুল গণঅভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতা ছাড়া হয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। বড় বড় নেতারা পালিয়েছে। অনেকে স্থানীয়ভাবে আত্মগোপনে আছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে। যারা পোস্টধারী নেতা-কর্মী তাদের অপরাধ প্রমাণ করা খুব সহজ। অনেক প্রমাণ আছে। কিন্তু যারা এই জঘন্য কাজের সমর্থক? যারা মনে করে আওয়ামী লীগই তাদের জন্য একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শ? সেইসব বিপুল মানুষ শেখ হাসিনার পালানোতে বিস্মিত ও প্রতারিত বোধ করছেন। আওয়ামী লীগের হয়ে যারা সাধারণ মানুষের উপর চড়াও হয়েছে, পিটিয়েছে, হত্যা করেছে তাদের অপরাধ পরিষ্কার। কিন্তু এই মতাদর্শকে যারা সমর্থন করেছেন, চাঁদা দিয়েছেন, তাদের পক্ষে মতামত তৈরি করেছেন- সেইসব বিপুল মানুষের সমর্থন আবার এই গণহত্যাকে শক্তি জুগিয়েছে। কিন্তু দুই গ্রুপের অপরাধ আবার সমান নয়। ফলে এই বিপুল সমর্থক গোষ্ঠীকে আপনি কি করবেন? তারা কি আজীবন চোরের মতোন গুপ্ত জীবনযাপন করবে? মনে মনে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আর বাইরে অন্য দলে ভিড়ে টিকে থাকার সুযোগ পেয়ে যাবে? এটা হলে, তাদেরকে আবার সমাজে প্রভাব-পতিপত্তি নিয়ে চলতে দেখে শহীদ ও আহত পরিবার এই আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য নিজেদের ধিক্কার দেবে? এটা কি এই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সাথে যায়? যায় না। 

আওয়ামী লীগের আদেশ মেনে যারা জনতার বিরুদ্ধে মাঠে ছিল তাদের অপরাধ, আর যারা এই চিন্তাকে ধারণ করে তাদের অপরাধের মধ্যে পার্থক্য আছে। এখন এতোদিন যেভাবে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে যাকে তাকে অত্যাচার করা হয়েছে, হয়রানি করা হয়েছে। এখন কি তবে আওয়ামী লীগের সাথেও একই আচরণ করা হবে? একইভাবে ভুয়া মামলা, গ্রেপ্তারবাণিজ্য এগুলো চলবে? তাহলে আমরা কিসের পরির্বতনের কথা বলছি? 

কাজেই এটা মিথ্যা ও ভুয়া মতাদর্শকে বিশ্বাস করা সরাসরি অপরাধ না হলেও, এটা অন্যায় বা ভুল। এখন মানুষ মাত্রই অপরাধ করার সুযোগ নাই। কিন্তু ভুল মানুষ করতেই পারে। এবং সেই ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকতে হবে। না হলে নিজের সাথে প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে জীবন পার করতে যদি বিপুল মানুষকে বাধ্য হতে হয় কোনোদিনও জাতীয় ঐক্য সংহত হবে না। আজকে তারা ভিকটিম হলে আগামীতে তারা কিলার হিসেবে ফিরে আসবে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি ভিকটিম বিকাম কিলারস। ফলে এই ভিকটিম বানানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই জন্য আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

৩. 

‘যাইহোক না কেন, নিজের সাথে মিথ্যা বলবেন না’ 

-ফিওদর দস্তয়েভস্কি

আমরা মনে করি, কেবল মাত্র ফৌজদারি অপরাধের বিচারের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। কারণ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পরে ২৫ বছর পর ঠিকই শেখ হাসিনা আবার ফিরে এসেছে।  এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদ যেহেতু সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে ফলে এটা অনেক মানুষের স্বভাব বা খাসলতের মধ্যেও ঢুকে গিয়েছে। ফ্যাসিবাদ শুধু রাষ্ট্র ও ক্ষমতাতেই থাকে না। এটা মানুষের আচরণেও থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু তথাকথিত মূলধারা হিসেবে আওয়ামী লীগকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ঐতিহাসিক ভাবে ফলে আপনি সমাজে প্রচুর আওয়ামী বিরোধী আওয়ামী লীগ পাবেন। আর আমাদের এখানে আওয়ামী লীগের মতো নিকৃষ্ট দলের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে গিয়ে অন্য দলগুলোরও কাঙ্ক্ষিত বিকাশ হয় নাই। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে একধরনের ন্যাচারাল ফেনোমেনা বা বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগকে আপনি চিন্তাগত ও সাংস্কৃতিক ভাবে প্রতিরোধ না করে, সমাজে একে চিরতরে ডিজমেন্টল বা অকেজো না করে এর বিরোধিতা বা এটার পাল্টা প্রতিক্রিয়া আকারে যে রাজনীতিই করেন না কেন তা আওয়ামী পরিমন্ডল পার করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের প্রাসঙ্গিকতার রিস্ক দূর হবে না। কারণ আওয়ামী লীগ অনেক গভীর ভাবে সমাজকে তো বটেই ব্যক্তি চরিত্রকেও কলুষিত করেছে। রাজনীতি একটা বাজে লোকের কারবার-এটার সিম্বল তৈরি করেছে আওয়ামী লীগই। ফলে ভদ্রলোকরা এটার বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই সমাজে এটার যে বিপুল বিস্তার তাকে অধরা রেখে বাংলাদেশ নৈতিকভাবে শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে বিকশিত হতে পারবে না। আত্মপ্রতারক জনগোষ্ঠী দুনিয়াতে কোনোদিন সম্মানিত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নাই। কাজেই বাংলাদেশে এখন যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তার অন্যতম কারণ হলো- সমাজের সম্মিলিত নৈতিক বোধটি ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। মানুষ অন্যায় করাকে নিজের অধিকার মনে করে। ক্ষুদ্র সুবিধার জন্য মিথ্যা শুধু বলে না, নিজের বলা মিথ্যা নিজে আবার বিশ্বাসও করে। এভাবে মানুষের সত্তা মরে যায়। মানুষ তখন বেঁচে থাকে জিন্দা লাশ হিসেবে। এই ধরনের মানুষের কোনো ঐতিহাসিক ও পরমার্থিক সম্ভাবনা থাকে না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতার যে বিস্তার ঘটেছিল তার পুরো অবসান ঘটানোর উদ্যোগ না নেওয়া হলে সামষ্টিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের সম্ভাবনাময় বিকাশের পথ তৈরি হবে না।  

এই জন্য আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে যেভাবে ১৯৯৬ সালে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিয়েলেশন’ কমিশন গঠন করা হয়েছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সালের বর্ণবাদী শাসন আমলে যে বিপুল মানুষ, খুন, গুম ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে নেলসন মেন্ডেলার কোয়ালিশন সরকার। তারা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নাৎসীদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেম বার্গ ট্রায়াল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। কিন্তু এখানে তারা বিচারের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল ক্ষমা করার প্রক্রিয়ার উপর। সমাজে মানবিকতা ও ঐক্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য তারা এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। 

প্রতিটি দেশের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট যেহেতু ভিন্ন ফলে আমরা অন্যদের বিষয়গুলো মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবো। কিন্তু আমাদের জন্য উপযোগী প্রক্রিয়াই আমরা অনুসরণ করবো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে যেভাবে প্রায় ৫ বছর মেয়াদি  ডি-নাৎসিফিকেশনের উদ্যোগ নিয়েছিল মিত্র বাহিনী। আমরাও তেমনি বাংলাদেশে বি-আওয়ামীকরণ বা ডি-আওয়ামিফিকেশনের প্রস্তাব ও প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিতে চাই। এটা একটা বিশাল ও জটিল কাজ। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য এটার কোনো বিকল্প নাই। লম্বা সময় নিয়ে হলেও এটা আমাদের করতে হবে। এই কাজে সরকার, সব রাজনৈতকি দল, আন্দোলনকারী ছাত্র ও সাধারণ জনতা এবং আওয়ামী সমর্থকদেরও সহযোগিতা করতে হবে। ২০২৩ সালে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের যে ৩১ দফা প্রণয়ন করেছিল- সেটার ১৩ তম দফাটি ছিল, 

‘সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে। সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ করা হবে। গত দেড় দশকে সংগঠিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনা হবে।’

 (বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার ১৩ তম দফা, সূত্র: প্রথম আলো; ১৩ জুলাই, ২০২৩ )

এখানে একটা কমিশনের কথা তারা ইতমধ্যেই বলেছেন। এবং পরোক্ষভাবে যারা অপরাধী তাদেরও বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন। বিপুল প্রাণহানি ও গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন এটা আরও বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। কাজেই এই সরকার যদি ভুক্তভোগী এবং সব দলকে সাথে নিয়ে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করে, এবং অল্প সময়ে যদি কাজটি শেষ নাও হয় পরে যারা জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় আসবেন তারা কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিবেন- এটা আমরা আশা করতেই পারি। এটা এমন একটা কমিশন হবে যা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করবে। যার কাজ হবে ট্রুথ, কনফেশন ও রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া সারা দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা। 

৪. 

‘আপনার শত্রু কে সেটা বলুন, আমি আপনাকে বলে দিবো আপনি কে।’

-কার্ল স্মিথ

রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় একটা আওয়ামী শিক্ষা আমাদের অনেক দিক থেকে ক্ষতির কারণ হয়েছে। তা হলো বন্ধুর ধারণা। কথায় কথায় এরা বন্ধু রাষ্ট্রের কথা বলতো। কিন্তু রাষ্ট্র মূলত গড়ে ওঠে শত্রু ধারণার ভিত্তিতে। তাই বলে যার তার সাথে কারণে-অকারণে শত্রুতা করা একটা রাষ্ট্রের কাজ না। কিন্তু একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য শত্রুজ্ঞান করেই নিজের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ও বিকাশ তরান্বিত করবার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। অন্য দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক হয় পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার আলোকে। অন্য রাষ্ট্র বন্ধু -এটা ধরে নিয়ে সম্পর্ক শুরু হলে নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ থাকে না। তেমনি দেশের ভেতরে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি বা চিন্তার বিষয়েও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটা ঐক্য দরকার। সেই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একটা পরিক্ষিত বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে লীগ যেভাবে কমন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এর উপযোগিতা ও উপকারিতা বুঝতে পারতে হবে। আওয়ামী লীগ যে ধরনের চিন্তা ও দর্শন বা সংস্কৃতিকে সমাজে বিস্তার ঘটিয়েছে তাকে ডি-রুটেড বা সেগুলার মূল উৎপাটন করতে না পারলে স্বৈরাচারবিরোধী স্বৈরাচার তৈরি হতে থাকবে। মনে রাখতে হবে ময়লা দিয়ে ময়লা সাফ করা যায় না। কাজেই এই কমন শত্রুকে সর্বত্র মোকাবিলার মাধ্যমে কালেকটিভ মোরাল স্পিরিট তৈরি ও গণতান্ত্রিক, মানে নাগরিকদের অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের পথে হাঁটতে হবে। এটা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে সংহত করতে সহযোগিতা করবে। আওয়ামী লীগকে সমাজে রেখে রাজনীতি করার মানে হবে- আমরা ট্রাইবাল স্তরে থাকবো। লীগবিহীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরির মাধ্যমে আমরা নাগরিক ও রাষ্ট্রের সম্পর্কবিষয়ক আলাপের সরাসরি প্রবেশ করতে পারবো।  এই জন্য সমাজে ব্যাপক ভাবে বি-আওয়ামীকরণ প্রকল্প নিতে হবে। অতীতে যারা কৌশলের অংশ হিসেবে লীগের সাথে ছিল তাতে লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রকাশ্য নৈতিক শক্তি দুর্বল হয়েছে। আওয়ামী লীগ সর্বব্যাপী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ফলে তারা এই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নীতির চেয়ে কৌশলকে প্রাধান্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের সাথে মিশে টিকে থাকার পদ্ধতি নেওয়ার জন্য তাদেরও জাতির কাছে কৈফিয়ত দেওয়া দরকার। মোটকথা লীগের সাথে যে কোনো রকম সম্পর্ক বিষয়ে কনফেশন বা দায়স্বীকার জরুরি। 

এটার জন্য আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। এই কমিশনের মূলে থাকবে নিহত পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা। আওয়ামী আমলে খুন ও গুমের শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যরা এতে যুক্ত হবে। শুধু এই জুলাই অভ্যুত্থান নয়। এই গোটা আওয়ামী রেজিমের যতগুলো অন্যায় হয়েছে সবগুলোর বিচারের জন্য এই কমিশন কাজ করবে। এর কাজের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে। এরা প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা, তাদের ডকুমেন্টেশন তৈরি করা থেকে শুরু করে এই চিন্তার বা মতাদর্শ সমর্থন করা মানুষদের কনফেশন বা দায় স্বীকারের আয়োজন করবে। এটা দেশব্যাপী যেমন হতে হবে, তেমনি সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরেও হতে হবে। এতে করে ফৌজদারি অপরাধে যারা অভিযুক্ত তাদের আলাদা করা সম্ভব হবে। এবং তাদের বিরুদ্ধে যেন কোনো ভুয়া ও সাজানো মামলা না হয় তাও তদারক করা সম্ভব হবে। তাদের মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘন না হয় সেটার সুরক্ষাতেও এই কমিশন কাজ করতে পারবে। 

দক্ষিণ আফ্রিকাতে এই ধরনের কমিনের কাজ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কারণ তারা কনফেশন ও ক্ষমা করার একটা প্রক্রিয়া এতে যুক্ত করেছিল। ভিকটিমের পক্ষ থেকে অন্য কারো কোনোরকম ক্ষমা করার অধিকার নাই, থাকা উচিত না। এতে ভিকটিমের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। তাই আমরা এখানে কাউকে ক্ষমা করার এখতিয়ার নিজের হাতে রাখতে দিতে চাই না। কিন্তু অপরাধীর মানবাধিকারের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে চাপ প্রয়োগ করতে পারি। এবং একই সাথে সারা দেশে বিপুল লীগ সমর্থদের জন্য এই দমবন্ধ পরিবেশে বাঁচার বদলে প্রকৃত অপরাধীদের ধরিয়ে দিয়ে এবং নিজেদের কনফেস বা দায় স্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ গঠনে শরিক হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারলে সমাজের এই ট্রমাটিক অবস্থা ও জাতীয় ঐক্য দ্রুতই সুদৃঢ় করা সম্ভব হবে। 

এই কাজে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহযোগিতা নিতে হবে। এই বিষয়ে কানাডা সরকাররের একটা কমিশন আছে তাদের সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। আরও যেসব কমিশন ও প্রতিষ্ঠান এইসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন তাদের এখানে যুক্ত করতে হবে। সরকার এমন কিছু কমিশন তৈরি করেছে ইতোমধ্যে তাদের সাথেও সমন্বয় হতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, সচিবালয় থেকে শুরু করে পাড়ায়, মহল্লায়, ঘরে ঘরে এই উদ্যোগকে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজ তিন থেকে চার বছর ধরে করতে হলেও তা ধৈর্য ধরে বাস্তবায়ন করতে হবে। সফ্ট লীগার, ফ্যাসিবাদ দ্বারা পালিত জাতীয় পার্টির মতো বিরোধী দলসহ, এতদিন লীগের সহযোগী হিসেবে যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন যুক্ত ছিল সবাইকে এই  ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। 

৫.  

‘সত্য যদি তাদের হত্যা করে, তবে তাদের মরতে দিন’ 

-ইমানুয়েল কান্ট

সত্য, ন্যায় ও সমাজের পুনর্গঠনের এই বিরাট কর্মযজ্ঞ করে আমরা কি অর্জন করবো? আমরা প্রথমে যেটা অর্জন করতে পারবো তা হলো- এর মাধ্যমে নিহত ও আহতদের বিচার প্রক্রিয়ার অর্থবহ অগ্রগতির পথে হাঁটা শুরু হবে। অপরাধীদের ডকুমেন্টেশন তৈরি হবে সারা দেশে। এতে করে বিচারের কাজ সহজ হয়ে যাবে। তারপরে সমাজের যে ট্রমা তা ধীরে ধীরে দূর হতে থাকবে। সমাজের যে নৈতিক অধপতন হয়েছে ফ্যাসিবাদের কালে তার থেকে মানুষের চরিত্র মুক্ত হতে থাকবে। এই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ও অর্জনকে সংহত করা সহজ হবে। বিভিন্ন ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার ভয় দূর হবে। ভারতের বাংলাদেশ নীতে পরির্বতন আসতে বাধ্য হবে। তাদের পরীক্ষিত দোসরদের সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত বিলুপে তাদের বিকল্প চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

কিন্তু এই সবের বাইরেও আরও যে বিষয়টি অর্জন হবে তা হলো-যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা সমাজে জন সমর্থন তৈরির সুযোগ পাওয়ার আগে জনগণ সচেতন হবে। মানুষ যখন দেখবেন একটা ফ্যাসিবাদি চিন্তার দোসর হয়ে আজ তারা অপরাধী অথবা সমর্থন করে তারা ভুল করেছে, আগামী দিনে তারা কোন ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা চর্চা করবে, সমর্থন করবে সেই বিষয়ে একটা পরিপক্ক রাজনৈতিক বোধ জন্ম নেওয়ার সুযোগ হবে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তা ও সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র কায়েমের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। কিন্তু এই ট্রুথ ও কনসিয়েলেশন প্রক্রিয়া শুরু হলে জনগণের মধ্যে আগামী দিনে আর কোনো ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক চিন্তার সমর্থন করার আগ্রহ থাকবে না। রাজনৈতিক মতাদর্শ যে একটা জীবন-মরণ সমস্যার কারণ হতে পারে সেই বিষয়ে একটা বুঝ তৈরি হবে। ফলে গোটা সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও ব্যক্তি মানুষের চিন্তার বিকাশে এই প্রক্রিয়া খুবই দরকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। 

একই সাথে, এতে সমাজে সুপ্ত অবস্থায় থাকা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বিজতলা নষ্ট হবে। ভবিষতে মানুষ কোন ধরনের রাজনৈতিক দল করবে– সেই বিষয়ে একটা সচেতনতা তৈরি হবে। ভুল ও ভুয়া কোনো কিছুর খপ্পরে পড়বে না। যাকে তাকে মহান বানিয়ে পূজা শুরু করবে না। নিজের সাথে প্রতারণা করবে না। নিজের জীবন বিপন্ন হলেও সত্যের পথে থাকতে চেষ্টা করবে। মিথ্যার সাথে আপস করার তরল স্বভাব দূর হবে। সমাজের আত্মশক্তি ফিরবে। আর কমন এনিমি হিসেবে লীগের মতো ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধের সংস্কৃতি জারি থাকলে জাতীয় ঐক্য দ্রুতই সুদৃঢ় করা যাবে। আওয়ামী লীগকে কেউ সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবে না। 

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই কাজে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা রাজি হবে কেন? তাদের নেত্রী পালিয়ে গিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তাদের গণহত্যার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রেখে যে পালিয়ে যেতে পারে তাকে বিশ্বাস করাই যে ভুল ছিল তা এখন অনেকেই মনে করছেন। তা ছাড়া অতীতের স্মৃতি বা অনেকে মনে করতে পারে- আগে দলটির অনেক ভালো ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার আগে দলটি খুব সক্রিয় ছিল। অনেকের নানান কারণে দলটির প্রতি আবেগ থাকতে পারে। থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই গণহত্যার পরে সেই আবেগ একটা অন্যায় আবেগ। সেটাকে আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না। আমরা এই ক্ষেত্রে নন্দীর সুরে সুর মিলায়ে বলতে পারি, 

‘যে ধারণাগুলো এক কালে মুক্তির প্রতীক ছিল, সেগুলিই পরবর্তী যুগে হিংসা ও শোষণের পথ খুলে দেয়। ভাবতে হবে, কীভাবে কখন তুমি অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিচ্ছ।’ 

-আশিস নন্দী (ফুটপাথ পেরুলেই সমুদ্র)

এই কথা লীগ সমর্থকদের বুঝতে হবে। ভুল থেকে বের হয়ে দ্রুত বাংলাদেশ গঠনের কাজে নেমে পড়তে হবে। তারা তাদের আওয়ামী লীগ ত্যাগের আয়োজনটা খুব উৎসবমুখরভাবেও করতে পারে (দুধ দিয়ে গোসল করে হাসিনার ছবিতে জুতার বাড়ি দিয়ে- লীগ মুক্ত হতে পারে, এইজন্য একটা অঙ্গীকারনামা ও সার্টিফিকেশন থাকতে পারে)। আর অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে সহযোগিতাও করতে পারে। তাদের বুঝতে হবে আমরা কেবল কোনো বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে না, আমরা কোনো দলের কথা চিন্তা করে এটা করছি না। মানুষ হিসেবে নিজের হিউম্যান এসেন্স উপলব্ধি করা এবং দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে, ট্রমা থেকে, মিথ্যার সামাজিক চক্র থেকে বের হওয়ার উদ্যোগ হিসেবে এই কাজটিকে দেখছি। এই কাজটি শুরু করার মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদী চিন্তা, বিশ্বাস ও স্বভাবের বিরুদ্ধে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছি। আর যদি তারা তা না করে তা হলে সত্য যদি মিথ্যা আঁকড়ে থাকাদের জীবন বিপন্ন করে তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। 

যারা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন- এই কমিশন তাদের একটা প্রত্যয়নপত্র দেবে। তারা জনগণের কাছে নতুন করে অঙ্গীকার করবেন। এভাবে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়াতে সংযুক্ত করতে পারি। বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হলে, এই দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে। অপরাধী ও ফ্যাসিস্ট আদর্শকে চিন্তাগত ও সাংস্কৃতিকভাবেও সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে পারতে হবে। এটাই এখনকার জরুরি কাজ। 

লেখক: চিন্তক ও সম্পাদক- জবান। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন