রিস্টার্ট নয়, নিউ স্টার্ট এবং স্ল্যাংয়ের মাহাত্ম্য ও কল্যাণ রাষ্ট্র
৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের দরবার হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।
মানুষ যখন রাগ হয়, ক্ষুব্ধ হয়, তখন নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে গালি বের হয়ে আসে। গালি, অর্থাৎ স্ল্যাং ক্ষোভ প্রকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সভ্য যাদের বলি, সেই পশ্চিমারা ক্ষুব্ধতা প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘ফাঁক’ শব্দটা অহরহ ব্যবহার করে। তবে আমাদের দেশের কথিত সুশীলরা তা মানতে চান না। তারা মূলত বৈষ্ণবদের মতন, তাদের কাছে ক্ষোভের বিকল্প হলো প্রেম। প্রেম দিয়ে তারা সব জয় করতে চান। তাদের এই ধারণাটা মূলত ইউটোপিয়ান। যুদ্ধ প্রেম দিয়ে জেতা যায় না। বিপ্লব রক্ত ছাড়া সম্পন্ন হয় না। সুতরাং বিপ্লবের স্লোগানে স্ল্যাং অপরিহার্য।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন তুঙ্গে উঠার একটি প্রধান উপকরণ ছিল ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল’ এই স্লোগানটি। তখনও এক শ্রেণির সুশীল আফসোসের সুরে বলেছেন, ‘বাচ্চা ছেলেরা কীসব ভাষা ব্যবহার করছে!’ তারা হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে বিপ্লব করতে চান। গান গেয়ে সাহায্য তোলা যায়, বিপ্লব করা যায় না।
আর বিপ্লবের সাথে যে সকল গানের সংহতি রয়েছে, সেগুলোতেও রয়েছে ক্ষুব্ধতা, এমনকি কোনো গানে রয়েছে গালিও। ‘কারার ওই লৌহকপাট’ এ গানটিতে রয়েছে ক্ষুব্ধতা। জাতীয় কবি নজরুল তার অনেক গান-কবিতায় ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন ‘সুশীলতা’র সীমা লঙ্ঘন করেই। না হলে তিনি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে পারতেন না। হালের নচিকেতা’র কথাই বলি। তার গানে সরাসরি বলে দিলেন, ‘মন্ত্রীরা সব শুয়োরের বাচ্চা’। বিপ্লবে-বিদ্রোহে স্ল্যাং এর বিকল্প কিছু নেই। ২৪ এর বিপ্লবেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘সাকিবের নাই বিবেক বোধ, সাকিব তুই মাদারচোদ’, এমনি একটি স্লোগান। যে স্লোগানে সাকিবের মতন দেশপ্রেমহীন স্বার্থপরদের চরিত্র সঙ্গতই পরিস্ফুট হয়েছে।
বিপ্লবের স্লোগানে-গানে যেমন রাগ প্রকাশ করতে স্ল্যাাং এর প্রয়োজন, তেমনি বিপ্লবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে কিছু বাড়তি কথা বলা মানুষের প্রয়োজন রয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের কথা ভাবি। সেখানেও মানুষকে রাগান্বিত করতে অনেক বাড়তি কথা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং বলা হয়েছে। মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে হয়, কোনো কোনো স্বপ্ন সত্যি হবে না জেনেও। কারা এসব মানুষ তা বলার আগে আমাদের ২৪ এর বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের তুলনা করে নিই। ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, নিম্নমান তথা করুণ অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সীমাহীন জাতীয় ঋণকে। সাথে সর্বগ্রাসী বেকারত্ব, খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য। এছাড়া রাজপরিবারের অতিরিক্ত খরচে রাজকোষের শূন্যাবস্থা। সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণিকে বেশি সুবিধা দেওয়া। যাজক শ্রেণির ভোগ-বিলাসের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ রকম বৈষম্য ইত্যাদিকে।
ওপরের বিষয়গুলোর সাথে আমাদের জুলাই বিপ্লবের পূর্বেকার অবস্থা মেলান দেখি। দেখবেন, জুলাই বিপ্লবের আগে ফ্যাসিস্ট রেজিম সৃষ্ট করুণ অর্থনৈতিক অবস্থা, সীমাহীন ঋণ। বলতে গেলে, বেকারত্বের জন্যই মূলত গড়ে উঠেছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন, যা পরবর্তীতে ফ্যাসিজম বিরোধী বিপ্লবে রূপ নেয়। খাদ্যসহ অনেক পণ্যেরই উচ্চমূল্য, যা বিপ্লব্ পরবর্তী প্রায় তিন মাসেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফ্যাসিস্ট রেজিম নিজেদের রাজপরিবার হিসেবে ভাবতো।
যার ফলেই ‘আমি ষোল কোটি মানুষকে খাওয়াই’ এমন ভয়াবহ আমিত্ব জেঁকে বসেছিল কথায় কথায়। এই স্বঘোষিত রাজপরিবারের উচ্চাভিলাষ ও খরচের কারণে ক্রমেই রিজার্ভ তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেয়ার প্রমাণ তো হাতেনাতে পাচ্ছি। পুলিশে নিজদলের লোক। প্রশাসনে কত স্তর যে সাজানো হয়েছে নিজ ঘরানার মানুষ দিয়ে তা বলাই বাহুল্য। এখন ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’ হবার অবস্থা। যাজক শ্রেণি মানে দরবেশ আর এস আলমরা। এদের ভোগ-বিলাসের সাথে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন চরম বৈষম্যমূলক। অর্থাৎ যে কারণে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তার সবগুলো কারণই জুলাই বিপ্লব পূর্ববর্তী বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিল।
এমন একটা অবস্থায় মানুষকে সংগঠিত ও উত্তেজিত করতে কিছু ভোকাল মানুষের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। সেই ভোকাল মানুষদের একজন হলেন পিনাকী ভট্টাচার্য। বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে তার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা হবে বোকামি। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার প্রয়োজন কতটুকু তা সময়েই বলে দেবে। কিন্তু যারা পিনাকীর মতন মানুষদের বিপ্লব সংগঠন ও বিপ্লবকালীন সময়ে সমালোচনা করেছেন, তাদের চিন্তার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
প্রশ্ন ওঠা আরও স্বাভাবিক বিপ্লব সংঘটিত করার ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি নিয়ে। স্বপ্ন দেখাতে না পারলে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়। যারা বিপ্লবকালীন সময়ে বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের বাড়তি কথা বলে উত্তেজিত করতে চাই না’, তারা মূলত বিপ্লবটাই চাননি নিজেদের অজান্তেই। তারা চিয়ার্স গার্লদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন অতীতে যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তেজক কবিতা পাঠের ইতিহাস ও প্রয়োজনীয়তার। কত অলীক ঘটনারই-না অবতারণা করা হয়েছে সেসব কবিতায়। সে কবিতায় বাড়তি বা অসম্ভব কথা রয়েছে সত্যি, কিন্তু যুদ্ধ জেতার ক্ষেত্রে ওই কথাগুলোই সঞ্জিবনীর কাজ করেছে। ‘আমি আপনাদের অসম্ভব আশার কথা বলবো না’ এটা বিপ্লব পরবর্তী আলাপ। বিপ্লব পূর্ববর্তী আলাপের ধরণ অন্যরকম। হ্যাঁ, সবাই যে উত্তেজনা বাড়ানোর সাথে যুক্ত থাকবেন তা নয়। বিপ্লবে সবারই ভিন্ন ভিন্ন কাজ রয়েছে। তবে ‘অসম্ভব আশার কথা বলবো না, এমন বলা বিপ্লব নয়, বরং বিপ্লবের বিরোধিতা। এমন কথায় মানুষ আশাহত হয়। আশাহত, হতাশ মানুষ দিয়ে আর যাই হোক বিপ্লব হয় না।
ধারণা করছি অনেকের ধরণ দেখে, তাদের কাছে সম্ভবত মনে হচ্ছে বিপ্লব শেষ হয়ে গেছে। তাই তারা সমঝোতার কথা বলছেন। কেউ কেউ ক্ষমার মহত্ত্ব প্রমাণে অস্থির হয়ে উঠেছেন। অথচ বিপ্লব শেষ তো নয়ই বরং শুরু। তাদের এসব অর্বাচীনতায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হই। তারা বিপ্লব, আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের পার্থক্যই বুঝে উঠতে পারেন না, পারেননি। যেমন, কেউ কেউ না বুঝেই জুলাই বিপ্লবকে গণঅভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যা দিতে চান। পার্থক্য না বোঝার কারণেই আজ রাষ্ট্রপতি বিষয়ক, সংবিধান বিষয়ক, নানা আইন-কানুনের প্রায়োগিক বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্নে উঠে, উঠছে। বিপ্লবকে যদি বিপ্লব বলে সবাই মেনে নিতেন এবং বিপ্লবের চরিত্র বুঝতেন। নাহয়, নিদেনপক্ষে ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষিত বা চরিত্রের সাথে তুলনা করতেন। তাহলেই এসব সংশয়, বিপত্তির সৃষ্টি হতো না।
মুশকিল হলো আমাদের বর্তমান সরকারের কিছু মানুষদের নিয়ে। তাদের শ্রেণিচরিত্র কখনোই বিপ্লবীদের নয়, ছিল না। তারা আলাপ-আলোচনা কিংবা আপোসরফায় বিশ্বাসী। নেগোশিয়েশন যাকে বলে। তা্ই তারা দায়িত্ব পেয়ে তাদের মডিউল অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছেন। আর অন্য যারা আছেন, বিশেষ করে তরুণরা, তারা রয়েছেন বিপ্লবী চরিত্রে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কিছু সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির। আর আমাদের মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গতই কোনো বিপ্লবী চরিত্র নেই। যার জন্যে তারা এতদিন বিপ্লব করতে পারেনি। তাদের ক্ষমতা ছিল আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্যেই। তারা দলীয় সরকার আর ফ্যাসিস্ট রেজিমের পার্থক্য করতে পারেননি। আন্দোলন হলো নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। যেমন করেছিলেন, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু বিপ্লব হলো তা, যাতে সরকারকে পালাতে হয়। কিছুদিন আগেই যা দেখা গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। সরকার পদত্যাগ করলে প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড বিঘ্নিত হয় না। বিপ্লবে সব ভেঙে পড়ে। যেমন, আমাদের এখানে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে পুলিশসহ বাহিনীগুলির। এ অবস্থার সাথে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো টিউনড নয়। তাদের ধারণাতেই ছিল না, একটা জগদ্দল ফ্যাসিস্ট রেজিম এমন বিপ্লবের সমুখে ধুলোর মতন উড়ে যেতে পারে। তাদের চিন্তাতেও ছিল না রেজিম প্রধানের পলায়নের বিষয়টি। তারা ভাবতে পারেনি বাংলাদেশেও ফরাসি আদলে বিপ্লব সম্ভব। তারপরেও বিপ্লব হয়েছে এবং তা দেশের মানুষ মনেপ্রাণে চেয়েছিল বলেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সে বিপ্লবের চরিত্র এখনোও সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। তাই তারা সেই তাদের পুরানো ধাঁচেই এগুচ্ছে। অনেকটা এরশাদের পতন পরবর্তী সময়কালের মতন। যে কারণে বিপ্লবের ধারার সাথে হালের রাজনৈতিক ধারা সমানতালে চলতে পারছে না। চারিদিকে তার নজিরই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। অথচ ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান ঠেকাতে বিপ্লবের চরিত্র বোঝার কোনো বিকল্প নেই।
এখন অনেকে পুনর্গঠন সম্পর্কিত যেসব আলাপ করছেন, সেসব আলাপ মূলত বেহুদা এবং অর্থহীন। এসব আলাপে মূলত ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঘটবে। সে হোক আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কিংবা অন্য কোনো দলের। আমাদের সুযোগ এসেছে সিস্টেম পরিবর্তনের। এই পরিবর্তনের ধারায় পুরানোদের মধ্যে প্রয়োজনীয় যারা তারা থাকবেন, তবে ধরনটা হতে হবে পুরানোকে বিলুপ্ত করেই। বলতে পারেন রিস্টার্ট নয় একেবারেই নিউস্টার্ট। এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে আবার ফিরতে হবে পুরানো চক্রে। যে চক্রে ঢুকে গেলে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা আর সম্ভব হবে না।