নাম বদলের রাজনীতি নয়, নাম সংরক্ষণের রাজনীতি চাই
রেগ্রীইং খ্যং অর্থাৎ বর্তমানে সাঙ্গু নামে পরিচিত নদীর একটি চিত্র। ছবি: লেখক
‘রেগ্রীইং খ্যং’ শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘স্বচ্ছ পানির নদী’। এই স্বচ্ছ পানির নদীটিই হলো আজকের সাঙ্গু নদী, যার আরেকটি বাংলা নাম শঙ্খনদী। যার আদি নাম ‘রেগ্রীইং খ্যং’ । ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের গেজেট প্রকাশ করার সময় এই নদীর নাম রাখেন সাঙ্গু নদী। এরপর থেকে আস্তে আস্তে এটা সাঙ্গু নদী নামেই পরিচিত হতে থাকে।
রেগ্রীইং খ্যং শব্দটি মূলত মারমা শব্দ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মারমারা সাধারণত নদীর তীরবর্তী পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে, অথবা কোনো হ্রদ বা ছড়ার পাশেই তাদের বসতি গড়ে তোলেন। রেগ্রীইং খ্যংয়ের তীর ঘিরেও রয়েছে মারমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই অঞ্চলের বোমাং রাজাকে ( মারমাদের রাজা) ডাকা হতো রেগ্রীইং বোমাংগ্রী, যার অর্থ ‘স্বচ্ছ পানির নদীর রাজা’। এই সাঙ্গু ধরে যতোই উজানের দিকে আগাবেন ততোই এই মারমাদের পাড়া-বসতির দেখা মিলবে। এই নদীর উৎপত্তি স্থল আরাকান পর্বতে। আরাকান পাহাড় থেকে নেমে আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে বয়ে যেতে যেতে সমতলে এসে মিসেছে বঙ্গোপসাগরে। আর এই নদীর দুই তীর ধরেই সবচেয়ে বেশি পাবেন মারমা জনগোষ্ঠির বসবাস।
কিন্তু যে নামটি এই নদী ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদের মানুষের কাছে পরিচিত ছিলো, এই অঞ্চলের রাজাকে যে নদীর নামে ডাকা হতো সেই নদীর নামটি কেন বদলে ফেলা হলো? কেনইবা রেগ্রীইং খ্যং নামটি গেজেট ভুক্ত না করে সাঙ্গু রাখা হলো? শুধু মাত্র উচ্চারণগত সমস্যা ? নাকি আধিপাত্যবাদী সাম্রাজ্যবাদী মনস্তত্ব রাজনৈতিক চরিত্রের নজির?
এই সাঙ্গুর পাড়েই একটি অন্যতম উপজেলা থানচি। এই থানচি শব্দটিও মারমা থাইন চৈ শব্দ থেকে বিকৃত হয়ে থানচি হয়েছে। থাইন চৈ শব্দের অর্থ বিশ্রাম করা। নদী ধরে উজান-ভাটির যাত্রীদের অন্যতম বিশ্রামের জায়গা ছিলো থাইন চৈ। এখনো এই জনপদটি আরও গহীন অঞ্চলে যাতায়াতের পূর্বে একটি স্টেশন হিসেবে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ এই নামের ভেতরই রয়েছে এই জায়গাটি বা জনপদটির গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক ইঙ্গিত।
অনেক স্থানের নাম ঘিরে নানা রকম লোক গল্প প্রচলিত আছে। আবার নানা রকম লোক গল্প, মিথের সাথে জড়িয়েও অনেক স্থানের নামকরণ হয়। আর এইসব লোক গল্প-সাহিত্য, মিথ আমাদের সেই স্থান সম্পর্কে আত্মপরিচয়ের সন্ধানও বের করে দিতে পারে। নামের সূত্র ধরেই বের হয়ে আসে জনপদ গড়ে ওঠার ইতিহাসও। আবার নাম বদলের সাথে সাথেই হাড়িয়ে যায় সেইসব গল্প ইতিহাস মিথ অথবা শেকড়ের সূত্র! কখনো বা পূর্বের নামটি বদলে যায় ভিন্ন ভাষায়।
বান্দরবানের থানচি উপজেলায় বছর দুই হলো তমাতুঙ্গি একটি পর্যটন স্পট হিসেবে উদ্বোধন হয়েছে। নাম তমাতুঙ্গি হিসেবে পরিচিত হলেও এর সঠিক উচ্চারণ তংমা তুংঙ্গি। যার অর্থ পাহাড়ের উপর পাহাড়। এখান থেকে অনেকগুলো পর্বতের চূড়া দেখা যায়। এই স্থানে যখন গিয়েছি তখনো এটি পর্যটন স্পট হিসেবে উদ্বোধন হয়নি। তবে কাজ চলছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়গুলো দেখছিলাম। তখন দূরে একটি পাহাড় দেখিয়ে একজন বলেছিল- ওই পাহাড়টি ‘টেবিল পাহাড়’। জিজ্ঞাস করলাম টেবিল পাহাড় কেন? বললো দূর থেকে দেখতে টেবিলের মতো। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এই নামটি সাম্প্রতিক সময়ে হয়েছে। খুব বেশি বছর আগের না। পর্যটক আসছে আর নামটিও ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় গাইডরাও এভাবেই বলে। এই টেবিল পাহাড়ের আসল নাম ‘লুংমাইচাম’ । এটা বম ভাষা। এই পাহাড়ের আশপাশে রয়েছে বম পাড়া। যতটুকু জানা গেছে, ‘লুংমাইচাম’ এর বাংলা অর্থ হলো পাথুরে মন্দির। এখানকার মানুষের বিশ্বাস এই পাহাড়ে পবিত্র দেবতা থাকে। তাই এই পাহাড়টি তাদের কাছে পবিত্র। সেই লুংমাইচাম এখন টেবিল পাহাড়।
আশপাশের মানুষ জানলেও দূর-দূরান্ত থেকে যারা আসেন, যারা ব্লগ ভ্লগ লিখছেন করেন, সবাই টেবিল পাহাড়ই ব্যবহার করছেন। হয়তো আর কিছুদিনের ভেতরই টেবিল পাহাড়টি থাকবে, লুংমাইচাম আরও অনেক নামের মতো হারিয়ে যাবে।
ঠিক যেমন আন্ধারমানিক। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের কাছে এই নামটি বেশ পরিচিতি। নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবেও ব্লগাররা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ইন্টারনেটে আন্ধারমানিক লিখে সার্চ করলেই শতশত শিরোনাম চলে আসবে, যেগুলোর ভেতর সবচেয়ে কমন কথা হলো ভ্রমণ নিষিদ্ধ এলাকা। আপনার মনে হবে কি যেন ঘটে এই নিষিদ্ধপুরীতে। যদিও আদতে ঘটনা তেমন কিছই না। থাক সে আলাপ। তা আন্ধারমানিক হিসেবে পরিচিত এই এলাকাটির আসল নাম আন্ধারমানিক না। এর আসল নাম ‘ঙাহ্রেসা ম্রং’ । ঙাহ্রেসা ম্রং হলো এক ধরনের দুর্লভ মাছ যা শুধু সাঙ্গু নদীতে দেখা মেলে। আর আন্ধারমানিক এলাকাটি হচ্ছে সেই মাছের অভয়ারণ্য। যখন ঙাহ্রেসা ম্রং এর অর্থ খুঁজে পাবেন, তখন এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের একটি তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। আবার একই সাথে সেই পরিবেশের সঙ্গে সহ-অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীরও খোঁজ পাওয়া যাবে। ঙাহ্রেসা ম্রং নামটিও মারমা ভাষার। আর আন্ধারমানিক পাড়া নামে পরিচিত পাড়াটির আসল নাম ‘য়ংনং’ পাড়া। এটি একটি ম্রো পাড়া। অথচ নামটি হয়ে গেছে আন্ধারমানিক পাড়া।
থানচি হতে রেমাক্রী যাওয়ার পথে সাঙ্গু নদীর একটি স্থানে ভয়ংকর স্রোতের মুখোমুখি হতে হয়। ওই জায়গাটি এখন বাঘের মুখ এলাকা নামে পরিচিত। কিন্তু এর আদি নাম হলো ‘ক্যাঃ পাজা অওয়া্ স্র্যং’। এটাও মারমা ভাষার। এর অর্থ বাঘের মুখ স্রোত। ক্যাঃ পাজা অওয়া্ অর্থ ‘বাঘের মুখ’।
শৈলপ্রপাত বান্দরবানের বেশ পরিচিত পর্যটন স্পট। শৈলপ্রপাত নামটি শৈলপ্রপাত হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগেই ‘চইখ্যং’ নামে ডাকতেন মারমারা। আর বমরা বলতেন ‘চইখ্যংভা’। এই স্থানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই বসবাস। কিন্তু সেই নাম বদলে হয়ে গেছে শৈলপ্রপাত ।
বান্দরবান সদর এলাকাতেই ‘মেঘলা’ নামে পরিচিত আরও একটি স্পটের আসল নাম ‘ডুলুঝিড়ি মাথা’ । যদিও স্থানীয়রা এখনো এই নামেই চেনে এবং ডাকে। তবে সারাদেশের কাছে এই জায়গাটি ‘মেঘলা’ নামে পরিচিত হয়েছে। নীলগিরি নামে পরিচিত পাহাড়টির আসল নাম ‘তেংপ্লং চূট’ । আর ‘শোং নাম হুং’ হয়ে গেছে চন্দ্রপাহাড়।
থানচি থেকে আলীকদম যাওয়ার পথে পড়ে ডিম পাহাড়। এর চূড়াকে দূর থেকে দেখতে ডিমের মতো লাগে। কিন্তু এই পাহাড়টি আগে ‘ক্রাউ তং’ নামেই পরিচিত ছিলো মারমাদের কাছে। আর অনেক ম্রোরা একে ডাকতেন ‘তেংতার চূট’ নামে। গত ১০ /১২ বছর ধরে মূলত এটি ডিম পাহাড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ব্যাপক হারে। এখন আর কেউ এর আদি নামে ডাকে না। মারমা ভাষার ক্রাউ তং শব্দের অর্থ মুরগীর ডিমের মতো পাহাড় বা ডিমপাহাড়। এর নামকরণ নিয়ে যে লোকগল্পটি প্রচলিত আছে স্থানীয় সমাজে সেটি হলো- অনেক আগে কোনো এক আদিবাসী এই পাহাড়ের জুমে কাজ করছিলেন। এক সময় তিনি দুপুরে খাবারের জন্য ডিম সিদ্ধ করতে গিয়ে দেখেন, কিছুতেই ডিম সিদ্ধ হচ্ছে না। অথচ পানি প্রচন্ড গরমে টগবগ করে ফুটছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন ডিম সিদ্ধ হয় না। তখন তিনি ভয় পেয়ে যান। তিনি মনে করেন সেখানে অশুভ আত্মা আছে। অপদেবতা আছে। গ্রামে গিয়ে এই ঘটনা খুলে বললে গ্রামবাসীও একই মত দেন। সেই থেকে তারা একে ক্রাউতং নামে ডাকেন। আর ম্রো’রা ডাকে তেংতার চূট নামে। তেংতার চূট শব্দের অর্থ পাহাড়ের চূড়ায় পিলার বা খুঁটি। এই নামকরণের কারণ হিসেবে প্রচলিত আছে, জরিপকালে ব্রিটিশরা এখানে পাহাড়ের চূড়ায় সীমানা পিলার গেথে ছিলো। সেই কারণে তারা একে এই নামে ডাকে।
খাগড়াছড়ির আলুটিলার একটি গুহা ‘মাতাই হাকর’ নামে সুপরিচিত। ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই’ শব্দের অর্থ দেবতা আর ‘হাকর’ শব্দের অর্থ গুহা। মাতাই হাকর অর্থ দেবতার গুহা। পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া গুহাটি নিয়ে রয়েছে নানা রহস্যময় গল্প। তবে আলুটিলা নাম হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষ শুরু হলে স্থানীয়রা এখান থেকে আলু সংগ্রহ করে খেতো। সেই থেকে জায়গাটি আলু টিলা নামে পরিচিত হয়েছে।
এই রকম নানা রকম গল্প পাওয়া যাবে একেকটি এলাকার একেকটি নামের পেছনে। আবার নাম বদলের সাথে সাথেই সেসব গল্পও হারিয়ে যায়। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় আরও অনেক কিছুই ।
রেগ্রীইং খ্যং মানে স্বচ্ছ জলের নদীর নামটি কেন সাঙ্গু হলো? ভারতবর্ষ জুড়ে ব্রিটিশরা এমন অনেক নামই বদলে দিয়েছে। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম থেকে শুরু করে আমাদের অনেক নদী ও স্থানের নামও সেই বদলের তালিকায় আছে। এগুলো ছিলো ব্রিটিশ শাষকদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের নমুনা।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষে সার্ভে করার সময় আরও অনেক কিছুর নামই বদলে ফেলা হয়েছিল। কখনো নিজেদের উচ্চারণগত সুবিধার কথা চিন্তা করে, কখনো বা নিজেদের আধিপত্যের স্বাক্ষর রাখতে গিয়ে। নিজেদের খেয়াল খুশি মতো নাম দেওয়া, শুধুমাত্র নিজেদের আকাঙ্ক্ষা ও ভাবনা থেকে কোনো স্থানের নাম বদলের এসব মনোভাব ছিল আধিপাত্যবাদী পরিচয়বাদী রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। যার চিন্তা চেতনা জুড়ে নিজেদের অস্তিত্বকেই জানান দেওয়াটা একমাত্র লক্ষ্য থাকে, বাকি সব কিছু ফিকে হয়ে গেলেও তার কিছু আসে যায় না।
বাংলাদেশও কি সেই পথে হাঁটছে? যেখানে বহু জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় উপস্থিতির একটা স্মারক বহন করে এসব নাম, আমরা কি তা বদলে বাঙালিকরণের মধ্য দিয়েই সেই আধিপাত্যবাদী, পরিচয়বাদী রাজনীতিরই বিকাশ ঘটাচ্ছি? বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চলে এসব নাম পরিবর্তনের ঘটনা কিন্তু আরও বেশি উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবেও আরও বেশি শঙ্কার। কারণ এসব অঞ্চলে ভিন্ন ভাষাভাষি ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে তাদের সংখ্যা কিন্তু খুবই সামান্য। এই সংখ্যাটা এতোই কম যে তাদের কৃষ্টি-কালচার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাটাই এই গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কার যুগে বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ভেতর যদি এই রকম নাম বদলের আগ্রাসন চলতে থাকে তা আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয় সংকটকে । এবং বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের অস্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
মনে রাখতে হবে এই যে নানান ভাষার নানান নাম—এগুলো একটি বৈচিত্র্যময় জাতি রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে। আর যখন এগুলো বদলে যেতে থাকে, তখন সেই বৈচিত্র্যময় সুন্দর্যও আড়ালে পড়ে এবং আধিপত্যবাদী জাতি রাষ্ট্রের পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে। অতএব নাম বদল নয় বরং নাম সংরক্ষণের দিকেই আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে আরও অনেক পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের এই দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের বরং নাম বদল নয়, খুঁজে খুঁজে আদি নামগুলো সংরক্ষণ করে, সেই নামের পরিচিতি তৈরির কাজটিই হবে নতুন দিনের রাজনীতি। যদি আমরা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশে যাত্রার কথা বলি, তাহলে এই সব নাম মুছে যেতে দিলে কি সেই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে? সেই যাত্রার কি নৈতিক ভিত্তি থাকবে? যদি সেই ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কাছে কোনো সুদূর পাহাড় থেকে কোনো তরুণ প্রশ্ন করে, আমরা চেনা নামটি বদলে দিলেন কেন? তখন কি উত্তর দেবে রাষ্ট্র?
লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা।